সুপেয় পানি প্রকল্পের নামে দীর্ঘ চার বছরে সাতক্ষীরায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে শতকোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে নির্বাহী প্রকেীশলী মো. শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে একাধিক অভিযোগ দিয়েছেন স্থানীয় ভুক্তভোগী ঠিকাদার ও এলাকাবাসী।
অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে চলতি মাসের ১৭ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শহিদুল ইসলামকে কুষ্টিয়া জেলায় বদলি করেছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। তবে বদলি হলেও থেমে নেই তার দৌরাত্ম্য। যদিও সব অভিযোগ অস্বীকার করে সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্যের নির্বাহী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিলে বিষয়টি নিয়ে আমি বক্তব্য দিতে পারব। এখন আমি এ ব্যাপারে কোনো তথ্য আপনাদের দিতে পারব না।’
জানা গেছে, ছুটির দিনে অফিসে বসে অফিসের নথিপত্র গায়েব করে বদলি ঠেকাতে রীতিমতো বিভিন্ন মহলে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন তিনি। এছাড়া টেন্ডারবাজি ও দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল ধনসম্পদ গড়ে তোলা, যশোরের নিউমার্কেট এলাকায় পাঁচতলা বাড়িসহ ৮-১০টি প্লট, কয়েক বিঘা জমি, গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানীসহ বিভিন্ন স্থানে নামে-বেনামে সম্পত্তি কিনেছেন তিনি। বদলি আদেশের পরও দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী কীভাবে এখনো অফিস করছেন, তার খুঁটির জোর কোথায়? এ নিয়ে এলাকার সচেতন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২১ সালে ২০ মে সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্যের নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন শহিদুল ইসলাম। এরপর থেকে তিনি জড়িয়ে পড়েন লুটপাটের মহাযজ্ঞে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে সুপেয় পানির জন্য সারা দেশে ৮ হাজার ৮৫০ কোটি ৭৩ লাখ টাকার প্রকল্প হাতে নেয় আওয়ামী সরকার। এর মধ্যে পাঁচটি প্যাকেজে ২১২ কোটি টাকা বরাদ্দ হয় সাতক্ষীরার জন্য।
প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে- রেইন ওয়াটার হারবেস্ট, গভীর নলকূপ ও সাব-মার্সিবল। প্রকল্পটি শুধু গরিব আর পিছিয়ে পড়া মানুষকে স্বল্পমূল্যে নিরাপদ পানি দেওয়ার জন্য ছিল। কিন্তু বরাদ্দের হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় করে অনিয়মের মাধ্যমে লাভবান হয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা, এমপিসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জেলার আশাশুনি ও শ্যামনগর ‘উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির সংকট নিরসনে সারা দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প ও ‘উপকূলীয় জেলাসমূহে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে পানি সরবরাহ’ নামে দুটি প্রকল্পের আওতায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের বাস্তবায়নে প্রকল্পে ৩ হাজার লিটারের পানি সংরক্ষণের ট্যাংকি, অন্যান্য সরঞ্জাম স্থাপন করা হয়।
এসব প্রকল্পের আওতায় সরকারের উপকারভোগী প্রতি ব্যয় প্রায় ৪২ হাজার ২০০ টাকা (ভ্যাট-ট্যাক্সসহ)। তবে সরকারি এই প্রকল্পে গ্রাহকপ্রতি দেড় থেকে আড়াই হাজার টাকা নেওয়ার কথা থাকলেও কৌশলে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা।
এছাড়া নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত ট্যাংকি তাদের না দিয়ে সচ্ছল ও চাকরিজীবীদের কাছে ১২ থেকে ১৭ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের। এই অনিয়মের সঙ্গে স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও জড়িত বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
তবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের দাবি, স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে যে তালিকা পাওয়া গেছে, সেই তালিকা অনুযায়ী ট্যাংকি বিতরণ করা হয়েছিল। সেখানে দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই বলে দাবি তাদের।
সরোজমিনে গেলে শ্যামনগরের আটুলিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা আল আমিন হোসেন, আলাফাত হোসেন, করিম শেখ, রমজান নগরের বাসিন্দা আয়েশা খাতুন, আমেনা বেগমসহ অনেকে জানান, আমাদের এলাকায় সুপেয় পানির বড়ই অভাব। দিনে দুই থেকে তিনবার দূর থেকে হেঁটে পানি আনতে হয়। পানির পাত্র না থাকায় বৃষ্টির সময় পানি ধরে রাখতে পারেন না তারা। শুনেছি, সরকার থেকে ৩ হাজার লিটারের পানির ট্যাংকি দেয়।
সরকারি বরাদ্দ তো স্বপ্নের মতো। পানির সমস্যা নিয়ে এরপর স্থানীয় মেম্বারদের কাছে গেলে দিতে হয় ১ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। দুঃখের বিষয় হলো, পানির ট্যাংকি গরিব-অসহায় মানুষ না পেয়ে এলাকার বিত্তবানেরাই পাচ্ছেন। তারা ১২ থেকে ১৭ হাজার টাকার বিনিময়ে কিনছেন সরকারি ট্যাংকি। আর এসব ট্যাংকি ব্যবহার করছেন গরুর গোয়াল আর মুরগির খামারে।
নাম না জানানোর শর্তে স্থানীয় এক সংবাদকর্মী জানান, সরকারপতনের কয়েক মাস আগেই শ্যামনগরজুড়ে চলেছে ট্যাংকি বিক্রির হরিলুট। এসবের পেছনে রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য থেকে স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বর পর্যন্ত।
গরিব মানুষকে ট্যাংকি না দিয়ে রমাজাননগরে ফারুক হোসেন নামে এক ইউপি সদস্য হাতিয়ে নিয়েছেন চারটি ট্যাংকি। এছাড়া নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই এলাকায় অধিকাংশ বিত্তবানের বাড়িতে দুই থেকে তিনটি ট্যাংকি। লুটপাটের এই মহাযজ্ঞে খোদ নির্বাহী প্রকৌশলী ও তার সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার জড়িত বলে অভিযোগ করেন তিনি।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার জনস্বাস্থ্য বিভাগের সাবেক এক প্রকৌশলী নাম না জানোনোর শর্তে জানান, নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শহিদুল ইসলাম সাতক্ষীরায় যোগাদানের পর অফিসকে দুর্নীতির এক অভয়ারণ্যে পরিণত করেছিলেন। সে সময় গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানির বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে অফিসের সব ঠিকাদারকে জিম্মি করে ফেলেছিলেন।
৩ থেকে ৪ শতাংশ কমিশন না দিলে কোনো ঠিকাদার পেতেন না প্রকল্পের কাজ। এছাড়া ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন ইতিমধ্যে। তার প্রকল্পের অধিকাংশ কাজ করত কামাল এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
জানামতে, দীর্ঘ চার বছরে টেন্ডারবাজি ও দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় কয়েক শ কোটি টাকা আত্মাসাৎ করেছেন বলে দাবি তার। ঘুষের টাকায় যশোরের নিউমার্কেট এলাকায় পাঁচতলা বাড়িসহ ৮-১০টি প্লট, কয়েক বিঘা জমি, গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানীসহ বিভিন্ন স্থানে নামে-বেনামে সম্পত্তি রয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি আরো জানান, মো. শহিদুল ইসলাম ২০১২ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিতে যোগদান করলেও তার পিতার মুক্তিযোদ্ধার গেজেট হয় ২০১৬ সালে। এছাড়া তার একাডেমিক সনদ নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। চাকরির শুরুতে চার লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে গুঞ্জন শোনা যায়।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কামাল এন্টারপ্রাইজের ঠিকাদার প্রতিনিধি নজরুল ইসলাম বলেন, অফিস থেকে যে তালিকা দেওয়া হয়, সেই তালিকা অনুযায়ী আমরা ট্যাংকি বিতরণ করছি। যদি কিছু বলার থাকে তাহলে অফিসে কথা বলেন।