মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প যেন মাদক ও অস্ত্রের স্বর্গরাজ্য। সেখানে অন্তত ১২ থেকে ১৫টি স্পটে প্রকাশ্যে চলছে মাদকের বেচাকেনা।
বুনিয়া সোহেল, চুয়া সেলিম, বড় রাজা, পিচ্চি রাজা টুনটুন ও মনুসহ শীর্ষ অন্তত ২৫ থকে ৩০ জন মাদক কারবারি এসব স্পট নিয়ন্ত্রণ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
দীর্ঘদিন ধরে বিহারি অধ্যুষিত এ ক্যাম্পে মাদকের এমন ভয়াবহতার বিষয়টি উল্লেখ করে স্থানীয়রা জানান, ক্যাম্পের মাদক কারবারি বন্ধে নিয়মিত অভিযান ও কড়া নজরদারি প্রয়োজন।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সাবেক একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা এসব অবৈধ কারবারের পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছিলেন বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্যাম্পের মাদক সিন্ডিকেট ভাঙতে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে হবে।
পাশাপাশি ক্যাম্পে মাদক ঢোকা বন্ধে আশপাশে নিয়মিত গোয়েন্দা নজরদারির পরামর্শ তার।
সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, জেনেভা ক্যাম্পে মাদকের প্রবেশ বন্ধ বা প্রতিরোধ করা গেলে মোহাম্মদপুরসহ আশপাশ এলাকায় অপরাধ অনেক কমে আসত।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প এলাকায় দিনেদুপুরে প্রকাশ্যেই চলে মাদক বিক্রি।
প্রকাশ্যে গাঁজার প্যাকেট রাখলেও কেউ চাইলেই ইয়াবা, হেরোইন ও ফেনসিডিলও সরবরাহ করা হয়।
এমন অসংখ্য স্পটের সন্ধানের তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। মাদক ও অস্ত্র কারবারিদের তালিকা হালনাগাদ করে চালানো হবে কঠোর অভিযান।
স্থানীয়রা জানান, এক নম্বর সেক্টরের বেলালের গলিতে ইয়াবা-হেরোইনের স্পট। নিয়ন্ত্রণ করে চুয়া সেলিমের অনুসারীরা। সেক্টর দুইয়ের শাকিল বুকসের সামনে হেরোইন-গাঁজার স্পট। নিয়ন্ত্রণ করে পিচ্চি রাজা।
সেক্টর সাতের আলফালা মেডিকেলের গেটের স্পট নিয়ন্ত্রণ করেন বুনিয়া সোহেল, টুনটুন ও মুক্তার লালা। তিন নম্বর সেক্টরের এনএলজে হাইস্কুল গেট স্পটে হেরাইন বিক্রি করেন শরীয়তপুরী বাবু।
পাঁচ নম্বর সেক্টরের জয়নাল হোটেলের সামনের স্পটে ইয়াবা-হেরোইন বিক্রি করেন গালকাটা মনু।
স্থানীয়রা বলছেন, গত ১৫ বছরে সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও কাউন্সিলর সৈয়দ হাসান নূর ইসলাম রাষ্টন ক্যাম্পের ২৫ শীর্ষ মাদক কারবারির মাধ্যমে মাদক ও অস্ত্রের রমরমা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেছেন।
থানা পুলিশও তাদের ভয়ে ক্যাম্পের ভেতরে অভিযানে যেত না। উল্টো মাসিক চাঁদা নিয়ে মাদকের কারবারে সহায়তা করেছে।
ক্যাম্পবাসীদের সংগঠন এসপিজিআরসির নেতারা বলছেন, টাকার প্রলোভনে নানক ও রাষ্টন মাদক কারবারে তাদের জড়িয়েছে।
এসপিজিআরসির সভাপতি এম শওকত আলী বলেন, এখানে মাদকের আখড়া হয়ে গেছে।
