ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) মাধ্যমে চালানো আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রজেক্ট অন্তর্বর্তী সরকার এক বছর মেয়াদ বাড়াতে যাচ্ছে। এক হাজার ২০৯ কোটি টাকার প্রকল্পটির মাধ্যমে নগর ও পৌরসভা এলাকায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়ে থাকে।
এ ছাড়া ঢাকা উত্তর, রাজশাহী ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনে দুটি এনজিওকে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ব্যয় বাড়িয়ে কাজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটিতে প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
শহুরে এলাকায় কিছু পরিষেবা, এনজিও এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত সেবা প্রদানকারীর মাধ্যমেও পরিচালিত হয়ে থাকে। যদিও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে, গ্রামীণ প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলো মূলত উপজেলা স্বাস্থ্যব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যা স্বাস্থ্য পরিষেবা সরবরাহের তিনটি নিম্নস্তরকে অন্তর্ভুক্ত করে।
এর মধ্যে রয়েছে ওয়ার্ড পর্যায়ে প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক, ইউনিয়ন পর্যায়ে ১৩১৬টি ইউনিয়ন সাব-সেন্টার এবং উপজেলা পর্যায়ে ৪২৪টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। শুধু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোই পাবলিক সেক্টরের পরিষেবা সরবরাহের ৩১ শতাংশ করে থাকে।
বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় একটি শক্তিশালী সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা রয়েছে। তবে শহরাঞ্চলে এই ধরনের ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য অভাব রয়েছে। শহরাঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার দায়িত্ব স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারের মধ্যে।
সীমাবদ্ধতা ও সুযোগ বিবেচনা করে, বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগ শহুরে স্থানীয় সংস্থা ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মধ্যে অংশীদারত্বের মাধ্যমে এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় শহুরে জনগণকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, ‘আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রজেক্ট-২য় পর্যায় (২য় সংশোধিত)’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় তিনটি প্যাকেজের অধীনে তিনটি পার্টনারশিপ এলাকায় প্রকল্পের বর্ধিত ১২ মাসের জন্য (২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত) স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হবে। এই কাজে নিয়োজিত এনজিওগুলোর সঙ্গে চুক্তির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ২০৯ কোটি ২৫ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে (জিওবি ২৪৫ কোটি এবং বৈদেশিক অর্থায়ন ঋণ ৯৪৭.৪৫৮৮ কোটি ও অনুদান ১৬.৮০ কোটি। এবং বাস্তবায়নকাল ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রকল্পের মাধ্যমে ১১টি সিটি করপোরেশন (নারায়ণগঞ্জ বাদে) এবং ১৮টি পৌরসভায় বসবাসরত ১.৭০ কোটি জনগণকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কথা।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দাবি অনুযায়ী প্রকল্পের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪.৭০ কোটি বিভিন্ন ধরনের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়েছে।
তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সেবাগুলো হলো- প্রায় ৩০.৩০ লাখ প্রসব পূর্ববর্তী এবং ৯.৩০ লাখ প্রসব পরবর্তী সেবা প্রদান, প্রায় ২৭.৩০ লাখ ‘আধুনিক পরিবার পরিকল্পনা’ সেবা প্রদান, দুই বছরের কম বয়সি শিশুকে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসেবে প্রায় ৮৮.৫০ লাখ টিকা প্রদান ইত্যাদি।
এ ছাড়া, প্রকল্পের আওতায় নরমাল ডেলিভারি এবং সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে প্রায় ১.৬০ লাখ শিশু জন্মগ্রহণ করেছে।
