উচ্চশিক্ষা স্তরে স্নাতক পর্যায়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত ২০১৪ সালে বাধ্যতামূলক করা হয় ১০০ নম্বরের ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’।
বাংলাদেশের ইতিহাসের নামে এই কোর্সে বিগত সরকারের আমলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিয়ে একাধিক অধ্যায়।
তবে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর অনেকেই বলছেন, আওয়ামী লীগ আমলে শেখ হাসিনা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যবইয়ে যুক্ত করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান নিয়ে বিভিন্ন পাঠ।
এতে একপাক্ষিকভাবে পড়ানো হয় বাংলাদেশের ইতিহাস। অনেকটা মুজিববন্দনার নামে ছাত্রছাত্রীদের মন-মগজে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মতবাদ।
গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা কারিকুলাম থেকে অতিরিক্ত মুজিববন্দনা বাদ দেওয়া হলেও উচ্চশিক্ষা স্তরের কারিকুলামে এখনো তা রয়েছে গেছে।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) শিগগিরই এই কোর্স বাধ্যতামূলক থেকে ঐচ্ছিক ঘোষণা করবে বলে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ানো হচ্ছে ‘হিস্টরি অব দ্য ইমারজেন্স অব বাংলাদেশ’ কোর্সটি।
এই কোর্সের সূচিতে এখনো রয়েছে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-দ্য ফাদার অব দ্য নেশন অ্যান্ড আর্লি ডে’স অব বাংলাদেশ’।
আর কোর্সটিতে পাঠ্য হিসেবে বইয়ের নাম সুপারিশ করা হয়েছে আওয়ামী লীগ আমলের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের একটি বই।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ানো হচ্ছে ‘হিস্টরি অব দ্য ইমারজেন্স অব বাংলাদেশ’ কোর্স। এই কোর্স কনটেন্টে পড়ানো হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, সরকার গঠন, বাংলাদেশের স্বীকৃতিতে বঙ্গবন্ধুর অবদান, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, ৭ মার্চের ভাষণ, ছয় দফা’ ইত্যাদি বিষয়ে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ‘হিস্টরি অব লিবারেশন ওয়ার অ্যান্ড ইমারজেন্স অব বাংলাদেশ’ কোর্সের পাঠ্যসূচিতে রাখা হয়েছে শেখ মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনী।
কোর্স কনটেন্টে রয়েছে ‘স্বাধীনতাযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদান ও নেতৃত্ব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের শাসনাকাল, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশ পুনর্গঠনে শেখ মুজিব’ ইত্যাদি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েও বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো হচ্ছে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’। আর এই কোর্সেও এখনো থেকে গেছে শেখ মুজিবের অতিরিক্ত বন্দনা।
ইতিহাস বিভাগের একাডেমিক সিলেবাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রথম বর্ষে কোর্স কনটেন্টে পড়ানো হচ্ছে, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা, আগরতলা মামলা, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা, স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন’ ইত্যাদি বিষয়ে।
এছাড়া শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক চিন্তা, সমাজভাবনা ও আদর্শের ওপর এমফিল ও পিএইচডি কোর্স চালু করে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৯ সালে বাংলা বিভাগের সিলেবাসের পাঠ্য তালিকায় যুক্ত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’।
বাংলা বিভাগের ‘আত্মজৈবনিক রচনা’ শিরোণামে বিএনজি-২২৬ নম্বর কোর্সের অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর লেখা এই আত্মজীবনী ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থীদের থেকে পড়ানো হবে বলে জানা গেছে।
এর আগে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর বাংলা বিভাগের সিলেবাস প্রণয়ন কমিটির সভায় ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পাঠ্য করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫৪তম একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পাঠ্য হিসেবে পড়ানোর অনুমোদন দেওয়া হয়।
‘আত্মজৈবনিক রচনা’ শিরোণামে বিএনজি-২২৬ নম্বর কোর্সের অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর লেখা এই আত্মজীবনী ছাড়াও তিন ক্রেডিটের এই কোর্সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবন স্মৃতি’, মীর মশাররফ হোসেনের ‘আমার জীবনী’ ও রাজসুন্দরী দেবীর ‘আমার জীবন’ পাঠ্য হিসেবে পড়ানো হয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পড়ানো হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের তৃতীয় বর্ষের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, আগের সরকারের পক্ষ থেকে এই কোর্সকে বাধ্যতামূলক করার পর থেকে অনেক শিক্ষক এই কোর্সের মাধ্যমে ভিন্ন উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টা করেছেন।
এছাড়া দেশের প্রথম সারির সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন, চিন্তাধারা, ভাষণ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং আদর্শের ওপর ব্যাপক গবেষণার উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৭ সালে।
এ লক্ষ্যে বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনস্টিটিউট, ডিপার্টমেন্ট ও চেয়ার প্রতিষ্ঠা করা হবে।
এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু ইনস্টিটিউট অব কম্পারেটিভ লিটারেচার অ্যান্ড কালচার নামে একটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এছাড়া ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধুর নামে চেয়ার এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে আইটি পার্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ডিপার্টমেন্ট ১৯৯৯ সালে বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রতিষ্ঠা করেছে। চেয়ার প্রতিষ্ঠার সূচনা থেকে ইতিহাস বিভাগ বঙ্গবন্ধুর ওপর বিভিন্ন গবেষণা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করে আসছিল আওয়ামী লীগ আমলে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ এ বিষয়ে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা এই কোর্স কোনো শিক্ষার্থীকে চাপিয়ে দিতে চাই না। উচ্চশিক্ষা স্তরে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ কোর্স শিগগিরই ঐচ্ছিক ঘোষণা করে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে।
আমরা শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার মধ্যে কোনো ‘বায়াসনেস’ (পক্ষপাতিত্ব) রাখব না।’
প্রসঙ্গত, চলতি শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যবই থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত মুজিববন্দনা।
পাশাপাশি বাংলাদেশের ইতিহাসে যার যে অবদান ছিল, তা তুলে আনা হয়েছে সুস্পভাবে। পাঠ্যবই প্রণয়ন ও মুদ্রণের দায়িত্বে থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেন, ইতিহাসে যার যে অবদান ছিল, তা পাঠ্যবইয়ে তুলে আনা হয়েছে।
এখানে কাউকে বড় করে কিংবা কাউকে ছোট করে দেখা হয়নি।
এছাড়া সরকারপতনের পর বঙ্গবন্ধু পরিবারের নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম পাল্টে দিচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে প্রায় অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম পাল্টে দেওয়া হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :