রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দুর্নীতির মাধ্যমে রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়া এক ব্যক্তির নাম আবুল কালাম আজাদ। ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার গালুয়া ইউনিয়নের এক সাধারণ পরিবারের ছেলে কালাম, একসময় ছিলেন বেকার। ২০১৪ সালে সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমুর ব্যক্তিগত সহকারী হওয়ার পর থেকেই তার ভাগ্য বদলাতে থাকে। ক্ষমতার আশ্রয়ে গড়ে তোলেন এক ভয়ংকর দুর্নীতির সাম্রাজ্য।
সাধারণ মানুষ তাকে ‘আমুর ছেলে’ নামে চিনলেও, এই পরিচয়ের আড়ালে লুকিয়ে ছিল ভয়ংকর সব অপকর্ম। ঝালকাঠির সব ঠিকাদারি কাজ হতো আজাদের ইশারায়। আমুর আস্থাভাজন হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। নামে-বেনামে গড়েছেন বিপুল সম্পদ। এমনকি ইউপি নির্বাচনে বাণিজ্য, ভোটবাণিজ্য, সিন্ডিকেট বাণিজ্যসহ নানা অপকর্মের মাধ্যমেও হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি টাকা।
জানা গেছে, রাজাপুরের রাজনীতি, ঠিকাদারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগ, সরকারি প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ, টেন্ডার বাণিজ্য, প্রতিপক্ষের ওপর হামলা- তার ক্ষমতার অপব্যবহারের তালিকা ছিল সীমাহীন। তিনি এলাকায় নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন, তার স্বার্থ রক্ষার জন্য ভয় দেখানো, মারধরসহ নানা অপরাধে জড়িত ছিল। এ ছাড়া স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীদের দমনে বাসাবাড়িতে ভাংচুরের নেপথ্যে ছিলেন আমুর এই পিএস আবুল কালাম আজাদ।
স্থানীয় একটি সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার ধানমন্ডির লেকের পাশে ২/এ রোডের ৫০ নম্বর বাড়ির একটি বহুতল ভবনে তার একটি ফ্ল্যাট (৪ বি) রয়েছে। যার বাজার মূল্য আনুমানিক ৫ কোটি টাকা। এ ছাড়াও তার নামে-বেনামে ঢাকায় বাড়ি ও গাড়ি রয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আমির হোসেন আমুর পিএস আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করলে তার অবৈধ সম্পদ বেরিয়ে আসবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার এক ব্যক্তি জানান, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আমির হোসেন আমুর নাম ভাঙিয়ে সওদাগর কুরিয়ার সার্ভিস পরিচালনা করেন আমুর পিএস আজাদ। এই কুরিয়ার সার্ভিসের আড়ালে তিনি চালাতেন মাদকের রমরমা ব্যবসা। সওদাগরে আমুর নাম থাকায় তার টিকিটিও ধরতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
তিনি জানান, কিছুদিন পূর্বে কুড়িগ্রাম শহরের কলেজ মোড় এলাকায় সওদাগর এক্সপ্রেস লিমিটেড কুরিয়ার সার্ভিসের অফিসের ভেতর থেকে ফেনসিডিল ও ভারতীয় প্রসাধনী সামগ্রী জব্দ করে পুলিশ। কার্টনে সাদা পলিব্যাগে মোড়ানো ১৫০ বোতল ফেনসিডিল জব্দ করে পুলিশ। তবে পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেনি।
জানা গেছে, ২০১৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে জয়ী করাতে চান মিয়া নামে এক প্রার্থীর বাড়িতে হামলা চালানো হয়। টাকা দিয়ে ভোট কেনার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। শুধু নির্বাচন নয়, চাকরি দেওয়ার নামেও তিনি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
বিভিন্ন স্কুল, মাদ্রাসায় নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করেছেন। গালুয়া ইউনিয়নের এক মাদ্রাসার শিক্ষককে সরিয়ে নিজের ভাইয়ের স্ত্রীকে নিয়োগ দেন তিনি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ভয় দেখানো ও হামলা চালানোর।
২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত এক এজেন্টকে মারধর করে কেন্দ্র থেকে বের করে দেন তিনি। টিপু মিয়া নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা জানান, শুধু নির্বাচনে বিরোধী পক্ষের এজেন্ট থাকার কারণে তাকেও মারধরের শিকার হতে হয়। এমনকি, মুজাম্মেল মাওলানা নামে এক ব্যক্তির ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন, শুধু তিনি বিএনপি করেন বলে।
গালুয়া ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য চান মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে আমার বাড়িতে হামলা চালিয়েছেন আবুল কালাম। টাকার বিনিময়ে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে নির্বাচনে জয়লাভ করিয়েছিলেন তিনি। আমার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দিয়ে হয়রানি করেছেন। এমন কিছু নেই, যা তিনি করেননি। যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ হলে টাকার বিনিময়ে তিনি তার পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দিতেন।
আবুল কালামের নিজ এলাকার টিপু মিয়া নামে একজন জানান, ২০১৪ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপক্ষের এজেন্ট হওয়ার কারণে তাকে পিটিয়ে বের করে দেন কালামরা।
আব্দুল আজিজ আকন নামে একজন জানান, জীবনদাশকাঠির একটি মাদ্রাসায় একজন শিক্ষককে সরিয়ে ভাইয়ের স্ত্রীকে নিয়োগ দিয়েছেন কালাম।
এলাকায় সরকারি অনুদানের টাকাও লুটপাট করেছেন কালাম। গরিবদের জন্য বরাদ্দকৃত নলকূপ ও ঘর দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। অনেকে এখনো তার কাছে টাকা পাওয়ার দাবি করেন। এ ছাড়া, রাজাপুরের জি কে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে ৫৭ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
পরিচয় না প্রকাশের শর্তে নলছিটি উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা এক ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, আমুর সঙ্গে দেখা করতে হলে অনুমতি নিতে হতো আজাদের। উন্নয়নমূলক সব কাজের ভাগ-বাটোয়ারা করতেন তিনি। তার কথার বাইরে বলতে গেলে এক পা-ও চলতেন না আমু। পরিস্থিতি এমন ছিল পিএস আজাদ ছিলেন আমুর ছায়া। তার মাধ্যমেই নির্বাচনি এলাকা থেকে শত শত কোটি টাকা কামিয়েছেন আমু।
ঝালকাঠি সড়ক বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, যত ধরনের ঠিকাদারি টেন্ডার, সব ক্ষেত্রেই আমুকে দিতে হতো টাকা। ঠিকাদার নির্বচান প্রশ্নেও তার সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। ই-টেন্ডার চালু হওয়ার পরও নানা কৌশলে টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। আর এগুলো সব নিয়ন্ত্রণ করতেন আবুল কালাম আজাদ। কথা না শুনলে কেবল বদলি নয়, শারীরিক-মানসিকভাবেও হতে হতো হেনস্তা।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, সড়ক বিভাগের মতো এলজিইডি, শিক্ষা প্রকৌশল দপ্তর, গণপূর্ত, থানা প্রকৌশলী এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন বিভাগসহ সব ক্ষেত্রেই ছিল একই অবস্থা।
কালামের বিরুদ্ধে এতদিন কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি, কারণ তিনি ছিলেন ক্ষমতার ছায়াতলে। তবে শেষ পর্যন্ত তার অপরাধের লাগাম টানা হয়েছে। রাজাপুর থানার ওসি ইসমাইল হোসেন জানিয়েছেন, আবুল কালাম আজাদ একাধিক মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
স্থানীয়দের দাবি, শুধু গ্রেপ্তার করলেই চলবে না, তার বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগগুলোর সঠিক তদন্ত হতে হবে। প্রশাসনের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, এই দুর্নীতিবাজের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা হোক, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ রাজনৈতিক আশ্রয়ে থেকে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে দুর্নীতির সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে না পারে।