এলজিইডি প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ

মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২৫, ০৯:০৭ এএম

এলজিইডি প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ফ্যাসিস্টের দোসর এলজিইডির উপসহকারী প্রকৌশলী আশরাফুল এখনো বেপরোয়া। তিনি আওয়ামী সরকারের আমলেই কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ পড়েছে। তা ছাড়া উপসহকারী প্রকৌশলী আশরাফুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তিনি কর্মক্ষেত্রে শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণের মতো অপরাধে যুক্ত। 

আশরাফুলের অপর্কমের যেন শেষ নেই। তার দ্বারা শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণের শিকার আউটসোর্সিংয়ের এক নারী। ওই নারী বিচার চেয়ে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছে লিখিত অভিযোগ করে সহযোগিতা চাইলেও ১১ মাসেও তিনি সঠিক বিচার পাননি। তবে শেষমেশ বাধ্য হয়ে আদালতে মামলা করেছেন। 

ভুক্তভোগী নারীর অভিযোগ, সাইট পরিদর্শনের নামে বারবার ধর্ষণের চেষ্টা করতেন এলজিইডির উপসহকারী প্রকৌশলী আশরাফুল। এর আগে সাইট ভিজিটের নামে অসুস্থ অবস্থায় ওষুধের কথা বলে ওই নারীর রুমে প্রবেশ করে তার হাতমুখ বেঁধে ধর্ষণ করা হয়। চাকরি হারানোর ভয়ে ওই নারী বিষয়টি গোপন রাখেন। 

এরপর বিভিন্ন সময়ে আশরাফুল নানা ধরনের অজুহাতে ভিডিও করেছেন এমন কথা বলে তাকে ভোগ করতে থাকেন। আশরাফুল বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে অনেক শক্তিশালী ছিলেন। তাদের নিজস্ব একটি গ্যাং রয়েছে। 

জানা যায়, আশরাফুলের কারণে এর আগেও এক নারী চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। এখনো অনিশ্চয়তা আর শঙ্কায় চাকরি করছেন গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে কর্মরত নারীরা। 

সূত্র জানায়, এলজিইডির গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের উপসহকারী প্রকৌশলী আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির যেসব অভিযোগ আছে, সেগুলোর কিছুটা প্রমাণও পেয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। প্রকল্পটিতে কর্মরত নারী কর্মীদের যৌন হয়রানি ও মানসিক নির্যাতনের মতো গুরুতর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থেকেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন প্রভাবশালী এই কর্মকর্তা। 

এসব বিষয়ে একাধিক সূত্র রূপালী বাংলাদেশকে জানান, কর্মস্থলে নারী কর্মীকে যৌন হয়রানি ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগে উপসহকারী প্রকৌশলী আশরাফুল আলমকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের সদর দপ্তর থেকে রাঙামাটিতে বদলি করা হলেও ক্ষমতার দাপটে বদলির আদেশ বাতিল করে বারবার থেকে যান একই জায়গায়। ফলে একই অফিসে অভিযোগকারী নারীকে কাজ করতে দীর্ঘদিন বাধ্য করেন প্রকল্পটির দায়িত্বশীল কিছু কর্মকর্তা। 

অভিযোগ আছে, গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প একটি হরিলুটের প্রকল্প। এর আগে অবসরপ্রাপ্ত সাবেক প্রকল্প পরিচালক কাজী মো. মিজানুর রহমান সীমাহীন ঘুষ-দুর্নীতির দুর্গ তৈরি করে দুর্নীতির বরপুত্র হিসেবে খেতাবপ্রাপ্ত হন। দুর্নীতি দমন কমিশন দফায় দফায় তদন্ত করেও অদৃশ্য শক্তির কারণে প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। 

তদন্তের দীর্ঘসূত্রতার সুযোগে এই প্রকল্পের দুর্নীতি ঢাকতে মন্ত্রণালয়ে তদবির করে উপপ্রধান প্রকৌশলীর প্রশ্নবিদ্ধ পদোন্নতি হাতিয়ে নিয়ে নিজেদের পছন্দমতো সাতক্ষীরায় কর্মরত নির্বাহী প্রকৌশলী সুজায়েতকে পিডির দায়িত্ব দিয়েছেন। সুজায়েত সাতক্ষীরায় নির্বাহী প্রকৌশলী থাকা অবস্থায় নানা আইনবহির্ভূত কাজে যুক্ত ছিলেন। 

প্রকৌশলী সুজায়েতের আগে এই প্রকল্পে ফরিদপুরে কর্মরত নির্বাহী প্রকৌশলীকে মাত্র কয়েক দিনের জন্য প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পূর্বতন প্রকল্প পরিচালক কাজী মিজানুর রহমান এবং তার সিন্ডিকেট বর্তমান পিডিকে নিজেদের অপরাধ লুকাতেই এখানে দায়িত্বে দিতে ভূমিকা নিয়েছেন। 

