ঢাকা শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

বুলেটের কাছে পরাজিত ব্যালট শক্তিশালী হচ্ছে

রুবেল রহমান
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৫, ০৯:৫৮ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ফ্যাসিবাদের বুলেটের কাছে হেরে যাওয়া ব্যালট আবারও শক্তিশালী হয়ে জনরায়ের অপেক্ষায়। এমনটাই মনে করছেন বিএনপি এবং জামায়াতের নেতারা। তবে সংস্কার আগে নাকি নির্বাচন? তা নিয়েও বাড়ছে দ্বন্দ্ব। বিএনপি বলছে, সংস্কারের নামে নির্বাচন বিলম্বিত হলে সুযোগ নেবে ফ্যাসিবাদী শক্তি। 

আর জামায়াত বলছে, সংস্কার না হলে নির্বাচনে প্রভাব খাটানোর ঝুঁকি থেকেই যাবে। ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতারাও একই কথা বলছেন। ফলে প্রশ্ন উঠেছে নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে সমঝোতা হলে তা কোন পথে? আর এই গুরুত্বপূর্ণ দুই ইস্যুতে বড় দুই দলের একমতে পৌঁছানো নিয়ে দেখা দিয়েছে বিরাট চ্যালেঞ্জ। 

[34961]

শেষ অবদি ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারলে নির্বাচন কবে হবে তা নিয়ে দেখা দেবে অনিশ্চয়তা। গত ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পলায়নের পর বাংলাদেশের রাজনীতি এক নতুন পর্বে প্রবেশ করেছে। অভ্যুত্থানের আগে স্লোগান ছিল ‘রাষ্ট্র সংস্কার লাগবে’। অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কার যে লাগবে, এ বিষয়ে ক্রিয়াশীল সব রাজনৈতিক দলই একমত।

প্রায় প্রতিটি সক্রিয় দল, দলনিরপেক্ষ বিভিন্ন সংস্থা ও বিশিষ্ট নাগরিকেরা সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে সংস্কারবিষয়ক প্রস্তাব জমা দিয়েছেন, মতামত দিচ্ছেন। সংবিধানের কোন কোন অংশ বদলাতে হবে, কী বাদ দিতে হবে, কী যোগ করতে হবে- এসব নিয়ে বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর মধ্যে মতভিন্নতা আছে। 

কিন্তু সংবিধানের সংস্কার যে করতে হবে, তা নিয়ে কোনো মতপার্থক্য নেই বললেই চলে। গত বছরের ৫ আগস্টের আগে সংবিধান সংস্কারের দাবি ছিল একটি অগ্রসর আকাক্সক্ষা বা প্রত্যাশা। কিন্তু বর্তমানে সেই দাবি আর প্রত্যাশার স্তরে নেই; এটি এখন বাস্তবায়নের পর্বে প্রবেশ করেছে। 

[34962]

সংস্কার আগে নাকি নির্বাচন- এ নিয়ে রাজনৈতিক দল ও দেশবাসী এখন ধোঁয়াশার মধ্যে আছে। এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কার বা নির্বাচনের কোনো রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়নি। এদিকে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রূপরেখা চাইছে। 

তারা বলছেন, একমাত্র রাজনৈতিক সরকারের পক্ষেই দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। নির্বাচন না হলে দেশের সংকট-অনিশ্চয়তা কাটবে না। সংস্কারের ব্যাপারে কারো কোনো আপত্তি নেই। তবে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে সরকারের উচিত দ্রুত নির্বাচনের দিকে যাওয়া। 

এরই মধ্যে সংস্কার কমিশনগুলের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশের পর গঠন হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এই কমিশন গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পতিত স্বৈরাচার এবং তাদের দোসর ছাড়া বাকি ২৬টি রাজনৈতিক দলের অন্তত একশ নেতার সঙ্গে বৈঠক করেছে। যাকে ঐতিহাসিক বৈঠক বলছে অন্তর্বর্তী সরকার। 

[34875]

জামায়াতসহ ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো বলছে সংস্কার শেষে নির্বাচন। হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতারও একই কথা বলছেন। এ অবস্থায় জনমনে প্রশ্ন উঠছে আগে সংস্কার নাকি নির্বাচন। নির্বাচন কবে হবে এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা না এলেও বিষয়টি এখন সব মহলে আলোচিত। 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এর মধ্যে সরকারের মেয়াদ চার মাস পেরিয়ে গেছে। সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের ওপর জোর দিচ্ছে। 

নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান, দুর্নীতি দমনসহ ১০টি বিষয়ে সংস্কারের জন্য সরকার কমিশন গঠন করেছে। বেশির ভাগ কমিশন ডিসেম্বর ৩১ নাগাদ সুপারিশমালা করবে। আর সংস্কার কমিশনের সুপারিশ পেয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারে সরকার।

[34936]

অন্যদিকে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষে বলা হচ্ছে, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, নির্বাচিত সরকার ছাড়া জনগণের প্রত্যাশা আর কেউ পূরণ করতে পারবে না। 

সে জন্য প্রথমত, প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। পরে সেই সংস্কার অনুমোদন করা হবে। তাই নির্বাচন যত তাড়াতাড়ি হবে, ততই দেশের জন্য মঙ্গল। এর মাধ্যমে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার আমলের বুলেটের কাছে হেরে যাওয়া নির্বাচনের ব্যালট শক্তিশালী হয়ে দেশে ফের গণতন্ত্রের সুবাতাস বইবে। 

দলীয় সূত্রমতে, এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে এখন অনড় বিএনপি। দেশের অন্যতম শীর্ষ এই দলটি যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে সরকারকে তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে বারবার। সময় নিয়ে গড়িমসি করলেও শেষে সরকারও আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদ নির্বাচন হবে- এমন আভাস দিয়েছেন। 

তাই দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণার মাধ্যমে নির্বাচন আদায় করতে সরকারকে কৌশলে চাপে রাখতে চায় দলটি। এরই মধ্যে হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম সভা। 

[34869]

বিএনপির তৃণমূলের নেতারা বলছেন, পুরো জাতি এখন মুখিয়ে আছে একটি সুন্দর নির্বাচনের অপেক্ষায়। নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির ১নং যুগ্ম আহ্বায়ক মুস্তাফিজুর রহমান ভুইয়া দিপু রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, জনগণকে কীভাবে ভোটকেন্দ্রে নেওয়া যায় আমরা সেই কাজটি করছি। 

কারণ দেশের মানুষ গত ১৬ বছর ভোট দিতে পারেনি। ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার অভ্যাস হারিয়ে ফেলেছে। তাদের ভোট কেন্দ্রে নেওয়াই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। মানুষ কীভাবে ভোট দেবে নির্বাচন কমিশন কি ব্যবস্থা নেবে। তার জন্য আমরা একটি রোডম্যাপ চাচ্ছি। আমরা চাই মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত হোক। 

মানুষ যাকে ভোট দেবে তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। তাতে তো কোনো অসুবিধা নেই। সংস্কার সংস্কার করে ভোট পিছিয়ে দেওয়ার তো কোনো যুক্তি নেই। হাসিনার আমলে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। তাই সবাই ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে মুখিয়ে আছেন।

[34857]

চলতি বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচন প্রশ্নে আশ্বস্ত হয়েও সরকারকে চাপে রাখতে চায় বিএনপি। সেই লক্ষ্যে সারা দেশে চলছে জনসমর্থন বাড়ানোর সভা-সমাবেশ। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, নির্বাচন নিয়ে টানবাহানা করলে মাথাচাড়া দেবে অপশক্তি, ঝুঁকিতে পড়তে পারে গণতন্ত্র।

সাধারণ নির্বাচনের জন্য সরকার যত বেশি সময় নেবে ফ্যাসিবাদের দোসররা তত বেশি অস্থিতিশীলতা তৈরি করার চেষ্টা করবে। যেসব সংস্কার আমাদের প্রয়োজন মধ্যমেয়াদি-দীর্ঘমেয়াদি সেটার জন্য একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারই প্রয়োজন। সরকার আশ্বাস দিয়েছে ডিসেম্বরের মধ্যেই একটি নির্বাচন দেবে। 

