ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগেই পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে বিদেশে পাঠিয়ে দেন। আওয়ামী লীগের প্রভাবশারী মন্ত্রী-এমপি ও নেতাকর্মী শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়ে ঘুণাক্ষরেও টের পাননি।
তবে শেখ পরিবারের সদস্যরা জুলাইয়ের শুরু থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত বিমানে চড়ে বিভিন্ন দেশে চলে যান। দলীয় নেতাকর্মীদের দেশে রেখে পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে বিদেশে চলে যাওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে শেখ হাসিনার নৈতিকতা নিয়ে। খোদ দলটির নেতারা বলছেন, আমাদের বিপদে ফেলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বিদেশে নিরাপদ ও বিলাসী জীবন-যাপন করছেন।
গত দেড় দশকে শেখ পরিবারের সদস্যরা সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি করেছেন। দেশের সবখানেই এই পরিবারের সদস্যরা হরিলুট করেছেন। লুটের টাকা বিদেশে পাচার করে অফশো কোম্পানির মাধ্যমে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাড়ি-গাড়ি করেছেন। নিয়েছেন বিদেশি নাগরিকত্ব।
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার প্রায় ৭ মাস পার হলেও এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়নি শেখ পরিবারের সদস্য বা শেখ হাসিনার স্বজনরা। দীর্ঘদিন দেশ শাসনকারী শেখ পরিবারের সদস্যরা ৫ আগস্টের আগেই দেশত্যাগ করলেও বর্তমান সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এখন দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। যা নিয়ে প্রশ্নও উঠছে বারবার।
দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা, ব্যাংক হিসাব জব্দ, আয়কর বিবরণী তলবসহ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) শেখ পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতি ও অপরাধের অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে পারেনি।
অন্যদিকে, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ সারা দেশে বিভিন্ন থানা ও আদালতে ছাত্র-জনতা হত্যাযজ্ঞের অসংখ্য মামলা হয়েছে। হত্যা মামলাগুলোতেও পুলিশ এখন পর্যন্ত তদন্তে অগ্রগতি দেখাতে পারেনি।
৫ আগস্টের পর থেকে শেখ পরিবারের কোনো সদস্যের খোঁজ নেই। হাসিনার দেশত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে গত দেড় দশকের ক্ষমতাশালী আত্মীয়-স্বজনরাও যেন হারিয়ে গেছেন। বেশির ভাগ স্বজন হাসিনার আগেই দেশ ছেড়েছেন। গত দেড় দশকে দেশ লুট করা টাকায় বিদেশে বিলাসী জীবন-যাপন করছেন।
আওয়ামী লীগের বিদেশে পলাতক ও দেশে আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরা অনলাইন এবং অফলাইনে ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে জনমত ও নেতাকর্মীদের একজোট করার চেষ্টা চালিয়ে গেলেও শেখ পরিবারের কোনো সদস্য দলটির কোনো ধরনের কর্মকাণ্ডে যুক্ত রয়েছে দৃশ্যমান এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। শেখ পরিবারের সদস্যদের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীদের ক্ষোভ বেড়েছে, তাদের দাবি- ক্ষমতায় থাকতে সব মধু তারাই খেয়েছে আর এখন আমরা ভুক্তভোগী হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগেই শেখ পরিবারের সদস্যরা নিরাপদে দেশ ছেড়ে চলে যান। বর্তমানে তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত পাচারকৃত টাকায় গড়ে তোলা সম্পদ দিয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বিলাসী জীবন-যাপন করছেন।
দলীয় কোনো ধরনের কর্মকাণ্ড বা দলটির পালিয়ে বেড়ানো নেতাকর্মীদের কোনো ধরনের যোগাযোগ করছেন না। ক্ষমতায় থাকাকালীন শেখ পরিবারের সদস্য দলীয় নেতাকর্মী ঘেঁষা ছিলেন। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকায় ভয়ে দল বা সরকারের কেউ তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস পেত না।
শেখ পরিবারের সদস্যরা ছিলেন জমিদারদের মতো। আগের আমলের রাজা-বাদশারা যেমন বিলাসী জীবনযাপন করতেন, ঠিক তেমনি তারা করতেন। আর বর্তমানেও শেখ পরিবারের সদস্যরা বিদেশের মাটিতে বিলাসী জীবন কাটাচ্ছেন।
শেখ হাসিনার দেড় দশকের ক্ষমতার আমলে তার পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনরা হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করেছেন, অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ বিদেশে পাচার করেছেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে শেখ হাসিনা, আর এটি ব্যবহার করে তারই আত্মীয়-স্বজনরা মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন।
ঘুষ, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য করে মালিক হয়েছেন অবৈধ সম্পদের। দেশের বিভিন্ন স্থানে হাসিনার আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক জমি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখলের অভিযোগ পুরনো। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে দিনের পর দিন অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়লেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হয়নি।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ মদদে দেশজুড়ে তারা রামরাজত্ব কায়েম করেছিল। শেখ হাসিনার আত্মীয়-স্বজনদের দৃশ্যমান কোনো রোজগার না থাকলেও তাদের চলনে-বলনে এবং জীবনযাপন ছিল রাজা-বাদশাদের মতো। রাজপ্রাসাদে বসবাসের পাশাপাশি হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়ে তুলে প্রত্যেকে আলাদা আলাদা সাম্রাজ্যের মালিক বনে যান।
