ঢাকা শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

অনেক প্রশ্ন সামনে রেখে গুলশানে ১৫ তলা অ্যাপার্টমেন্ট

মাইনুল হক ভূঁইয়া
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২৫, ০৮:৫৭ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

অনেক প্রশ্ন সামনে রেখে গুলশানে ১৫ তলা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প তৈরি করছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। সরেজমিনে দেখা গেছে, চারপাশে ঝোপ-ঝাড়ে ভরা ভবনটির ১৪ তলা সম্পন্ন হয়ে এখন ছাদ ঢালাইয়ের কাজ চলছে। ২০২৩ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে। প্রকল্পের সূচনা লগ্নে রাজউকের চেয়ারম্যান ছিলেন আনিসুর রহমান মিঞা। মজার বিষয়, এই প্রকল্পে তিনি ৩ হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটও বাগিয়ে নেন। 

সরেজমিনে দেখা গেছে, গুলশানের ৩৫ নম্বর সড়কের সিডব্লিউএন (বি)-৮ প্লটটির আয়তন ৩২ কাঠা। রাজউক এই প্লটটিতেই ১৫ তলা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প হাতে নেয়। নাম দেওয়া হয় ‘রূপসা’। রূপসা প্রকল্পে ৩ হাজার বর্গফুটের মোট ফ্ল্যাট হবে ৪৮টি। এর মধ্যে ৫টি মন্ত্রণালয় ও সরকারের হাতে সংরক্ষিত রেখে ৪৩টিই লটারির মাধ্যমে ইতিমধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়ে গেছে। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রাহাত মোসলেমীন এই প্রকল্পের পিডি।

[34576]

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তৎকালীন চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান মিঞা ছাড়াও অন্যান্যের মধ্যে অ্যাপার্টমেন্টটিতে ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়েছেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, তৎকালীন বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী ও কামরুল হাসান মোল্লা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ সচিব আমিনুল ইসলাম প্রমুখ।

প্লটটি নিয়ে নানা প্রশ্ন:  যে প্লটের ওপর রাজউকের অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প রূপসা গড়ে উঠেছে- একে ঘিরে রয়েছে নানা গল্প, নানা প্রশ্ন। অভিযোগ রয়েছে, ৩২ কাঠার এই প্লটটি ১৯৬৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি মো. ওসমান শেখ নামে এক ব্যক্তি তৎকালীন ডিআইটি (বর্তমান রাজউক) থেকে লিজ নেন। 

আশির দশকে সরকার এটিকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি ঘোষণা করে ‘ক’ শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করে। পরে রাজউক ৯৯ বছরের জন্য তাকে লিজ দেন। ১৯৯০ সালের ২৬ অক্টোবর ঘোষণাপত্র দলিলের মাধ্যমে জমিটি তিনি তার স্ত্রী জাহিরা ওসমানকে দানপত্র করে দেন। কিন্তু পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ ১৪ বছরেও জমিটি তাকে বুঝিয়ে দেয়নি রাজউক। 

[34856]

অনন্যোপায় হয়ে অসুস্থ জাহিরা ওসমান সেটেলমেন্ট আদালত থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করেছেন। সব আদালতই তাকে প্লট বুঝিয়ে দেওয়ার আদেশ দেন। তবে কোনো আদালতের আদেশেরই তোয়াক্কা করেনি রাজউক। শেষমেশ তিনি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হলে কিছু অসাধু কর্মচারী তার কাছে মোটা অঙ্কের ঘুষ দাবি করেন। 

তিনি অপারগতা প্রকাশ করলে উল্টো সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে পূর্বতন আদেশ প্রতিপালনে বাধাগ্রস্ত করা হয়। বিষয়টি এখানেই থেমে থাকেনি। আবাসন সমস্যা সমাধানের অজুহাত দেখিয়ে সেখানে তড়িঘড়ি ১৫ তলা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প রূপসা হাতে নেওয়া হয়।

এদিকে জাহিরের আমমোক্তার মো. মোতালেব জানান, রাজউক আলোচ্য জমিটি ‘ক’ শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে জানতে পেরে জাহিরা সেটেলমেন্ট আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। সাক্ষ্য-প্রমাণ শেষে দীর্ঘ দুই বছর পর ১৯৯১ সালে সেটেলমেন্ট আদালত জমিটি ‘ক’ শ্রেণি থেকে অবমুক্ত করে তাকে বুঝিয়ে দেওয়ার আদেশ দেন।

মোতালেব জানান, পরে এ আদেশের বিরুদ্ধে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় হাইকোর্ট বিভাগে রিট করেন। দীর্ঘ শুনানি শেষে হাইকোর্ট সেটেলমেন্ট আদালতের রায় বহাল রেখে মন্ত্রণালয়ের রিট খারিজ করে রায় দেন। হাইকোর্ট বিভাগ তার রায়ে সেটেলমেন্ট আদালতের আদেশ দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়নের জন্য গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন। 

[34856]

মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, হাইকোর্ট বিভাগের রায় বাস্তবায়নে গড়িমসি করা হলে জাহিরা শেখ হাইকোর্ট বিভাগে আরেকটি রিট করেন। শুনানি শেষে হাইকোর্ট বিভাগ ১৯৯৭ সালে দীর্ঘ রায়ে স্পষ্টত ‘ক’ শ্রেণি থেকে অবমুক্ত করে প্লটটির রায়ের কপি পাওয়ার জন্য ৬০ দিনের মধ্যে বাদী জাহিরাকে হস্তান্তর করতে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন। কিন্তু মন্ত্রণালয় সেই রায়কেও পাত্তা দেয়নি। ফলে বাধ্য হয়ে জাহিরা ওসমান ২০০৮ সালে হাইকোর্ট বিভাগে একটি আদালত অবমাননার মামলা করেন।

বিজ্ঞ আদালতের বিচারপতি এন এ সুলতানা ও বিচারপতি মো. শামসুল হুদার দ্বৈত বেঞ্চ ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আবেদনকারীর পরিচয় যাচাই সাপেক্ষে রায় দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। রায়ের কপি নিয়ে আবেদনকারী নির্বাচন কমিশন, পাসপোর্ট অফিস এবং সিআইডির হস্তরেখা বিশারদের মাধ্যমে পরিচয় যাচাই-বাছাই করা হয়। কিন্তু তাকে এবারও প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি।

[34850]

আদালতের রায় বাস্তবায়নে তাদের কাছে মোটা অঙ্কের ঘুষ দাবি করা হয়। আবেদনকারী সম্মত না হওয়ায় মন্ত্রণালয় ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে এবং আপিল নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা না করে দ্রুততার সঙ্গে প্লটটিতে অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প হাতে নেয়। 

প্রশ্ন উঠেছে, আপিল নিষ্পত্তি হওয়ার আগে কেমন করে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হলো। কেন-ই বা মানবিক দিকটি উপেক্ষা করা হলো।

সার্বিক বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক ও রাজউকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রাহাত মোসলেমীন বলেন, আইনগত দিকটি আমি বুঝি না, তবে জমিটি যথাযথভাবে অধিগ্রহণ করা হয়েছে এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বুঝিয়ে দেওয়ার পর প্লটটিতে অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের নির্মাণকাজ হাতে নেওয়া হয়েছে।