পাসপোর্টে পুলিশ ভেরিফিকেশনের আইনটি বাতিলের সিদ্ধান্তের পর অবশেষে বিদেশগামী যাত্রীরা হয়রানি ও ভোগান্তি থেকে মুক্ত হতে যাচ্ছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) থাকলে পাসপোর্টে আর পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রয়োজন হবে না।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রোহিঙ্গারা যেন এনআইডি-পাসপোর্ট না পায় সেক্ষেত্রে সতর্ক থাকা হবে। অবশ্য এ বিষয় নিয়ে ভিন্নমত বিশ্লেষকদের। তারা বলছেন, একেবারেই হঠাৎ করে পাসপোর্ট থেকে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিল করলে হয়তো অনেক সমস্যার মুখোমুখি পড়তে হতে পারে। এই প্রক্রিয়াটি একেবারে বাতিল না করে, সহজ করলে পাসপোর্ট সেবাগ্রহীতাদের ভোগান্তি কম হবে।
অন্যথায় অপরাধীরা এক্ষেত্রে বিভিন্ন কৌশলে পাসপোর্ট তৈরি করে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে। অনেকেই আবার ভোটার আইডি ব্যবহার করে নকল পাসপোর্ট তৈরির চেষ্টা করতে পারে; যদিও এসব বিষয়ে সরকার সতর্ক।
তারা বলছেন, পুলিশ ভেরিফিকেশন না থাকলে অনেক অপরাধী চক্র এক্ষেত্রে সুযোগ নিতে পারে এবং অপরাধের প্রবণতাও বাড়তে পারে। তবে ভোটার আইডি, জন্মনিবন্ধন ও শিশু কার্ডের দিকে সরকারের বেশি নজর দিতে হবে। তাহলে এমন সিদ্ধান্তের সফলতা আসবে।
বিশ্লেষকদের দাবি, রোহিঙ্গারা যেন এনআইডি অথবা পাসপোর্ট না পায় এক্ষেত্রে সরকার কঠোর থাকলেও পুলিশ ভেরিফিকেশন না থাকলে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট পাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। বিগত সরকারের আমলেও আমরা দেখেছি, রোহিঙ্গারা খুব সহজেই পাসপোর্ট পেয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের আরও ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
এর আগে ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, পাসপোর্ট প্রাপ্তির ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিধান বাতিল করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তিনি জানান, পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনের দরকার নেই- এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কাজেই এখন থেকে পাসপোর্ট করার সময় পুলিশ ভেরিফিকেশন লাগবে না। এ ধরনের সিদ্ধান্তগুলো জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে জেলা প্রশাসকদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘পাসপোর্ট তো আমার নাগরিক অধিকারের একটা অধিকার। আমি চোর না ডাকাত সেটা পুলিশ আলাদাভাবে বিচার করবে। আমাকে যে জন্মসনদ দিয়েছেন সেটা তো কোনো পুলিশ ভেরিফিকেশন নিয়ে করেননি। আমাকে এনআইডি দিয়েছেন সেটাও কোনো পুলিশ ভেরিফিকেশন নিয়ে করেননি, নাগরিক হিসেবে পেয়েছি।
সরকার মানেই মানুষকে হয়রানি করা, এটাকে উল্টে দিতে হবে। আপনার অধিকার পৌঁছে দেওয়াই আমাদের কাজ।’ এর আগে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন নাগরিকের পাসপোর্টে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিলের সুপারিশ করার পর এমন সিদ্ধান্ত আসে।
সূত্র জানায়, সাধারণত পাসপোর্ট রেগুলার ডেলিভারি, এক্সপ্রেস ও সুপার এক্সপ্রেস- এই ৩ ক্যাটাগরিতে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে অনেক প্রসেসিং করতে হয় এবং পাসপোর্ট পেতে গেলে পুলিশি তদন্ত ও জরুরিভাবে পাসপোর্ট নিতে গেলে ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ মানুষ। এখন থেকে আর বেশি টাকা দেওয়া এবং ভোগান্তিতে পড়তে হবে না সেবাগ্রহীতাদের।
