ঢাকা শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

স্বাস্থ্য খাতের স্বাস্থ্য খারাপ

রহিম শেখ
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৫, ০৯:২৩ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন খাতের মতো স্বাস্থ্য খাতেও হয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি। কেনাকাটা প্রক্রিয়ায় হয়েছে লুটপাট। দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে স্বাস্থ্যসেবায় ভোগান্তি ও চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থনীতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনেও। বিপুল পরিমাণ লুটপাটের কারণে চলতি অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বড় বরাদ্দ থাকলেও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের হার খুবই কম।

চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে প্রকল্পগুলোর গড় বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৭১ শতাংশ। বিশেষত স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের প্রকল্প বাস্তবায়ন হতাশাজনকভাবে নেমে এসেছে শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশে। এই দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে প্রতি বছর ৮ লাখ রোগী উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। 

চিকিৎসা খাতে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা এতটাই প্রকট যে, সরকারি সেবা নিতে গিয়ে ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ পরিবার দুর্নীতির শিকার হচ্ছে। তা ছাড়া স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের ৭৩ শতাংশ জনগণকেই বহন করতে হয়, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও কার্যকর পরিকল্পনা ছাড়া এই খাতে উন্নয়ন সম্ভব নয় বলে মত বিশ্লেষকদের।

[34936]
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪১ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ১৬ হাজার ৮৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। 

এডিপির বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয় বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক নির্মাণ, সিটিস্ক্যান, এমআরআই মেশিনসহ সব ধরনের চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার জন্য। অর্থাৎ, চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নয়নে এই বরাদ্দ দেওয়া হয়। এডিপিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চলমান মোট প্রকল্পের সংখ্যা ২৮। 

এসব প্রকল্পের বিপরীতে মোট বরাদ্দ রয়েছে ১৬ হাজার ৮৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে এসব প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৫৯৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা; যা শতাংশের হিসাবে ৩ দশমিক ৭১। 

অর্থাৎ, প্রতি মাসে ১ শতাংশেরও কম কাজ হয়েছে। বাকি পাঁচ মাসে প্রায় ৯৬ শতাংশের বেশি কাজ শেষ করতে হবে; যা প্রায় অসম্ভব মনে করছেন পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) জুলাই-জানুয়ারি মেয়াদের অগ্রগতি প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এডিপিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুটি আলাদা বিভাগের অধীনে মোট ২৮টি প্রকল্প চলমান। 

এর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ১৫টি প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ রয়েছে ১১ হাজার ১৫৩ কোটি ১২ লাখ টাকা। অর্থবছরের সাত মাসে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে ৫ দশমিক ১৫ শতাংশ; যা আর্থিক হিসাবে ৫৭৪ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। 

[34877]

অপরদিকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের ১৩টি প্রকল্পের বিপরীতে চলতি অর্থবছর বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ৯৩৬ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। অর্থবছরের সাত মাসে ব্যয় হয়েছে ১৯ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। বাস্তবায়ন শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইএমইডির সাবেক সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়নের হার কম হওয়ার পেছনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা কম থাকা একটি সাধারণ কারণ।’ সঠিক প্রকল্প নির্বাচনের অভাব দুর্বল বাস্তবায়নের জন্য দায়ী উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রকল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে।’ 

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাত দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবে এর (বাজেট) বাস্তবায়নের হার সব সময়ই সবচেয়ে খারাপ। কেন তারা বছরের পর বছর খরচ করতে পারছে না, তা সরকারের পর্যালোচনা করা উচিত।’

তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে ৫ হাজার ৪৬১টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৮১০টি ঢাকা বিভাগে অবস্থিত। পাশাপাশি ৩৬টি স্পেশালাইজড হাসপাতালের মধ্যে ১৯টি ঢাকায় অবস্থিত হওয়ায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী লোকজন উন্নত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত ঢাকার ওপর চাপ বাড়ছে।

[34869]

নতুন করে অপারেশন প্ল্যান নেওয়া হচ্ছে -স্বাস্থ্য অধিদপ্তর : নতুন করে পরিকল্পনা ঢেলে সাজানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর। তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, একটা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আসা অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারকাজ পরিচালনা করছে। আপাতত সব ধরনের প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। তবে এরই মধ্যে আমরা যথেষ্ট সময় পেয়েছি গুছিয়ে নেওয়ার।

 এখন নতুন করে প্রকল্প পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। জনকল্যাণে যেসব প্রকল্পের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো বাস্তবায়নে কাজ করবে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে এখানে স্পষ্টভাবে বলতে হবে, এখানে কেউ কোনো লুটপাটের সুযোগ পাবে না। যেসব কাজ হবে, সব উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমেই কাজ দেওয়া হবে।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘অপারেশন প্ল্যান না থাকায় কেনাকাটা বন্ধ, অনেকের বেতনও বন্ধ, সবই বন্ধ রয়েছে। অপারেশন প্ল্যান না থাকায় স্বাস্থ্য খাতে মোট ৩৮টি সেক্টরের সবকিছুই বন্ধ আছে। 

অপারেশন প্ল্যান যত তাড়াতাড়ি পাশ হবে, তত তাড়াতাড়ি আমরা মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে পারব।’ তিনি আরও বলেন, ‘অপারেশন প্ল্যানের অভাবে আমরা যে বিভিন্ন ট্রেনিং, ওয়ার্কশপ, জিনিসপত্র ক্রয়, সাপ্লাই, স্টাফের বেতন (আউটসোর্সিং), মনিটরিং, সুপারভিশন, ওষুধপত্র কেনা- এসবের কোনো কিছুই হচ্ছে না। এমনকি এখন ন্যূনতম ওষুধের সরবরাহও নেই।

বিদেশে চিকিৎসা নেন ৮ লাখ রোগী : প্রতি বছর ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ ১৯টিরও বেশি দেশে ৮ লাখের বেশি রোগী উন্নত চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন। এর মধ্যে ১৭ শতাংশ হৃদরোগ, ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ কিডনি, ১১ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থোপেডিক সার্জারি, ১১ শতাংশ লিভার ও ক্যানসার, ৯ শতাংশ নিউরোলজি, ৬ শতাংশ গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি ও ইউরোলজি এবং ৪ শতাংশ গাইনোকলজি ও জেনারেল সার্জারির জন্য বিদেশমুখী। 

বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমসিএ) গবেষণায় এসব তথ্য উঠে আসে। গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, চিকিৎসকদের পর্যাপ্ত সময় না দেওয়া, ভুল রোগ নির্ণয় এবং অব্যবস্থাপনার কারণে আস্থা হারিয়ে রোগীরা বিদেশে যাচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিদেশে চিকিৎসা খাতে ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামোর উন্নয়ন প্রয়োজন।

চিকিৎসা ব্যয় বেশি বাংলাদেশে : দেশে স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৭৩ শতাংশ নিজেকেই বহন করতে হয়, যা শুধু আফগানিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় স্বাস্থ্য খাতের সরকারি বরাদ্দ অন্য দেশের তুলনায় কম, মাত্র ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ। 

[34875]

‘ইউনিভার্সেল হেলথ কভারেজ : প্রসপেক্ট অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস অব হেলথ অ্যান্ড নিউট্রিশন ইম্প্রুভমেন্ট’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে এ তথ্য উঠে আসে। গবেষণায় জানানো হয়, ভারতে চিকিৎসা ব্যয় মানুষের পকেট থেকে যায় ৪৯ দশমিক ৮০ শতাংশ, ভুটানে ১৮ দশমিক ৮০ শতাংশ, মালদ্বীপে ১৪ দশমিক ৩০ শতাংশ, নেপালে ৫১ দশমিক ৩০ শতাংশ, পাকিস্তানে ৫৭ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় ৪৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। তবে আফগানিস্তানে এ ব্যয় বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ৭৭ দশমিক ২০ শতাংশ। বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয়ে সবচেয়ে বেশি যায় ওষুধ কিনতে- ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ।

সেবা পেতে ঘুষ দিতে হয় : সম্প্রতি স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এতে বলা হয়েছে, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ পরিবার দুর্নীতির শিকার হয়েছে। গ্রামীণ এলাকায় এই হার ৪৫ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ৫১ শতাংশ। 

সেবা নেওয়ার সময় গড়ে ৬৮০ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে সেবা নিয়েছে ৩২ দশমিক ২ শতাংশ পরিবার, তবে দুর্নীতির হার জেলা সদর হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি, ৫২ দশমিক ৪ শতাংশ। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুষ দেওয়ার ঘটনা ১২ শতাংশ ছিল। 

[34875]

জরিপে উঠে এসেছে, ট্রলি বা হুইলচেয়ার সেবা নিতে গিয়ে ৫৬ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবার দুর্নীতির সম্মুখীন হয়েছে এবং খাদ্য পরিষেবায় দুর্নীতির হার ৬৬ দশমিক ৪ শতাংশ ছিল। 

সন্তান জন্মদান বা সি-সেকশনে গড়ে ২ হাজার ২৫৬ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। সরকারি হাসপাতালের ট্রলি বা হুইলচেয়ারের ঘুষ গড়ে ১৪১ টাকা এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের ঘুষ গড়ে ১৭ টাকা ছিল। এ ছাড়া সরকারি হাসপাতালগুলোর বাজেট বরাদ্দের সময় সেবা গুণমান বা রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়গুলো যথাযথভাবে বিবেচনা করা হয় না, যার ফলে সেবাব্যবস্থায় অদক্ষতা ও বৈষম্য তৈরি হচ্ছে।