কারণ গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের তরিকুল-রকিবুল-আশরাফুল সিন্ডিকেট কাজী মিজানের অবসরে যাওয়ার পরে আগের মতো লুটপাট করতে পারবে না অথবা দুর্নীতি লুকিয়ে রাখতে পারবে নাÑ এই ভয়ে মো. সুজায়েত হোসেনকে এই প্রকল্পে কোটি টাকা খরচ করে পুনর্বাসন করে।

নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্প পরিচালকের দপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী (আউটসোর্সিং) লায়লা অভিযোগ করে বলেন, ‘২০২১ সালের দিকে তৎকালীন প্রকল্প পরিচালকের নির্দেশে সাইট পরিদর্শনে যাওয়ার পর উপসহকারী প্রকৌশলী আশরাফ গল্প করার ছলে হোটেলরুমে ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন।

 একজন নারী হিসেবে মানসম্মানের ভয়ে বিষয়টি গোপন রাখি। কিন্তু আশরাফ প্রতিনিয়তই আমাকে সাইটে নিয়ে যাওয়ার জন্য মানসিকভাবে চাপ সৃষ্টি করতেন। তা ছাড়া আমাকে নানাভাবে তার আশপাশের লোকজন মিলে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করেন বাসায় অথবা রিসোর্টে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তা ছাড়া অফিসে আমার সঙ্গে ক্রীতদাসের মতো আচরণ করতেন।’

তিনি বলেন, ‘আমি ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা প্রকাশ করছি। এ জন্য সরকারের সহযোগিতা চাই।’ তিনি বলেন, ‘এখনো আশরাফুল আলমের সিন্ডিকেটের লোকজন আমাকে  ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। তা ছাড়া তাদের ভয়ে প্রকল্পের কেউ কথা বলার সাহস পান না। 

এমনকি আমি ৫ আগস্টের পর ফরিদপুরে বদলি হলেও বর্তমানে প্রকল্পটিতে কর্মরত নারী কর্মীরা আশরাফুলের ভয়ে অনিশ্চয়তা আর শঙ্কায় চাকরি করছেন।’ 

তিনি বলেন, ‘অভিযোগের পর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও ১১ মাসেও সঠিক বিচার পাইনি। সঠিক বিচারের নামে এভাবে যদি তদন্তে কালক্ষেপণ করা হয়, তাহলে এরা অপরাধ করতেই থাকবে’Ñ এটা বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন অভিযোগকারী এই নারী।  

তিনি বলেন, ‘আমি এই ঘটনার সঠিক বিচার না পাওয়ায় আদালতে একটি মামলা দায়ের করেছি। সেই মামলা তদন্তে আছে। আশা করি সঠিক বিচার পাব। দেশের মানুষকে বলতে চাই, ফ্যাস্টিসের দোসররা যাতে কোনো অপরাধ করে রেহাই না পায়।’
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক সুজায়েত হোসেন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। শুধু বলেন, এ বিষয়ে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখনই কিছু বলা সম্ভব নয়।

এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের তৎকালীন দায়িত্বশীল সহকারী প্রকৌশলী নূরুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আশরাফুলের বিরুদ্ধে লায়লা যে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করেছেন, তার প্রত্যক্ষদর্শী আমি। এ ধরনের অভিযোগ আশরাফুলের বিরুদ্ধে থাকলেও সে আমাকেও হয়রানি করেছে। এর কারণ, এলজিইডিতে তিনি আওয়ামী লীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ ও তাজুল ইসলামের লোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন।’ 

নূরুল ইসলাম বলেন, ‘এর আগে তাসরুফা নামের এক মেয়েকে ধর্ষণ করতে গিয়ে ধরা পড়েন আশরাফুল। পরে ওই মেয়ে ভয়ে চাকরি ছেড়ে দেন। পিডি হিসেবে সুজায়েত দায়িত্ব গ্রহণের পরই আমার সামনেই আশরাফ গংয়ের প্রস্তাবে লায়লা রাজি না হলে ছাত্রলীগের নেতাদের দিয়ে মারধর করে জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলেন। বিষয়টা অফিসের সবাই জানেন।’

এ বিষয়ে এলজিইডির সদর দপ্তরের প্রকৌশলী প্রশাসন (তদন্ত) জানান, আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। এরই মধ্যে তিনি কারণ দর্শানোর লিখিত জবাব দিয়েছেন। এখন বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত দেবেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এলজিইডির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, এলজিইডির গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের উপসহকারী প্রকৌশলী ধর্ষণের মামলার আসামি হয়েও বহাল তবিয়তে কর্মক্ষেত্রে দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছেন। ভান্ডারিয়ার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিরাজুল ইসলাম সিন্ডিকেটের সদস্য আশরাফুল আলম। প্রকল্প পরিচালক সুজায়েত হোসেনকে ওই প্রকল্পে নিয়োগ দিয়েছেন এই মিরাজুল ইসলাম।  
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!