অমর একুশের মাসব্যাপী বইমেলাকে ঘিরে নতুন বইয়ের আগ্রহ নিয়ে বছরজুড়ে অপেক্ষায় থাকেন পাঠক, লেখক ও প্রকাশক। গত পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে এবারের বইমেলা।
মাসব্যাপী এই বইমেলায় নিয়মমাফিক প্রতিদিন বই বিক্রি হলেও ২১ ফেব্রুয়ারির আগে-পরের দুদিন পাঠক-দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড়ে বই বিক্রি বেড়ে যায় বহুগুন।
মূলত এই সময়ের বিক্রিই প্রকাশকদের মেলাকেন্দ্রিক সারা মাসের বাণিজ্যের অন্যতম সূচক। ২১ ফেব্রুয়ারির পর মেলা শেষের দিন কাছে চলে আসায় বই বিক্রির বিষয়টি তখন শুধুই নিয়মে পরিণত হয়।
এদিকে আলোচনা-সমালোচনায় শেষ হতে চললেও মেলার গত বাইশ দিনের বই বিক্রি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন অংশগ্রহণকারী প্রকাশকরা।
তারা জানিয়েছেন, গত বছরের তুলনায় এবার বই বিক্রি হয়েছে অর্ধেক টাকার। এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে প্রকাশকরা বলেছেন, এভাবে চললে মেলা শুধু নিয়মে পরিণত হবে। প্রকাশকরা নতুন বই প্রকাশ করতে পারবে না।
পাঠকরাও নতুন বইয়ের অভাবে মেলায় আসার আগ্রহ হারাবে। বাংলা একাডেমি ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বই বিক্রি গতবারের তুলনায় অর্ধেক হওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি রেজাউল করিম বাদশা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এবারের মেলায় অনেক ফ্যাক্টর কাজ করেছে। কাগজের সংকট ও এনসিটিবির পাঠ্যবইয়ের জন্য নতুন বই কম বের হয়েছে। বেশিরভাগ নতুন বই এসেছে ১৪-১৫ তারিখের পর। এতে বিক্রিতে প্রভাব পড়েছে।
অন্যদিকে সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির স্ট্যাডিং কমিটির আহ্বায়ক আলমগীর সিকদার লোটন বলেন, একটা আন্দোলনের পর বইমেলার প্রকৃতিগত পরিবর্তন হয়েছে। প্রচুর মানুষ আসছে ঠিকই কিন্তু বিক্রি কম, বিষয়টি নিয়ে আমিও হতাশ। আশা করি, আগামী বছর হয়তো পরিস্থিতি পাল্টাবে।
বই বিক্রি কমার কারণ সম্পর্কে জানতে গবেষণার প্রয়োজন বলে মনে করেন বাংলা একাডেমির মেলা আয়োজনের সদস্য সচিব ড. সরকার আমিন। তিনি বলেন, মানুষের পাঠস্পৃহায় কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না তা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। প্রচুর মানুষের সমাগমে মেলা জমজমাট ছিল ঠিকই, তারপরও পাঠকরা কেন বই কিনছে না, বা তারা অন্য কোনো মাধ্যমে কাগুজে বইয়ের বিকল্প পেয়েছে কি না- এসব নিয়ে আমার নিজেরও গবেষণার আগ্রহ রয়েছে।
বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) জি.এম মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, বইমেলায় গত বাইশ দিনে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বই বিক্রি হয়েছে ৪১ লাখ টাকা। গত বছর একই সময়ে বই বিক্রি হয়েছে প্রায় ৬৫ লাখ টাকার।
এ হিসাবে গত বছরের তুলনায় এবার বই বিক্রির পরিমাণ অর্ধেকের কিছু বেশি। গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সেলস অফিসার জুলফিকার আলী জানিয়েছেন, ডাবল ইউনিটের এই স্টলে গত বছর সাত লাখ টাকা বিক্রি হলেও এবার হয়েছে সাড়ে তিন লাখ টাকার মতো। তিনি বলেন, আমাদের তাও বিক্রি কিছুটা ভালো, আশপাশের স্টলগুলোর অবস্থা আরও খারাপ।
গতবারের তুলনায় এবার বাইশ দিনে অর্ধেকেরও কম বিক্রি হয়েছে অন্যন্যা প্রকাশনীর প্যাভিলিয়নে। এই প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মনির হোসেন জানান, গতবার বিক্রি হয়েছিল প্রায় ৫০ লাখ টাকা।
একই সময়ে এবার বিক্রি হয়েছে ২০ লাখ টাকা। নাম প্রকাশ না করে মেলায় প্যাভিলিয়ন পাওয়া বড় একটি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী বলেন, বই বিক্রির বাজে অবস্থা। ভীষণ হতাশ। গতবার যেখানে বিক্রি হয়েছিল ১০ লাখ সেখানে এবার পাঁচ লাখেরও কম।
গতবারের মেলায় এক ইউনিটের একটি স্টলে বাইশ দিনে এক থেকে দেড় লাখ টাকা বিক্রি হলেও অনেক স্টলে গত বাইশ দিনে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা বিক্রি হয়েছে বলে বলে জানান চমন প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী এনাম রেজা। তিনি বলেন, অধিকাংশ দর্শনার্থী মেলায় এসে দুটো ছবি তুলে চলে যায়। এভাবে চললে মেলা নিয়ে কারোই আগ্রহ থাকবে না।
রৌদ্রছায়া প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী আহমেদ রউফ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বেশকিছু ঘটনার প্রভাব পড়েছে মেলার বই বিক্রির ওপর। গতবারসহ অন্যান্য সময় তার এক ইউনিটের স্টলে লাখ টাকার ওপরে বিক্রি হলেও এবার এখনো ৫০ হাজারই হয়নি। অন্যধারা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী সৈয়দ রনো জানান, তার স্টলে গত বাইশ দিনের সময়সীমায় বিশ শতাংশ বই কম বিক্রি হয়েছে।
গত ৫ আগস্ট সাবেক আওয়ামী সরকারের পতনের পর ভিন্ন পরিস্থিতিতে এবারের বইমেলার আয়োজন শুরু হয়। জুলাই বিপ্লবকে চেতনায় রেখে এবার বইমেলার মূল প্রতিপাদ্যও করা হয় ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান: নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ’। বইমেলায় ছিল জুলাই চত্বরও।
তবে শুরুর আগে মেলায় প্যাভিলিয়ন ও স্টল বরাদ্দ নিয়ে শুরু হয় প্রকাশকদের মধ্যে ক্ষোভ। গত ১৩ জানুয়ারি সাবেক আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর দালাল প্রকাশকদের প্যাভিলিয়ন ও স্টল বাতিলের দাবিতে বাংলাবাজারে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে ‘সর্বস্তরের সাধারণ প্রকাশক’ ব্যানারে প্রকাশকরা।
পরদিন প্রেসক্লাবেও একই দাবিতে কর্মসূচি ছিল প্রকাশকদের। এক পর্যায়ে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষও প্যাভিলিয়ন ও স্টল বরাদ্দে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়।
অন্যদিকে এই সিদ্ধান্তকে অন্যায় এবং অবিচার দাবি করে ‘সুবিচার প্রত্যাশী প্রকাশকবৃন্দ’ নামের একটি প্ল্যাটফরমের প্রকাশকরা বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানান। পরবর্তীতে বিষয়টির সমাধান করে শুরু হয় বইমেলা।
জানা গেছে, গত রোববার পর্যন্ত মেলায় নতুন বই এসেছে ২৫১৫টি। এবার মেলায় বেড়েছে স্টলের সংখ্যা। অংশ নিচ্ছে ৭০৮টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৬৩৫। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ৯৯টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে রয়েছে ৬০৯টি স্টল। এছাড়া মোট ৩৭টি প্যাভিলিয়নের ৩৬টিই রয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বাংলা একাডেমিতে রয়েছে ১টি। নির্ধারিত সময় অনুযায়ী ২৮ ফেব্রুয়ারি শেষ হচ্ছে এবারের বইমেলা।