সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে দীর্ঘস্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়া ভূমি মন্ত্রণালয়ের খাসজমিতে গোপালগঞ্জে শেখ মুজিবুর রহমানের বাবা শেখ লুৎফর রহমানের নামে ‘শেখ লুৎফর রহমান গ্রন্থাগার ও গবেষণা কেন্দ্র’ স্থাপিত হয়েছে। অথচ সাবেক আওয়ামী সরকারের সময় এই জমিকে শেখ মুজিবের পারিবারিক জমি দাবি করে অনৈতিক প্রচারের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
শুধু তাই নয়, শেখ লুৎফর রহমান গ্রন্থাগার ও গবেষণা কেন্দ্রের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) কোথাও বলা হয়েছে, এই খাসজমি সরকারের কাছ থেকে শতবছরের জন্য ইজারা নিয়ে গ্রন্থাগার করা হবে। আবার কোথাও বলা হয়েছে, এই জমি শেখ মুজিবুর রহমানের পারিবারিক জমি। ফলে জমির মালিকানা নিয়ে একটি ধোঁয়াশা ছিল।
গত ৫ আগস্ট সাবেক আওয়ামী সরকারের পতনের পর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অধীনস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈঠকে দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো এই প্রতিষ্ঠান থেকেও শেখ পরিবারের নাম বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
তবে জমিটি পারিবারিক হলে তা সম্ভব নয়, তাই জমির মালিকানার বিষয়ে দায়িত্বশীল মহল কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে দেখতে পায়, ০.২৩ শতক পরিমাণের এই জায়গাটি ভূমি মন্ত্রণালয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে দীর্ঘস্থায়ী বন্দোবস্ত দিয়েছে।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এই জমিতে শেখ মুজিবুর রহমানের বাবার নামে লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র করার সিদ্ধান্ত নেয়। গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও প্রকল্প সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জমির মালিকানার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর গ্রন্থাগার থেকে বাদ যাচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমানের বাবার নাম। এটির নতুন নাম হচ্ছে, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ নায়েব সুবেদার মো. আশরাফ আলী খান বীরবিক্রম গ্রন্থাগার ও গবেষণা কেন্দ্র’। নাম পরিবর্তনের পাশাপাশি, ব্যয় বরাদ্দ কমানো ও প্রকল্পের সময় বাড়াতে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠিয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি এই প্রস্তাব নিয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় গ্রন্থাগারের জন্য বই ও কম্পিউটার সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্য বাজার দর যাচাই কমিটির মাধ্যমে নতুন দর প্রাক্কলনসহ বেশকিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়। সভার কার্যবিবরণী এখনো না পাওয়ায় কাজ তেমন এগোয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, এই প্রকল্প নতুন করে বাস্তবায়ন না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
অন্যদিকে একটি দল ও ব্যক্তির প্রচারের উদ্দেশে দেশের এক হাজার সরকারি-বেসরকারি পাঠাগারে স্থাপিত গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের ‘মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু কর্নার’ প্রকল্পে ব্যয়িত প্রায় ২২ কোটি টাকা অপচয় হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে এই দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর সূত্রের দাবি, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু কর্নার নামে স্থাপিত এই কর্নার এখন মুক্তিযুদ্ধ কর্নার নামে রয়েছে। এই প্রকল্পের জন্য কেনা ৫ কোটি টাকার বইয়ের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কিত বইগুলো শুধু বস্তাবন্দি রয়েছে। প্রকল্পের বাকি টাকা খরচ হয়েছে গ্রন্থাগারের চেয়ার, টেবিল, তাক, বই রাখার শেলফ ও গ্রন্থাগারের সাজসজ্জার জন্য। এগুলো নষ্ট হওয়ার কারণ নেই।
জানা গেছে, পৈতৃক নিবাস গোপালগঞ্জে শেখ মুজিবুর রহমানের পিতার নামে ‘শেখ লুৎফর রহমান গ্রন্থাগার ও গবেষণা কেন্দ্র’ নির্মাণ প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ২৪.২৪ কোটি টাকা।
দুই বছরের সময়সীমায় প্রকল্পের সংশোধিত মেয়াদ ধরা হয় ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। গ্রন্থাগার ও গবেষণা কেন্দ্র নির্মাণসহ প্রকল্পসংশ্লিষ্ট উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে ছিল ভূগর্ভস্থ পানির আধার নির্মাণ, অভ্যন্তরীণ রাস্তা, গ্রন্থাগার ঘিরে চারদিকে সীমানা প্রাচীর ও দরজা নির্মাণ।
প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল, শেখ মুজিবুর রহমানের পিতার স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য গোপালগঞ্জের পারিবারিক জমির ওপর একটি আধুনিক গ্রন্থাগার ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা। এ ছাড়া শেখ মুজিবুর রহমানের শৈশব, কৈশোর, পারিবারিক স্মৃতি, জীবন-কর্ম, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা ব্যক্তিগত পর্যায়ে গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা।
২০২৩ সালের ৭ জানুয়ারি ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দু’দিনের গোপালগঞ্জ সফরের শেষ দিনে টুঙ্গিপাড়ায় উপস্থিত থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই গ্রন্থাগার ও গবেষণা কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর ওই বছরের ১৬ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রন্থাগারের নির্মাণকাজ শুরু হয়। গত বছরের ডিসেম্বরে এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই সাবেক আওয়ামী সরকারের পতন হয়।
চলতি বছরের জানুয়ারির প্রকল্পের মাসিক অগ্রগতির প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গত বছরের জুন পর্যন্ত এই প্রকল্পে কাজ শেষ হয় ৩৩ শতাংশ। আর চলতি বছরের বর্তমান সময় পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে ৬০ শতাংশ। নির্মাণকাজের মধ্যে বর্তমানে তিন তলার ছাদ ঢালাই শেষ হয়েছে। তবে গাঁথুনি ও প্লাস্টারের কাজ চলমান।