পাসপোর্ট সদর দপ্তরের সূত্র জানায়, প্রতিদিন গড়ে ৩০ হাজারের বেশি পাসপোর্টের আবেদন পড়ে এবং দিনে ২৫ থেকে ৩০ হাজার পাসপোর্ট প্রিন্ট করে ডেলিভারি দেওয়া হয়। প্রতি মাসে গড়ে ১০ লাখ পাসপোর্ট সেবা গ্রহীতাদের প্রদান করা হয়।
একটি বিশেষ সূত্র জানায়, এখনো সারা দেশে প্রায় ৮ থেকে ১০ লাখের মতো পাসপোর্ট জমা রয়েছে। সেগুলো প্রদানের ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজনীয়তা শিথিলকরণ করেছে সরকার। এসব বিষয়ে গতকাল সোমবার একটি নির্দেশনাও দিয়েছে সরকার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া পাসপোর্ট প্রদান ব্যবস্থা চালু হলে জনগণের ভোগান্তি কমবে। তবে রোহিঙ্গারা যেন পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) না পায়, সেজন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিধান বাতিল করেছে সরকার। ফলে এখন থেকে পাসপোর্ট পেতে হলে পুলিশের ক্লিয়ারেন্স লাগবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহম্মদ বলেছেন, পাসপোর্ট প্রদানের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিধান বাতিল করেছে সরকার, পাসপোর্ট পাওয়া নাগরিক অধিকার, সেহেতু পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিধানের দরকার নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, পাসপোর্ট থেকে পুলিশি তদন্ত একেবারেই তুলে দিলে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাবে। এর কারণ হলো- আমরা জাতি হিসেবে সভ্য নই, অনেক জায়গায় প্রশ্নবিদ্ধ। এক্ষেত্রে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ অনেকটা সমালোচনায়ও পড়তে হতে পারে।
এর কারণ হলো- কাউকে যাচাই-বাছাই ছাড়া পাসপোর্ট দিলে বিদেশের মাটিতেও অনেক অপরাধী বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নানা ধরনের অপরাধ করলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের বদনাম হবে। এক্ষেত্রে পুলিশি ভেরিফিকেশনের দরকার আছে। তবে মেজর দু-একটা বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়ে একেবারে পুলিশি ভেরিফিকেশন তুলে না দিয়ে পুলিশি তদন্ত রাখা উচিত এবং এই বিষয়ে সরকারের ওপর মহলে আরও আলোচনা করা দরকার বলে মনে করি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের আরেক সহকারী অধ্যাপক এ. বি. এম. নাজমুস সাকিব রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, পাসপোর্ট প্রদানের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনের কেন করতে হয় বিষয়টি আগে আমাদের বুঝতে হবে।
পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি ও অর্থ আদায় করা হয় এবং পুলিশ বিতর্ক। তা ছাড়া পাসপোর্টের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে আলাদা পুলিশ নেই। আমরা নাগরিকের ভোটার আইডি কার্ড মূল্যায়ন করি এর আগে জন্মনিবন্ধন। এক্ষেত্রে একই ব্যক্তির জন্য আলাদা করে পুলিশ ভেরিফিকেশনের দরকার আছে কি না আমার জানা নেই।
তিনি বলেন, পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় তো আমরা ভোটার কার্ড, জন্মনিবন্ধন এগুলোই দিয়ে থাকি, তাহলে পাসপোর্টের জন্য আলাদা কিছুর দরকার কি? প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট দিয়েই তো পাসপোর্টের আবেদন করা হয়। পুলিশ এই ভেরিফিকেশনের নামে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট পাচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের আগে সূক্ষ্মভাবে ভোটার আইডি তৈরি করে দেওয়া হয়, পরে তারা পাসপোর্ট পেয়ে থাকে। তাদের পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে তো আমাদের কেউ না কেউ জড়িত। তবে আশা করি, এক্ষেত্রে সরকার কঠোর হবে হয়তো। সবার আগে আমাদের পরিবর্তন হতে হবে, অন্যথায় আমরা জাতি হিসেবে ভালো কিছু করতে গেলে বাধার মুখোমুখি হবো।