২০২৩ সালের নভেম্বরে বেশ ঘটা করে আইন ও শৃঙ্খলা সমন্বয় পরিষদ (এলওসিসি) এবং ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সহায়তায় ‘অনস্ট্রিট স্মার্ট পার্কিং’ ব্যবস্থা চালু করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।
স্মার্টফোনভিত্তিক অ্যাপের মাধ্যমে প্রদান করা এই সেবার কারিগরি অবকাঠামো তৈরি ও নিয়ন্ত্রণে ছিল প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ফাইবার অ্যাট হোম। সেবার বিনিময়ে পার্কিং ফি পরিশোধে আর্থিক লেনদেনের জন্য পার্টনার হিসেবে ছিল ইসলামি ব্যাংক এবং পেমেন্ট প্রসেসিং প্ল্যাটফর্ম মাস্টারকার্ড।
এই পুরো ব্যবস্থার মূল রসদ ‘পার্কিং স্পট’ ডিএনসিসির হলেও, অদ্যাবধি আয়ের কিছুই পায়নি সংস্থাটি। এমনকি কার্যক্রম শুরুর আগে মুনাফার অংশ নির্ধারণ না করেই পাইলটিংয়ের নামে বিনা টেন্ডারে এলওসিসিকে কাজটি দেয় মেয়র আতিকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন ডিএনসিসি প্রশাসন। অনস্ট্রিট স্মার্ট পার্কিং ব্যবস্থাটি বর্তমানে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকলে, আরও ১ বছরের জন্য কার্যাদেশ চায় এলওসিসি।
জানা যায়, ঢাকা মহানগরীর সড়কগুলোতে যানবাহনকে নির্ঝঞ্ঝাট পার্কিং সেবা দিতে দীর্ঘদিন থেকেই একটি সিস্টেম ডেভেলপের চেষ্টা করছিল ফাইবার অ্যাট হোম। ডিএমপি এবং এলওসিসির সহায়তায় ডিএনসিসির এই অনস্ট্রিট স্মার্ট পার্কিং ব্যবস্থার কারিগরি অবকাঠামো তৈরি করে ফাইবার অ্যাট হোম। সড়কে পার্কিং ব্যবস্থা তদারকিতে এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ আদায়ে লোকবলও নিয়োগ করে প্রতিষ্ঠানটি।
এদিকে ডিএনসিসি, ডিএমপি, গুলশান ও বনানী সোসাইটি এবং গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের প্রতিনিধিদের নিয়ে গুলশান ও বনানী এলাকার জন্য গঠিত হয় এলওসিসি। ২০২৩ সালের ৮ নভেম্বর গুলশান-২ এ ডিএনসিসি প্রধান কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন হয়।

সেই অনুষ্ঠানে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, মেয়র আতিকুল ইসলাম, ঢাকা-১৭ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী আরাফাত, পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন।
শুরুতে পার্কিংয়ের জন্য গুলশান এলাকার আটটি সড়কে স্থান বরাদ্দ দেওয়া হয়। এগুলো হলো- গুলশানের ৫২, ৫৮, ৬২, ৬৩, ৬৪ ও ১০৩নং সড়ক, ডিআইটি সার্কুলার রোড এবং গুলশান-২ ইনার সার্কুলার রোড।
স্মার্ট অ্যাপে বিদ্যমান তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এসব সড়ক গাড়ির জন্য ৮৫টি স্লট এবং মোটরসাইকেলের জন্য ৩৬টি স্লটে পার্কিংয়ের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়।
তবে সূত্র বলছে, মোটরসাইকেলের তুলনায় গাড়ি পার্কিংয়ের চাহিদা ছিল বেশি। সাধারণ নগরবাসী এবং যানবাহন চালক ও মালিকরা সে সময় এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানায় এবং অ্যাপের মাধ্যমেই সেবা নিতে শুরু করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম ৬ মাসের পাইলটিং শেষে এর মেয়াদ আরও ৬ মাস বাড়ায় সিটি করপোরেশন।
দ্বিতীয় মেয়াদে এই সেবা গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত চালু থাকার কথা ছিল। তবে জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ১৭ জুলাইয়ের পর সেবার ‘অন-গ্রাউন্ড’ কার্যক্রম থমকে যায়। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত ৮ মাস সময়ে গাড়ি ও বাইক মিলে মোট ৪৮ হাজার ৬৭৯টি যানবাহন পার্কিং সেবা নেয় এই সিস্টেমে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পার্কিং সেবার আয় থেকে ডিএনসিসি, এলওসিসি কিংবা পুলিশসহ কোন পক্ষ কত অংশ পাবে সেটি নির্ধারণের আগেই এলওসিসিকে কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দেয় সিটি করপোরেশন।
