ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে শুরু হয়েছে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য। পট পরিবর্তনের পরে রাজনৈতিক মাঠ দখল নিয়ে দুটি দলের মধ্যে বক্তব্য ঘিরে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। মূলত রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও দখল নিয়ে এই বিরোধের শুরু হয়।
বিএনপির বিরুদ্ধে সারা দেশে ‘দখলদারিত্বের’ অভিযোগ আনেন জামায়াতের নেতাকর্মীরা। এরপর জামায়াতের বিরুদ্ধেও দখলের পাল্টা অভিযোগ করেন বিএনপির বিভিন্ন নেতাকর্মী। দুই দলের এমন কার্যক্রমে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে- ত্রয়োদশ নির্বাচনে সরকারে কে আসছে? জামায়াত, নাকি বিএনপি।
বিএনপি-জামায়াতের দ্বন্দ্ব আগেও ছিল। তবে এবারের মতো চরম বিষোদগার নিকট অতীতে দেখা যায়নি। দীর্ঘদিনের দুই মিত্র দলের এই তিক্ততা ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, এ ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি দুই দলের নীতিনির্ধারকেরা।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিগত দিনে দেখেছি, বিএনপির ঘাড়ে ভর করে টিকে ছিল জামায়াতে ইসলামী। জামায়াত অস্তিত্ব ধরে রাখতে বিএনপির সঙ্গে মিশে ছিল। এখন সেই জামায়াত সরকার গঠনের পাঁয়তারা করছে। যদি তারা সরকার গঠনের চেষ্টা করে, সেটা হতে পারে আলাদা ব্যাপার। একটা রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা এটা চাইতেই পারে। অন্যদিকে বিরূপ মন্তব্য করছেন বিশ্লেষকেরা। তারা বলছেন, তবে এমন সিদ্ধান্ত জামায়াত-বিএনপির জন্য ভালো কিছু বয়ে আনতে পারবে না।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সংসদ সদস্য এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘আগামী দিনে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন ছাড়া কেউই সরকার গঠন করতে পারবে না। ক্ষমতায় আসতে হলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন অবশ্যই লাগবে।’
হামিদুর রহমান আযাদ আরও বলেন, ‘রাষ্ট্র সংস্কার ও সরকার গঠনে জামায়াতে ইসলামী ৪১ দফা প্রণয়ন নিয়ে মাঠে কাজ করছে। তা ছাড়া আগামী নির্বাচনের জন্য আমাদের জনমত গঠনের বছর হলো ২০২৫ সাল। নির্বাচনি কাজেই সময়টি সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পাবে আমাদের কাছে।
শেখ হাসিনার পতনের পর দীর্ঘ ২৫ বছরের রাজনৈতিক মিত্রদের মধ্যে হঠাৎ কেন এমন বৈরী সম্পর্ক তৈরি হলো, তা নিয়েও নানা ধরনের আলোচনা রয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘জামায়াত নির্বাচন নিয়ে বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে যে ধরনের কথা বলে আসছে, তাতে মনে হচ্ছে তারা সরকার গঠনের পাঁয়তারা করছে। তবে বিএনপির রাজনীতির সাথে জামায়াতের রাজনীতি বিবেচনা করলে হবে না। জামায়াতের সরকার গঠনের ক্যাপাসিটি আছে কি না, সেটা আগে জানতে হবে। তা ছাড়া দেশের মানুষ তাদের ভালোভাবে নেয় না।’
অনেকের আশঙ্কা, অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘ মেয়াদে শাসনক্ষমতায় থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে তারা গণঅভ্যুত্থানের নায়ক ছাত্রনেতাদের কারো কারো বক্তব্য ও তৎপরতার সঙ্গে জামায়াতের যোগসূত্র দেখতে পাচ্ছেন। কারণ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে জামায়াতের এক ধরনের প্রভাব আছে বলে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
বিএনপির কর্মকাণ্ডে জনগণ ক্ষুব্ধ: বিএনপির কর্মকাণ্ডে জনগণ ক্ষুব্ধ হওয়ায় জামায়াতের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এতে বিএনপির ঈর্ষা হচ্ছে। বাম ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি ভেতরে ভেতরে জামায়াতবিরোধী এক ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে।
এ বিষয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, দুই দলের সম্পর্কের মধ্যে তিনি নেতিবাচক কিছু দেখছেন না। সম্পর্ক ঠিক আছে। তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি ও পরিবেশ বিবেচনা করে সবার কথা বলা উচিত। আমরা এমন বিভাজন চাই না, যাতে আওয়ামী লীগ কোনো ধরনের সুযোগ তৈরি করতে পারে। যারা এসব বিবেচনা করে কথা বলেন না, তারা নানা বক্তব্য দিতে পারেন।’
এদিকে রাজনৈতিক বোদ্ধাদের বিশ্লেষণ হচ্ছে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন মিত্রতার সম্পর্কে আবদ্ধ ছিল। এতে আওয়ামীপন্থিরা ‘বিএনপি-জামায়াত’ একটি রাজনৈতিক অভিধান চালু করেছিল, যা থেকে প্রতীয়মান হতো যে বিএনপি ও জামায়াত এক ও অভিন্ন সত্তা, যা সত্য নয়।
নির্বাচন নিয়ে দুই মেরুতে দুই দল: সংসদ নির্বাচন কবে হবে, বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়। কিন্তু নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে বিএনপি যতটা সরব, জামায়াতও ততটাই সরব থাকলেও এ ক্ষেত্রে কৌশলে কাজ করছে জামায়াত। এ বিষয়ে জানতে চাইলে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল সম্প্রতি বলেন, ‘যাদের জনসমর্থন নেই, তারা এ ধরনের বিভিন্ন চিন্তা-ভাবনা করে। আমি কোনো দলের নাম বলছি না। যাদের ভোটে জয়ের সামর্থ্য নেই, তারাই আবার নির্বাচন করবে ও সরকার কঠন করবে।’
