রাজনীতির মাঠে এখন সর্বত্র আলোচনা ছাত্রদের নতুন দল গঠন প্রসঙ্গ। কারণ জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের নেতাদের নেতৃত্বে আসছে নতুন একটি রাজনৈতিক দল।
আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ প্রাঙ্গণ থেকে নতুন দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটতে পারে বলে জোড় গুঞ্জন রয়েছে।
তবে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠন প্রক্রিয়ায় দলীয় পদ-পদবি নিয়ে রয়েছে চাপা ক্ষোভ।
তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণ শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে। অপেক্ষা শুধু আনুষ্ঠানিকতা।
২০২৪ সালে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ দফা প্রস্তুত করা হয়েছে, এটি সামনে রেখে যেকোনো সময় দলের ঘোষণা দেবে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী তরুণদের প্ল্যাটফরম জাতীয় নাগরিক কমিটি।
দল গঠনের পর রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর বাস্তবায়নে নতুন সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গণপরিষদ গঠনের লক্ষ্য নিয়ে এগোবেন তরুণ তুর্কিরা।
নতুন এই রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘিরে রাজধানী ঢাকায় বিশাল জমায়েতের পরিকল্পনা করছেন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণরা।
জানা গেছে, ২৬ ফেব্রুয়ারি মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে ৩ লক্ষাধিক লোকের উপস্থিতিতে রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দিতে চান তারা।
ওই দিন সারা দেশ থেকে ঢাকায় আসবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রতিনিধিরা। সংগঠনের দুটি সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা যায়।
দলের অর্গানোগ্রাম, ঘোষণাপত্র, সময়সহ সবকিছু চূড়ান্ত হলে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত তথ্য জানিয়ে দেওয়া হবে বলে জানান দল গঠনের সঙ্গে জড়িত নেতারা।
আগামীকাল মঙ্গলবার পদত্যাগ করার কথা রয়েছে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের। পরদিন বুধবার দল গঠনের ঘোষণার কথা রয়েছে।
নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বাস্তবায়নে জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দিতে আত্মপ্রকাশের দিন সারা দেশ থেকে নেতা-কর্মীদের ঢাকায় জড়ো করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
সূত্র জানায়, এই দলে অনেকেই আছেন যারা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন। এখন পর্যন্ত দেশের প্রায় ৩০টি জেলা, চারটি মহানগরসহ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শাখাগুলোতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটি গঠন করা হয়েছে। আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে তারাও উপস্থিত থাকবেন বলে জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
যতদূর জানা গেছে, প্রথমে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটবে রাজনৈতিক দলের। এরপর পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে কাউন্সিলের মাধ্যমে। আহ্বায়ক কমিটির পদপদবি নিয়ে কয়েকটি পক্ষের মধ্যে বিবাদ থাকলেও তা এখন অনেকটাই সমাধানের পথে বলেও জানান সমন্বয়করা। আহ্বায়ক কমিটিতে পদসংখ্যা বাড়িয়ে সব পক্ষের প্রতিনিধিদের অবস্থান নিশ্চিত করার পরিকল্পনা করা রয়েছে তাদের।
পাশাপাশি আহ্বায়ক কমিটিতে নারী ও সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বও যেন থাকে সেই দিকটি নিয়েও ভাবছেন তরুণরা। নতুন দলের কমিটির কাঠামোয় শীর্ষ চারটি পদ আহ্বায়ক, সদস্যসচিব, মুখ্য সংগঠক ও মুখপাত্র থাকবে বলে জানা গেছে।
এগুলোর সঙ্গে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক এবং জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব পদ তৈরি করা হতে পারে। শীর্ষ এসব পদে পর্যায়ক্রমে আলোচনায় আছেন নাহিদ ইসলাম, আখতার হোসেন, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আলী আহসান জুনায়েদ ও নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী।
নারী ও সংখ্যালঘু কোটায় গুরুত্বপূর্ণ পদের ভাবনায় সামান্তা শারমিন ও অনীক রায়ের কথা শোনা যাচ্ছে।
ছাত্রনেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়েকটি দলের নাম প্রস্তাব হলেও নতুন রাজনৈতিক দলের নাম এখনো চূড়ান্ত হয়নি। নেতাদের পছন্দের তালিকায় সম্ভাব্য ৯টি নাম রয়েছে।