২০২৩ সালের ৮ আগস্ট ডিএনসিসির তৎকালীন প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা এলওসিসি মহাসচিব রাফেজ আলম চৌধুরী বরাবর অনুমতিপত্র ইস্যু করেন। ওই পত্রে উল্লেখিত শর্তাবলির ১৩ নম্বরে বলা হয় যে, ‘পাইলটিং পার্কিং পরিচালনার উদ্বোধনের পূর্বেই পার্কিং ফি এর অর্থ সংরক্ষণের জন্য ডিএনসিসি ও এলওসিসির নামে যৌথ হিসাব চালু করতে হবে।
আদায় করা অর্থ ওই হিসাবে সংরক্ষণ করতে হবে। পাইলটিং শেষে আলোচনা সাপেক্ষে অর্থ ব্যয় বণ্টন করা হবে।’ এই পত্রের আলোকে এলওসিসি এবং মেয়র আতিক নেতৃত্বাধীন তৎকালীন ডিএনসিসি প্রশাসন এক সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির ভিত্তিতে সে বছরের ৮ নভেম্বর অনস্ট্রিট স্মার্ট পার্কিং কার্যক্রম শুরু হয়।
তবে অনুসন্ধান বলছে, সমঝোতা চুক্তিতেও ডিএনসিসির মুনাফার বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই। উপরন্তু, এ বিষয়ক কোনো যৌথ হিসাবের বিষয়েও জানেন না ডিএনসিসি কর্মকর্তারা। ফলে অর্থ সংরক্ষিত হিসাবে সিটি করপোরেশনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
সিটি করপোরেশনের স্বার্থ নিশ্চিত না হলেও ৬ মাসব্যাপী প্রথম দফা পাইলট শেষ হলে, এলওসিসির অনুমোদন আরও ৬ মাসের জন্য বৃদ্ধি করেছিল ডিএনসিসি।
তবে সেবার এক অসম মুনাফা বণ্টনে সম্মতি দেয় আতিক প্রশাসন। ২০২৪ সালের ২০ মার্চ ডিএনসিসি এবং এলওসিসির মধ্যে অনুষ্ঠিত এক সভায় বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যে এলওসিসির পক্ষে পাইলটিং কার্যক্রমের মেয়াদ আরও ৬ মাস বাড়িয়ে ২০২৩ সালের ৭ নভেম্বর পর্যন্ত করা হয়।
এলওসিসিকে গুলশান এবং বনানীর যথাক্রমে আরও নতুন ১০টি এবং ২৯টি সড়ক ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে জরিপ সম্পাদনের পর বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পাশাপাশি সভার দুই মাসের মধ্যে এলওসিসিকে পার্কিং স্পট বরাদ্দ দিতে রাজধানীর কাওরান বাজার এবং মিরপুরের সনি সিনেমা হল থেকে চিড়িয়াখানা সড়কে জরিপ পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়।
এই সভায় প্রথমবারের মতো পার্কিং সেবা থেকে ডিএনসিসির রেভিনিউ শেয়ারিংয়ের প্রসঙ্গ আলোচিত হয়, যেখানে সিংহভাগ আয় এলওসিসিকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
পার্কিং সেবার মূল কাঁচামাল সড়ক সিটি করপোরেশনের হলেও আয়ের মাত্র ১৫ ভাগ নিতে সম্মত হয় আতিকের তৎকালীন ডিএনসিসি। আর ৮৫ ভাগই যাবে এলওসিসির পকেটে। তবে এই সিদ্ধান্তের আলোকেও ডিএনসিসি এবং এলওসিসির অদ্যাবধি কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি বলে রূপালী বাংলাদেশকে নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
এমন প্রেক্ষাপটে পাইলটিংয়ের অজুহাতে আরও ১ বছরের জন্য পার্কিং সেবা দেওয়ার কার্যাদেশ চেয়ে ডিএনসিসিতে আবেদন করেছে এলওসিসি। গত বছরের ২০ মার্চে অনুষ্ঠিত সভার সূত্রে, বর্ধিত সড়কসহ কার্যাদেশ চেয়ে গত ২২ সেপ্টেম্বর ডিএনসিসিতে এলওসিসির পক্ষে চিঠি দেন পরিষদের মহাসচিব রাফেজ আলম চৌধুরী। তবে এই চিঠিতেও ডিএনসিসির আয়ের অংশের কোনো উল্লেখ নেই।
এদিকে, টেন্ডার প্রক্রিয়া এড়াতে পাইলটিংয়ের নামে বারবার অনুমোদন চাওয়া হচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন ডিএনসিসির বর্তমান প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে করপোরেশনের এক কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, “পাইলটিংয়ের জন্য একটি সংস্থাকে কাজ দেওয়া হয়েছে।