টানাপোড়েন চলছেই, কেন: ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে বিএনপি, জাতীয় পার্টি (এরশাদ), জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট নিয়ে চারদলীয় জোট গঠিত হয়। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল চারদলীয় জোটের কলেবর বেড়ে হয় ২০ দলীয় জোট।
আওয়ামী লীগের আমলে স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দুই দলের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। ২০২২ সালের আগস্টে জামায়াতের মজলিসে শুরার একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ২০ দলীয় জোট আর কার্যকর নেই।
হঠাৎ সরগরম রাজনৈতিক মাঠ: সরকারের বৃহত্তম সমর্থক দল বিএনপির নেতৃত্ব প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গিয়ে চলতি বছর শেষের আগেই নির্বাচনের দাবি জানানোর পরে হঠাৎই সরগরম হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মাঠ। জামায়াত ও বিএনপি পৃথকভাবে সরকার গঠনের পাঁয়তারা করছে, যেটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা উঠেছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমির মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন জানান, ‘বিপ্লব ও অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করার সুগভীর চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে। তাই দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই এদের কঠোর হাতে দমন করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
প্রয়োজনে সবাইকে একজোট হয়ে কাজ করতে হবে। তা ছাড়া দেশের ও জনগণের বৃহৎ স্বার্থে আমরা ছিলাম এবং আছি। জামায়াতে ইসলামী দেশ ও জাতির কল্যাণে বিরামহীনভাবে কাজ করে আসছে এবং করে যাবে।’
বিএনপি ও জামায়াতের বর্তমান সম্পর্ক বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ মনে করেন, ‘বাংলাদেশের ভোট মূলত বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় জামায়াত সেই ফাঁকা জায়গায় একটি শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রকাশ করতে চাইছে। এ কারণেই তারা এখন বিএনপির বাইরে গিয়ে অবস্থান নিতে চাইছে হয়তো। তা ছাড়া বাংলাদেশে ভোটের রাজনীতি অন্যরকম এবং আলাদা। সেটা ভোট হলেই বোঝা যাবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক দল হিসেবে সরকার গঠন করতে পারে।
তবে সংস্কারের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সামনে রেখে বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করছে। আগামী দিনে জনপ্রত্যাশিত সমাজ বিনির্মাণে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ধারণ ও বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শ্রদ্ধা ও গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন আচরণ ও কর্মসূচি অনুশীলন করা অপরিহার্য। অন্যথায় সংঘাত কিংবা সহিংসতার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যাবে।’
জামায়াত নিয়ে বিএনপির মাথাব্যথা নেই: বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সমালোচনা করে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবেদিন ফারুক রূপালী বাংলাদেশকে বলেছেন, ‘গত ৫৪ বছরে কোনো দিন দেখিনি স্বাধীনতা দিবসে একটা মিছিল করতে।
যখন অন্তর্বর্তী সরকার অক্টোবর-নভেম্বরে একটি নির্বাচনের কথা বলা শুরু করল, তখন আপনাদের মুখে রাম রাম। আবার শুনি স্থানীয় সরকার নির্বাচন। সংস্কারের পর নির্বাচন কীসের ইঙ্গিত? স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় কোথায় ছিলেন। কোথায় ছিলেন ১৬ বছর? এখন শুনতেছি সরকার গঠনের পাঁয়তারা করছে। আপনাদের কি জনসমর্থন আছে যে আপনারা সরকার গঠনের চেষ্টা করেন?’
বিএনপি নেতা জয়নুল আবেদিন ফারুক বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা দেশের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, তাদের আজকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিত।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি জামায়াতে ইসলামীর অতীত কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে বলেন, ‘যারা একাত্তরে স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, তারা এখন কীভাবে নিজেদের দেশপ্রেমিক দাবি করে? ১৬ বছর ধরে আপনারা কী করেছেন? দেশের উন্নয়নে কী ভূমিকা রেখেছেন? এসব প্রশ্নের উত্তর জাতি জানতে চায়।’
আওয়ামী লীগের সঙ্গে একাত্মতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী আপনারাও আওয়ামী লীগের সঙ্গে একাত্মতা করে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন, পরিণামে কী পেয়েছেন? আপনাদের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মেরেছে; সেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সঙ্গ দিয়ে সময়ক্ষেপণ করে আপনারা সরকার গঠনের চেষ্টা করতে থাকুন, দেশের মানুষ আপনাদের সুবিচার করবে।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক সেলিমুজ্জামান সেলিম রূপালী বাংলেদেশকে বলেন, জামায়াত সরকার গঠনের যে পাঁয়তারা করছে সে ভাবনা ভুল। তাদের বিবেচনা করা উচিত, সংসদ নির্বাচনে সারা দেশে প্রার্থী দেওয়ার মতো সংগঠনিক শক্তি আছে কি না। তা ছাড়া একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা সারা জীবন সরকার গঠনের চেষ্টা করতে পারে, এতে বিএনপির মাথাব্যথা নেই।
আপনার মতামত লিখুন :