দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে রোববার রাতে নিজের বাসায় ফিরছিলেন স্বর্ণ ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন।
রাজধানীর বনশ্রী ডি ব্লকের ৭ নম্বর বাসার সামনে আসতেই গুলি করে ও কুপিয়ে সঙ্গে থাকা বিপুল স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ অর্থ লুটে নেয় মোটরসাইকেলে থাকা দুর্বৃত্তরা।
একই রাতে মোহাম্মদপুরের টাউনহল এলাকায় রিকশা থামিয়ে তিন নারীর কাছে থাকা মালামাল ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা।
এ ছাড়া মান্ডায় গ্রিন মডেল টাউনে ঘটে ছিনতাইয়ের ঘটনা। এর আগে ওই রাতে ধানমন্ডিতে ১৫-২০ জনের একটি জটলা দেখে ডাকাত আতঙ্কে মসজিদ থেকে মাইকিং করে এলাকাবাসীকে সতর্ক করার পর জানা যায় সবটাই ছিল গুজব।
এভাবেই সম্প্রতি রাজধানীতে একের পর এক ঘটছে চাঞ্চল্যকর বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। ছড়িয়ে পড়ছে অপরাধ কর্মের ভয়াবহ ভিডিও।
ভেঙে পড়ছে আইনশৃঙ্গলা পরিস্থিতি। রাত নামলেই দুর্বৃত্তের হানা। এতে ঢাকা মহানগরী যেন আতঙ্কের নগরীতে পরিণত হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে দেশজুড়ে চলমান যৌথ বাহিনীর বিশেষ অভিযান অপারেশন ডেভিল হান্টেও সারা মিলছে না।
যদিও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও পুলিশপ্রধান দাবি করেছেন, এগুলো পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের নেতা-কর্মীদের পরিকল্পিত অপরাধ কর্ম। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
এদিকে শুধু রাজধানী নয়, দেশের বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়েও সম্প্রতি অপরাধের ঘটনা বেড়েছে। নতুন করে মাথাচাড়া দিচ্ছে নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থি দলের সদস্যরাও।
গত শুক্রবার রাতে ঝিনাইদহের শৈলকুপায় গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয় তিনজনকে।
চরমপন্থি দল জাসদ গণবাহিনীর নেতা পরিচয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে বার্তা পাঠিয়ে এক ব্যক্তি এ হত্যাকাণ্ডের দায়ও স্বীকার করেছে।
সব মিলিয়ে দিনে দিনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। ফলে জননিরাপত্তায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। আতঙ্ক কাটছে না সাধারণ মানুষের।
অব্যাহতভাবে ছিনতাই-ডাকাতি-ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে গভীর রাতে রাস্তায় নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
রাজু ভাস্কর্যের সামনে এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির জন্য তারা দায়ী করেন খোদ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে।
এমনকি সোমবারের মধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের আলটিমেটামও দেন শিক্ষার্থীরা।
এদিকে গভীর রাতে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে দুর্বৃত্তদের ঘুম হারাম করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
তিনি দাবি করেছেন, আওয়ামী দোসররা লুটের অর্থ দিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।
বলেন, আজ (সোমবার) থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি হবে।
আইজিপি বাহারুল আলম বলেছেন, একটি গোষ্ঠী চায় না দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় থাকুক।
আজ থেকে ছিনতাই প্রতিরোধে রাজধানীতে মাঠে নামছে তিনটি বিশেষায়িত ইউনিট। এরপরও উন্নতি না হলে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা গেছে, রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে বনশ্রী ডি ব্লকের ৭ নম্বর রোডের ২০ নম্বর বাড়ির সামনে ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন ব্যবসায়ী আনোয়ার।