আলাপ-আলোচনায় আমাদের মধ্যে হয়েছে- শিগগিরই একটি নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করবে সরকার। যেসব সংস্কারে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছতে পারব সেসব নিয়ে আমাদের একটি কমিটমেন্ট থাকবে, প্রতিশ্রুতি থাকবে, অঙ্গীকার থাকবে, আমাদের নির্বাচনি মেনিফেস্টুতে তার একটা রিফ্লেকশন হবে। 

তখন জাতির কাছে আমরা ওয়াদাবদ্ধ থাকব। যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসবে তাদের একটা বাধ্যবাধকতা থাকবে ওগুলো বাস্তবায়নের জন্য। আর জনগণের মধ্যে যখন ঐক্য থাকে তখন সেগুলো বাস্তবায়ন সহজ হয়। 

[34963]

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে তার দল। নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার না হলে সংকট কাটবে না বলেও শঙ্কা তার। বলেন শঙ্কা আছে ফ্যাসিবাদের বিদায় হয়েছে এটা ঠিক কিন্তু এই মানসিকতার লোক তো সমাজে এখনো বিদ্যমান। 

গত ১৫ বছরে ৩টা নির্বাচনে আমি ডামি, দিনের ভোট রাতে করা, ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংসহ নানা পদ্ধতি অবলম্বন করেছে, আওয়ামী লীগের সব তো চলে যায়নি। তা ছাড়া সেই চরিত্রের লোক তো সমাজে আছেই। স্বভাবগত মজ্জাগত চরিত্র তো বিদায় নেয় নাই। 

তারা কিন্তু এখনো সমাজে ঘাপটি মেরে আছে, বলা তো যায় নাÑ হীন, দলীয় স্বার্থে যখন মনে করবে এই আসনে আমাকে জিততেই হবে তখন তারা বল প্রয়োগ করবে। পেশিশক্তি ব্যবহার করল, পুলিশের ওপর হামলা করল, ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যেতে দিল না, কেটে ছিঁড়ে নিয়ে গেল।

[34933]

তিনি আরও বলেন, ফ্যাসিজম তো একটা চরিত্র, সেই চরিত্র যে কেউ যেকোনো সময় মনে ধারণ করতে পারে। এ জন্য আমরা চাই সিস্টেমটা এমন হোক যাতে কেউ ভোটে প্রভাব খাটাতে না পারে। তার পছন্দের প্রার্থীকে সে যাতে ভোট দিতে পারে। এর জন্যই সংস্কার প্রয়োজন। 

আমরা ভোটের জন্য দিনক্ষণ ঠিক করে দেওয়ার পক্ষে না। নির্বাচনি লড়াইয়ে নানা সমীকরণ আর ভোটের রসায়ন বুঝে শক্তিশালী দল হিসেবে জামায়াত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায় বলেও জানান দলটির এই নেতা। 

বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান লায়ন মো. ফারুক রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সংস্কার প্রয়োজন আছে তবে তার সঙ্গে জরুরিভিত্তিতে নির্বাচনটাও প্রয়োজন। সংস্কারের নামে সময়ক্ষেপণ করাটা মোটেও ঠিক হবে না। ব্যক্তি বদলায় কিন্তু চেয়ার বদলায় না। এই সংস্কারের পেছনে দুরভিসন্ধি আছে কি না- তা এখনই বলা মুশকিল। 

আমরা যারা রাজনীতি করি তারা সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারি না সেসব পর্দার আড়ালের খেলা। তবে পরে ইতিহাস দেখে বুঝতে পারি, তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পারি না সেসব খেলা। যখন বুঝতে পারি তখন আর কিছু করার থাকে না। তবে কাউকে বেশি সুবিধা দেওয়ার জন্য সংস্কার সময়ক্ষেপণ করা হলে তা কারো জন্যই মঙ্গলজনক হবে না।