তবে, দলের নাম ইংরেজিতে নামকরণের বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। নতুন রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামো সম্পর্কে তারা বলেন, নতুন দলে আহ্বায়ক, সদস্য সচিব, যুগ্ম আহ্বায়ক, মুখ্য সংগঠক ও মুখপাত্রসহ গুরুত্বপূর্ণ ৯টি পদ থাকছে।
পাশাপাশি নতুন পদ তৈরির বিষয়েও আলোচনা চলছে। তারা বলছেন, আহ্বায়ক পদ বাদে কোনো পদেই এখনো নাম চূড়ান্ত করা হয়নি। একই সঙ্গে সাংগঠনিক কাঠামো তৈরির জন্য বিশ্বের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাঠামো পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
ছাত্রনেতাদের দাবি, ১২০ থেকে ১৫০ সদস্যবিশিষ্ট নতুন দলের জন্য ইতোমধ্যে ৭০ জনকে বাছাইসহ শীর্ষ ৯টি পদের জন্য ৯টি নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন ছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন ও সেক্টর থেকে অনেকে এ কমিটিতে ভিড়তে চাচ্ছেন। কমিটির আকারের তুলনায় অধিক প্রার্থী হওয়ায় নেতা বাছাইয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটতে চললেও দলটির সাংগঠনিক কাঠামো এখনো চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি।
তবে, মূল কমিটিতে থাকছেন এমন ৭০ জনের নাম প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত করা হয়েছে। নতুন দলের আহ্বায়ক হিসেবে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের নাম প্রায় চূড়ান্ত।
তবে, সদস্য সচিব পদে কাকে মনোনীত করা হবে, সেটি নিয়ে চলছে যত আলোচনা। এ পদে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেনের নাম শোনা যাচ্ছে বেশ জোরালোভাবে।
এ ছাড়া যুগ্ম আহ্বায়ক পদে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, মুখ্য সংগঠক হিসেবে সারজিস আলম, মুখপাত্র হিসেবে হাসনাত আবদুল্লাহসহ গুরুত্বপূর্ণ ৯টি পদে চমক দেখাতে যাচ্ছেন ছাত্রনেতারা।
কেউ কেউ বলছেন, ছাত্র-আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন কিন্তু অপরিচিতি এমন অনেককে গুরুত্বপূর্ণ পদে দেখা যেতে পারে। এক উপদেষ্টার ভাইও গুরুত্বপূর্ণ পদে আসছেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের একাধিক নেতা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, অভ্যুত্থানের পর গঠিত হয় জাতীয় নাগরিক কমিটি।
কমিটির সদস্যরা এখন নতুন রাজনৈতিক দলের আহ্বায়ক কমিটির শীর্ষপদ নিয়ে তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন।
গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি, ছাত্র-অধিকার পরিষদ, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সদস্যরা শীর্ষপদ চান।
তবে, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে আহ্বায়ক করা নিয়ে এখনো কেউ দ্বিমত পোষণ করেননি। শুধু সদস্য সচিব ও মুখ্য সংগঠক নিয়ে যত আলোচনা হচ্ছে।
জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের নেতাদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দলের নাম ও প্রতীক কী হবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ছাত্রনেতাদের পছন্দের সম্ভাব্য চারটি নাম এসেছে।
অন্যদিকে, সমর্থনের বিচারে এগিয়ে আছে তিনটি প্রতীক।
জানা গেছে, বিএনপির মতো ইংরেজি নাম খুঁজছেন তারা। চারটি নামের মধ্যে জুলাই আন্দোলনের নেতাদের মতামতের ভিত্তিতে একটি নাম চূড়ান্ত করা হবে।
পছন্দের নামের মধ্যে ‘জাতীয় বিপ্লবী শক্তি’, ‘ছাত্র-জনতা পার্টি’, ‘বিপ্লবী জনতা সংগ্রাম পার্টি’ ও ‘বৈষম্যবিরোধী নাগরিক আন্দোলন’ এই নাম চারটি বেশি শোনা যাচ্ছে। এ ছাড়া নতুন দলের নির্বাচনি প্রতীক কী হবে তা নিয়েও জোর আলোচনা চলছে। এখন পর্যন্ত সম্ভাব্য চারটি প্রতীক নিয়ে বেশি কথা হচ্ছে।
এগুলো হলো ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ ‘মুষ্টিবদ্ধ হাত’, ‘হাতি’ ও ‘ইলিশ’।
এগুলোর মধ্যে ‘ইলিশ’ বাদে বাকি তিনটি প্রতীক বেশি সমর্থন পাচ্ছে বলে জানা গেছে।
নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমাদের একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ২৬ তারিখ আমরা করব। এটা এখন পর্যন্ত ঠিক আছে।
তবে দলের নেতৃত্বে কারা থাকবে, সেটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। দলটির একাধিক শীর্ষ নেতা জানিয়েছেন, এই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১০০টি আসন এবং পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার টার্গেট নিয়েই রাজনৈতিক দল হিসেবে যাত্রা শুরু করতে চান তারা।
এককভাবে নির্বাচন করবেন নাকি কোনো জোটে যাবে সেটি এখনো বলার সময় আসেনি বলেও জানান একাধিক সমন্বয়ক। নেতৃত্ব শেষে কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব কমে আসবে বলেও মনে করেন তারা।
আপনার মতামত লিখুন :