তিনি বনশ্রী সি ব্লকের ৫ নম্বর রোডের অলংকার জুয়েলার্সের মালিক। দুর্বৃত্তরা তাকে গুলি করে ও কুপিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে যায় সঙ্গে থাকা স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ অর্থ।
ঘটনার পরপরই সেখানে হাজির হয় সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পরে আনোয়ার হোসেনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়।
সেখানে ব্যবসায়ী আনোয়ার জানান, ছিনতাইকারীরা প্রথমে তার গতিরোধ করে, পরে গুলি করে। চিকিৎসক ও স্বজনরা জানিয়েছেন, চার রাউন্ড গুলি লেগেছে আনোয়ারের শরীরে।
আছে ধারালো অস্ত্রের আঘাতও।
আহত আনোয়ারের বন্ধু মজিবুর রহমান বলেন, আমার সঙ্গে আনোয়ারের ব্যবসা আছে। আমি ওর সঙ্গে ব্যবসায় জড়িত আছি।
ওর দোকানের নাম অলংকার জুয়েলারি। প্রতিদিনই সে রাত সাড়ে ১০টায় দোকান বন্ধ করে। অন্যদিনের মতো ঘটনার রাতেও ১১টার আগে দোকান বন্ধ করে বাসায় আসতে থাকে।
তিনি আরও বলেন, তার দোকানে এবং বাসায় দু’জায়গাতেই স্বর্ণের ভল্ট আছে। প্রতিদিনই বড় বড় স্বর্ণগুলো সে বাসায় নিয়ে আসে। দোকান থেকে বাসা হাঁটা পথ। তার কাছে ২০০ ভরি স্বর্ণ ছিল। নগদ এক লাখ টাকা ছিল।
সে মোটরসাইকেলে করে বাসায় আসছিল। কিন্তু ৭ নম্বর রোডের মাথা থেকে তিনটি মোটরসাইকেল তাকে ফলো করে। ঠিক যখন বাসায় ঢুকবে, গেটের সামনেই মোটরসাইকেলগুলো এসে তাকে ব্যারিকেড দেয়। এসেই এলোপাতাড়ি গুলি ও কোপ দিয়ে সব নিয়ে যায়।’
এদিকে ওই রাতেই মোহাম্মদপুরে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
এতে দেখা যায়, একটি রিকশা থামিয়ে দুই তরুণ ছিনতাই করছে। রিকশায় এক নারীকে বসে থাকতে দেখা যায় এবং তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন আরেক নারী।
এ সময় দাঁড়িয়ে থাকা নারীর দিকে এক ছিনতাইকারীকে চাপাতি হাতে তেড়ে যেতে দেখা যায়। সেখানে আরেক ব্যক্তিকে দেখা যায় ছিনতাইকারীদের সরিয়ে দিতে।
তবে তিনি ওই দুই নারীর সঙ্গে ছিলেন কি নাÑ তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। একই রাতে রাজধানীর দক্ষিণখানে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে আরিফুল ইসলাম নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন।
আরিফুল একটি পোশাক তৈরি কারখানায় কর্মচারী ছিলেন বলে জানিয়েছেন স্বজনেরা।
পুলিশ জানায়, সোমবার ভোর ৫টার দিকে দক্ষিণখান থানার তালতলা এলাকার রাস্তার ওপর থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় ওই যুবকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
রাতে বাসার ফেরার সময় অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। তবে কে বা কারা এ কাজটি করেছে তা এখনো জানতে পারেনি পুলিশ।
এর আগে গত শনিবার মধ্যরাতে রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বরের বেনারসি পল্লী এলাকায় ছয়টি দোকান ও বাসা লুট করেছে একটি চক্র।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ভোররাত ৪টা ২০ মিনিটে একটি প্রাইভেট কার থেকে তিন ব্যক্তি ‘মা মনি’ স্টোর নামে একটি মুদি দোকানের সামনে নামে।
তারা তালা কেটে দোকানের সামনে থেকে সরে যায়। কয়েক মিনিট পর এসে শাটার খুলে নগদ টাকা ও দোকানের মালপত্র লুট করে তারা চলে যায়। একই কৌশলে পাশের তিনটি দোকান ও দুটি বাসায় ডাকাতি চালায় চক্রটি।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি সকালে ভিক্টর পরিবহনের একটি বাস যাচ্ছিল সদরঘাটের দিকে। উত্তরার হাউস বিল্ডিং এলাকায় আসার পর চলন্ত বাসে যাত্রীবেশে থাকা পাঁচ-ছয়জন সশস্ত্র যুবক যাত্রীদের ওপর হামলে পড়ে।
অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের জিম্মি করে তাদের কাছে থাকা মোবাইল ফোন ও টাকাসহ অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে আজমপুর বাসস্ট্যান্ডে নেমে পড়ে ওই যুবকরা।
তার আগে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভারে আরেকটি চলন্ত বাসে একইভাবে দিন-দুপুরে ডাকাতির ঘটনা ঘটে।
গত ১৪ জানুয়ারি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ বন্দরের কেওঢালা এলাকায় র্যাব সদস্য পরিচয়ে বাস থামিয়ে প্রবাসফেরত দুই যাত্রীকে নামিয়ে মাইক্রোবাসে ওঠানো হয়। পরে তাদের কাছ থেকে সর্বস্ব লুট করে পালিয়ে যায় ডাকাতরা।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে ঢাকা থেকে রাজশাহীর পথে ছেড়ে যাওয়া একটি বাসে ডাকাতির সময় শুধু যাত্রীদের টাকা-পয়সা ও মালপত্র লুটে নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি ডাকাতরা, বাসটির নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানিও করে।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ছিনতাই রোধে পুলিশের তিন বিশেষায়িত ইউনিট আজ থেকে মাঠে নামতে পারে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশের আইজি বাহারুল আলম।
দেশে অপরাধ বেড়েছে স্বীকার করে আইজিপি বলেন, অপরাধের সংখ্যাটা বেড়েছে। বিশেষত, রাত্রিকালীন ছিনতাই; দিনেও ছিনতাই হচ্ছে।
আমরা এই জিনিসটা আমাদের নোটিশে নিয়েছি। তিনি বলেন, ‘র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এই তিন অর্গানাইজেশন মিলে একটি প্যাট্রোল প্রোগ্রাম নেওয়া হয়েছে।
আজ (গতকাল সোমবার) থেকে এটি বাস্তবায়িত হবে আশা করি। আমরা দেখি এভাবে উন্নতি হয় কি না। না-হয় আমাদের অন্য কৌশল নিতে হবে।
এর আগে গত রোববার গভীর রাতে রাজধানীর বারিধারা ডিওএইচএসের নিজ বাসভবনে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের তুলনায় ভালো আছে দাবি করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আমরা পূর্ণ সজাগ।
দেশ থেকে লুট করা অর্থ আওয়ামী সন্ত্রাসীরা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে ব্যবহার করছে। তাদের ঘুম হারাম করে দেওয়া হবে।
উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, সব বাহিনীর টহল কার্যক্রম বাড়ানো হবে। কিছু যেন না ঘটে কাল (সোমবার) থেকে, সেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অবহেলা হলে বাহিনী সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পদত্যাগ দাবির বিষয়ে অবগত উপদেষ্টা। যে কারণে পদত্যাগ দাবি করা হচ্ছে, সেটা সমাধানের চেষ্টা করছেন বলেও জানান তিনি।
একই সঙ্গে বলেন, তিনি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে পরিস্থিতিতে পেয়েছিলেন, তার চেয়ে উন্নতি করেছেন।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে উপদেষ্টা বলেন, আমার মা-বোনদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। তাদের ব্যাপারে আমরা সব সময় কনসার্ন।
এবং তাদের কোনো ধরনের যেন, কোনো রকমের সমস্যায় পড়তে না হয়, এ ব্যাপারে আমরা সব সময় সজাগ আছি। এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এই ব্যাপারে সব সময় সজাগ আছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এসএন মো. নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ছিনতাইয়ের স্পট ও ছিনতাইকারীদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
ছিনতাইয়ের ঘটনা রোধে আমরা এই স্থানগুলোতে ইউনিফর্ম এবং সাদা পোশাকে অফিসার মোতায়েন করেছি। এর পাশাপাশি, তালিকাভুক্ত ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চলমান।
আপনার মতামত লিখুন :