জানা যায়, নির্বাচিত এলাকার প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত পরিচালনার জন্য নির্ধারিত ছিল। পরবর্তীতে প্রথম সংশোধনের মাধ্যমে প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত অব্যাহত রাখা হয়। যা দ্বিতীয় সংশোধনের মাধ্যমে ১৮ মাস বৃদ্ধি করে ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা উত্তর, রাজশাহী ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় ১০ কোটি ৪৫ লাখ ১৫ হাজার ৫৯৪ টাকা ব্যয়ে দুটি এনজিওকে কাজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে- ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ইউনিটি থ্রো পপুলেশ সার্ভিসেস (ইউটিপিএস) ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৭৭ হাজার ৪৭৪ টাকা, বৃদ্ধির হার ৫৯ দশমিক ৬২।
একই এনজিও গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় কাজ করবে ২ কোটি ৩৫ লাখ ৫৪ হাজার ৫৪৭ টাকা, বৃদ্ধির ৪৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ এবং রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকায় নারীমৈত্রী ৪ কোটি ১৯ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৩ টাকা, বৃদ্ধির হার ৪৯ দশমিক ৪৯।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বের জনসংখ্যার ৫৫ শতাংশের বেশি মানুষ নগর এলাকায় বসবাস করে। ২০৫০ সাল নাগাদ এই হার ৬৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি নাগরিকদের স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন নিশ্চিতে কাজ করে নগর।
নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা একটি শহরের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। শহরগুলোয় বসবাসকারী ৪ দশমিক ২ বিলিয়ন লোকের বেশির ভাগই পর্যাপ্ত বাসস্থান এবং পরিবহন, স্যানিটেশন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বায়ুর গুণমান প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকাগুলো মেনে চলতে ব্যর্থ হয়।
এর সঙ্গে আছে দূষণের অন্যান্য রূপ, যেমন: শব্দ, পানি ও মাটি দূষণ; মাত্রাতিরিক্ত তাপনির্গমন, হাঁটা বা সাইকেল চালানো এবং সক্রিয় জীবনযাপনের জন্য জায়গার অভাব, যা শহরগুলোকে একটি অসংক্রামক রোগের মহামারির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে। শহরের ৪০ শতাংশ মানুষ বস্তিতে বাস করে।
যেখানে নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশনের অভাব রয়েছে। শহুরে এলাকার ৯১ শতাংশ মানুষ দূষিত বাতাসে শ্বাস নেয়। অস্বাস্থ্যকর, প্রক্রিয়াজাত খাবারের চাহিদা শহুরে জনগণের মধ্যে বেশি। নগরবাসী পরিবহন, রান্না প্রভৃতির জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভর করে।
যে কারণে ৬০ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়। এ কারণে আশপাশের গ্রামীণ এলাকার তুলনায় নগরবাসী বেশি তাপমাত্রা অনুভব করে। এসব নগরবাসীর স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব কারণে এইচআইভি/এইডস, যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া, ডেঙ্গু ও ডায়রিয়ার মতো সংক্রামক রোগ হৃদ্রোগ, স্ট্রোক, হাঁপানি, ক্যানসার, ডায়াবেটিস, বিষণ্নতা প্রভৃতি অসংক্রামক রোগ, সহিংসতা ও আঘাত, সড়ক দুর্ঘটনাসহ নানা রোগের তিনগুণ স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হয় শহরবাসী।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের গ্রামাঞ্চলে এখন বহু স্তরের শক্তিশালী গ্রামীণ প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাড়ি থেকে সেবা, কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন সাব-সেন্টার, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স। অন্যদিকে নগরে তেমন সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা কার্যত অনুপস্থিত।
তারা বলছেন, বাংলাদেশে ২০০৯ সালের আইনে নগর জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা) প্রতিষ্ঠানের হাতে দেওয়া হয়েছে। অথচ দীর্ঘ দেড় যুগে তাদের মধ্যে নগর স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কোনো উদ্যোগ বা সামর্থ্যরে প্রকাশ দেখা যায়নি।
বস্তুত নগরের বিপুল জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো স্বাস্থ্য ইউনিট, কারিগরি জ্ঞান, অবকাঠামো বা জনবল নেই। সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার স্বাস্থ্যসেবার জন্য কোনো পৃথক আর্থিক খাত নেই। এখানে নীতিনির্ধারক ও দায়িত্বশীলরা নগরে স্বাস্থ্যসেবা কার দায়িত্ব তা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করেছেন এবং দায়িত্বহীন আচরণ দেখিয়ে যাচ্ছেন।