স্বৈরাচার হাসিনার আত্মীয়-স্বজনদের ত্রাসে সাম্রাজ্যের রোষানলের শিকার হয়েছে অসংখ্য মানুষ। ব্যবসায়ীরা তাদের মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে বাধ্য হতো। তাদের সরকারি উন্নয়ন কাজে কমিশন বাণিজ্য, নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য ওপেস সিক্রেট। হাসিনার আত্মীয়-স্বজনদের দরবারে ডাক পড়লে হাজির হতে হতো। চাহিদামতো কাজ করা বা মোটা অঙ্কের অর্থ দেওয়াটা ছিল শিরোধার্য।
শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে দিল্লিতে কর্মরত। সরকারের পতনের সময় তিনি দিল্লিতেই ছিলেন। দিল্লিতে যাওয়ার পর তার মা এবং খালার সঙ্গে সায়মার সাক্ষাৎ হয়।
শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ এমপি, তিনি লন্ডনে বসবাস করছেন। শেখ রেহানার ছেলে রেদওয়ান সিদ্দিক ফিনল্যান্ড ও ছোট মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীও যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম ভারতে অবস্থান করছেন।
তার দুই ছেলে শেখ ফজলে ফাহিম ও শেখ ফজলে নাইম সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন। শেখ সেলিমের ছোট ভাই ক্যাসিনো বিতর্কের রাজা শেখ ফজলুর রহমান মারুফ তাদের ভগ্নিপতি যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী বর্তমানে সিঙ্গাপুরে আছেন।
গত ৩ আগস্ট বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনার আত্মীয় সদস্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। শেখ ফজলে নূর তাপসের বড় ভাই আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ তার স্ত্রী সানজিদা যুথীসহ কানাডায় অবস্থান করছেন।
বরিশালের আবদুল হাসনাত আব্দুল্লাহ, ছোট ভাই সাবেক সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ ছোট ছেলে সুকান্ত আব্দুল্লাহ ভারতে অবস্থান করছেন। তার ছেলে বরিশাল সিটির সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।
বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসেরের ছেলে ও শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই বাগেরহাট-১ আসনের সাবেক এমপি শেখ হেলাল মালয়েশিয়ায় ও তার ছেলে বাগেরহাট-২ আসনের সাবেক এমপি শেখ সারহান নাসের তন্ময় থাইল্যান্ডে অবস্থান করছেন।
শেখ হেলালের ভাই খুলনা-২ আসনের সাবেক এমপি শেখ সালাউদ্দীন জুয়েল ইংলান্ডে অবস্থান করছেন। তাদের আরও তিন ভাই শেখ সোহেল, শেখ রুবেল ও শেখ বেলাল সিঙ্গাপুর ও মালেয়শিয়ায় রয়েছেন।
শেখ হাসিনার ফুফাতো বোন শেখ ফাতেমা বেগমের ছেলে ভাতিজা মাদারীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন এবং তার ভাই ফরিদপুর-৪ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন চৌধুরী বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন।
শেখ হাসিনার চাচা শেখ কবির হোসেন ও তার ভাই শেখ নাদির হোসেন ভারতে অবস্থান করছেন। আরেক চাচাতো ভাই শেখ হাফিজুর রহমান ইংল্যান্ডে রয়েছেন।
হরিলুটের টাকায় শেখ পরিবারে সদস্যরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে হোটেল-রিসোর্ট ও বাড়ি ক্রয় করতেন এবং সেগুলো ভাড়া দিতেন। এ ছাড়া আরও অনেক ব্যবসায় কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছেন।
দেশে শেখ পরিবারের বড় ধরনের কোনো ব্যবসা বা আয়ের জায়গা ছিল না। তাদের প্রায় সব সম্পদ বিদেশে। ৫ আগস্টের পর থেকে তারা স্থায়ীভাবে বিভিন্ন দেশে পরিবার বসবাস করছেন। শেখ পরিবারের অধিকাংশ সদস্য বিদেশি নাগরিকত্ব নিয়েছেন বিগত সময়ে।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সরকারের আটজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনার স্বজন। সিটি করপোরেশনের মেয়র তিনজন, সহযোগী সংগঠনের চেয়ারম্যান ও সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করেন আরও তিনজন।
কোটা সংস্কার থেকে হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাজপথে নেমে আসা ছাত্র-জনতার ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও দলের নেতাকর্মীদের গুলিতে প্রায় দেড় হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়। আহত হয় ২০-২৫ হাজার।
প্রায় এক হাজার মানুষ চিরতরে পঙ্গু হয়ে যায়। চোখ হারায় হাজারখানেক মানুষ। হাসিনার দোসররা বল প্রয়োগ করে ছাত্র-জনতাকে দমিয়ে রেখে আন্দোলন রুখে দিতে চেয়েছিল। স্বৈরাচার হাসিনার মতো তার আত্মীয়-স্বজনরাও দেশব্যাপী হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল।
শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই দলের মন্ত্রী-এমপি ও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা কেউ দেশ ছেড়েছেন, কেউ আছেন আত্মগোপনে। তবে শেখ হাসিনার আত্মীয়-স্বজনদের এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেননি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
যদিও হাসিনা-রেহানার সন্তানেরা ৫ আগস্টের আগে থেকেই দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য মতে, শেখ পরিবাররে বেশির ভাগ সদস্যই এখন আর দেশে নেই। ৫ আগস্টের আগে-পরে তারা দেশ ছেড়ে গেছেন। গত ৫ আগস্ট সামরিক বিমানে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা। ওই দিন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছাড়া তাদের আত্মীয়-স্বজনদের আর কোনো সদস্য দেশে ছিলেন না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শেখ পরিবারের সদস্যরা সব ক্ষেত্রেই সুবিধাভোগী ছিল। এটি প্রায় রেওয়াজে পরিণত হয়ে যায়। এই পরিবারের নাম ব্যবহার করলেই জবাবদিহির ঊর্ধ্বে যাওয়া যায়, সবাই এটি জানত।