সূত্র জানায়, গত বছরের ৫ আগস্ট সাবেক আওয়ামী সরকারের পতনের পর ১৮ আগস্ট সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সে সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত দপ্তরপ্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসনের প্রস্তাব অনুযায়ী বৈঠকে ‘শেখ লুৎফর রহমান গ্রন্থাগার ও গবেষণা কেন্দ্রে’র নাম পরিবর্তন করে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ নায়েব সুবাদার মো. আশরাফ আলী খান’ নামে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পাশাপাশি প্রকল্পে আগের ব্যয় বরাদ্দ ২৪.২৪ কোটি থেকে কমিয়ে ২৩.৫৬ কোটি টাকা করা হয়।
এ ছাড়া চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের সময় এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। এসব পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করে গত ১৩ জানুয়ারি গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। পরে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ওই প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায়।
লুৎফর রহমান গ্রন্থাগার এবং মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু কর্নার বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মনীষ চাকমার সঙ্গে। লুৎফর রহমান গ্রন্থাগার বিষয়ে বর্তমান প্রকল্প পরিচালক বিস্তারিত বলতে পারবেন বলে মন্তব্য করে মহপরিচালক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বঙ্গবন্ধু কর্নার প্রকল্প এরইমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। তাই এ বিষয়ে বলার কিছু নেই।
মহাপরিচালক জানান, গণগ্রন্থাগারের পাঠকসেবা বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গ্রন্থাগারের বহুতল ভবন নির্মাণ, উপজেলা পর্যায়ে বুকস ইন ব্যাগসসহ নানা প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে পাঠকসেবার মান বাড়বে।
এ বিষয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (উন্নয়ন ও পরিকল্পনা শাখা) ও প্রকল্প পরিচালক আলমগীর হুছাইন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ১নং খাস খতিয়ানের ০.২৩ শতক জমি ভূমি মন্ত্রণালয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে দীর্ঘস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রদান করেছে। ওই জায়গায় লাইব্রেরি হচ্ছে। প্রকল্পের ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের সময় বাড়ানোর জন্য পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার প্রকল্প : সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের প্রকল্প শুরু হয় ২০২০ সালের জুলাই মাসে। শেষ হয় ২০২২ সালের জুনে। প্রকল্পে খরচ হয় ২২ কোটি ২৪ লাখ টাকার বেশি অর্থ।
প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ও শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন-কর্ম সম্পাদিত বই সরবরাহের মাধ্যমে পাঠক, গবেষক, তথ্য আহরণকারীদের মাঝে যথাযথ তথ্য তুলে ধরা। দেশের বিভিন্ন কারাগারের ভেতর থাকা পাঠাগারেও বানানো হয়েছিল বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার।
এই প্রকল্পের আওতায় ৭১টি সরকারিসহ দেশের এক হাজার পাঠাগারের কর্নারের জন্য কেনা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি, তাঁর লেখা বই, তাঁকে নিয়ে লেখা বই এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বইগুলো। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের কাছ থেকে এ জন্য ২৫০টি করে বই ও বই রাখার তাক পায়।
বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধুর জেলজীবন নিয়ে ৩০৫৩ দিন, অমর শেখ রাসেল, ছোটদের বঙ্গবন্ধু, শেখ মুজিব আমার পিতা, বাংলাদেশে জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অথবা শেখ হাসিনার নির্বাচিত উক্তি- এমন শিরোনামের বইগুলো দেওয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নারের জন্য।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট সাবেক আওয়ামী সরকারের পতনের পর এই প্রকল্পের মাধ্যমে তৈরি করা বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার থেকে বঙ্গবন্ধু নামটি মুছে ফেলা হয়েছে। কর্নারে রক্ষিত শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বা শেখ হাসিনার ছবি যেখানে আছে তা মুছে ফেলা হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে নিম্নমানের চাটুকারধর্মী কোটি টাকার বই বস্তাবন্দি করে রাখা হয়েছে। তবে কোথাও কোথাও বই রাখার শেলফ, তাক, টেবিল, চেয়ার কিছু রয়েছে। তবে পাঠকসেবা বলতে তেমন কিছুই নেই।
বেসরকারি গ্রন্থাগার পরিদর্শনের সঙ্গে যুক্ত একটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেছেন, প্রকল্প শেষ হয়ে গেলে তা মনিটরিংয়ের জন্য কোনো বন্দোবস্ত থাকে না। তবে একটি দল ও ব্যক্তির প্রচারের জন্য বিশেষ উদ্দেশ্যে নেওয়া এই প্রকল্প থেকে আসলে কোনো লাভ হয়নি। যেসব বেসরকারি গ্রন্থাগারে এসব কর্নার স্থাপন করা হয়েছে তাদের অধিকাংশই অকার্যকর। টাকা হাতিয়ে নেওয়াই মূল লক্ষ্য ছিল।
একাধিক বেসরকারি গ্রন্থাগার পরিদর্শন করে মাঠপর্যায়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কর্নার থেকে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার নাম এবং ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। অধিকাংশ স্থানেই শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা বই বস্তাবন্দি করে গুদামে রাখা হয়েছে।
এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন মোছা. মরিয়ম বেগম। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, প্রকল্প শেষ হওয়ার আগের ছয় মাস প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। প্রকল্প শেষ হওয়ার পর তা মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নেই। আর বেসরকারি গ্রন্থাগার তদারকির দায়িত্ব আমাদের নয়। সার্বিকভাবে এই প্রকল্পে ব্যয়িত টাকা অর্থহীন হয়েছে কি নাÑ প্রশ্নে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
আপনার মতামত লিখুন :