এই আখড়া কে সৃষ্টি করল? সেলসম্যান হিসেবে ব্যবহার করে আমাদের ক্যাম্পকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কেউ কেউ অস্ত্রের কারবারও করে বলে শোনা গেছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে পুরো ক্যাম্পে মাদকের এই ব্যবসা করছেন আলফালাহ মডেল ক্লিনিকের সামনে ভুইয়া সোহেল।
সেই মাদকের এই স্পট নিয়ন্ত্রণ করছে তার ভাই, রানা, টুনটুন, কালো, এরা ৩ জন হচ্ছে ভুইয়া সোহেল এর ভাই। ৭নং সেক্টরে তারাই এই অবৈধ্য ব্যবসা দেখছেন।
এদিকে সেক্টর-৫ এর পেছনের সাইডে মানে হুমায়ুন রোড-৬ এর লাইন নিয়ন্ত্রণ করছে মনির, হাসিব, সনু, হিরা। এরা ৪ ভাই একই পরিবারের।
অন্যদিকে বিল্লাল, ইমতিয়াজ, আকরামসহ আরও অনেকে হেরোইন, গাঁজা, ইয়াবা বিক্রি করে প্রকাশ্যে।
পুলিশি সূত্র জানায়, পাকা ক্যাম্পের ১নং সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করছে পিচ্চি রাজা, বড় রাজা, শাহজাদা, আদিল, ফাইজানসহ আরও অনেকেই।
সেক্টর-২ নিয়ন্ত্রণ করছে চুয়া সেলিম, উলটা সালামসহ বেশকিছু মাদক কারবারিরা। কাঁচা বাজারের সাইড নিয়ন্ত্রণ করছে সৈয়দ পুরিয়া গ্রুপ বাবু, নাওশাদ, বামসহ আরও অনেকেই।
সূত্র জানায়, এদের প্রশাসনিকভাবে সহায়তা দিচ্ছে মোল্লা জাহিদ। বিশেষভাবে জেনেভা ক্যাম্পের ইয়াবার মূল ও প্রধান ডিলার হচ্ছে দিলদার। তার পিতার নাম হাশেম।
বাসা নম্বর সেক্টরের ২, ব্লক, বি, জেনেভা ক্যাম্প। কিন্তু বর্তমানে দিলদারের পরিবার অর্থাৎ মা-বাবা ঘাটার চরে বসবাস করছেন।
ক্যাম্পের ভেতরে দিলদারের ইয়াবার চালান, তার মামা খুরশিদ ওরফে নাল্লি খুরশিদ, পিচ্চি রাজার শ্বশুরের মাধ্যমে পুরো ক্যাম্পে বিতরণ হচ্ছে।
বিশেষ সূত্র জানায়, ইয়াবা দিলদারের পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে ভালো সখ্য রয়েছে এবং মোহাম্মদপুর থানায় দিলদার পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করে।
এ ছাড়া থানা ম্যানেজ করছে শান্ত ওরফে ইয়াবা শান্তু, জিয়াউদ্দিন জিয়া, জিয়া উদ্দিন রাজু, নানকের পোশা কামলা ও কানা জিয়া।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, রাজনৈতিক চাপেই এতদিন ক্যাম্পের ভেতরে অভিযান চালানো সম্ভব হয়নি। তবে এখন ধারাবাহিক অভিযান শুরু হবে।
ক্যাম্পকে মাদকমুক্ত করতে বাসিন্দাদের সহযোগিতা চেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এ বিষয়ে র্যাব-২ অধিনায়ক খালিদুল হক হাওলাদার বলেন, গত ১৫ বছরে জেনেভা ক্যাম্পকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে।
এই ব্যবহারের কারণে তারা বেপরোয়া হয়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। আর এর প্রভাব শুধু মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পেই সীমাবদ্ধ থাকেনি।
মোহাম্মদপুরকেন্দ্রিক এলাকাগুলোতেও আতঙ্ক তৈরি হয়।
আপনার মতামত লিখুন :