সেই সংস্থার হয়ে ‘ব্যাক অ্যান্ড’ এ মূল কাজটি করছে আরেকটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান। কাজেই টেন্ডার প্রক্রিয়া এড়াতে বারবার পাইলটিং চাওয়া হচ্ছে কি না, সেটি একটি প্রশ্ন। আবার এই সেবার রেভিনিউ থেকে ডিএনসিসির অংশ কত হবে, সেটি প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডারের মাধ্যমে নির্ধারিত হতে পারে।
সেক্ষেত্রে, ওই প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানটিকে টেন্ডারে কাজ পাইয়ে দিতে অর্থাৎ অন্যদের তুলনায় তাদের এগিয়ে রাখতে টেন্ডার ডকুমেন্ট ওই পক্ষের সহায়ক করে তৈরিরও উদ্দেশ্য থাকতে পারত সাবেক মেয়রের।’’ যদিও এমন সম্ভাবনা নাকচ করেছে ফাইবার অ্যাট হোম।
প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, প্রতিযোগিতাপূর্ণ টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই ভবিষ্যতে পার্কিং সেবার কাজ পেতে চায় ফাইবার অ্যাট হোম। অবশ্য ইতোমধ্যে ‘অনস্ট্রিট স্মার্ট পার্কিং’ সিস্টেম ডেভেলপে মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
তবে বিনিয়োগের তুলনায় চুক্তি অনুযায়ী স্থান বাস্তবে বুঝে পায়নি বলেও দাবি প্রতিষ্ঠানটির। ফাইবার অ্যাট হোম জানায়, নগরবাসীকে উন্নত পার্কিং সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে অনস্ট্রিট পার্কিং সিস্টেম ডেভেলপ করেছে তারা। এমওইউ অনুযায়ী যে কয়টি স্থান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তার মাত্র ৪২ শতাংশ বাস্তবে বুঝে পেয়েছি।
বাকিগুলো অন্যদের দখলে। বারবার বলার পরেও সিটি করপোরেশন সেই স্থানগুলো বুঝিয়ে দেয়নি। তারপরও কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। ব্যাবসায়িক লক্ষ্যের বাইরে এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করাও বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটি।
রেভিনিউবিহীন কোনো কাজে ডিএনসিসি যাবে না উল্লেখ করে পার্কিং সেবার বিষয়ে করপোরেশনের সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এ বিষয়ে একটি কমিটি করেছি। কমিটি থেকে সিদ্ধান্ত আসলে এটা দেখবা যেটা রেভিনিউ পাই সেটা আগে দেখব।
আরবান প্ল্যানার নিয়োগ দিয়েছি। কোথায় পাবলিক স্থান পাবলিকের জন্য দেওয়া যায়, কোথায় হকার দেওয়া যায়, কোথায় পার্কিং দেওয়া যায়; এগুলো ম্যাপিং করছি। ম্যাপিং করে রোজার পরে সিদ্ধান্তে যাব। রেভিনিউ নাই, এমন কোনো কাজেই যাব না।
পার্কিং সেবাপ্রদানকারী টেন্ডারের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ এজাজ বলেন, সব ডাটা পাবলিক করে দেব। পাবলিক করে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কাজ করব; কোনো ব্যক্তিগত কাজ করব না। শতভাগ স্বচ্ছতা এবং জনগণের স্বার্থ আগে দেখা হবে। যত ধরনের জনবিরোধী চুক্তি হয়েছে, সেগুলো প্রকাশ করে দেব।
এ বিষয়ে এলওসিসির মহাসচিব রাফেজ আলম চৌধুরীর সঙ্গে কয়েক দিন একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মুঠোফোন এবং হোয়াটস অ্যাপে কল এবং লিখিত বার্তা পাঠানো হয়। বক্তব্যের জন্য এলওসিসি কার্যালয়ের এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে রাফেজ আলমের যোগাযোগ স্থাপনে সেই কর্মকর্তাকেও অনুরোধ করা হয়। তবুও এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তার পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
এদিকে সম্প্রতি গুলশানে অনস্ট্রিট স্মার্ট পার্কিংয়ের জন্য বরাদ্দকৃত স্থানগুলো সরেজমিনে দেখা যায়, সেখানে এর কোনো কার্যক্রম নেই। যদিও এখনো অ্যাপের কার্যক্রম সচল আছে। তবে বরাদ্দকৃত স্থানগুলো অন্যরা দখল করে নিজেদের মতো যানবাহন পার্কিং করছে।
স্থানগুলোতে অবশ্য এখনো অনস্ট্রিট স্মার্ট পার্কিংয়ের সাইনবোর্ড রয়েছে। ফলে অ্যাপ সচল থাকলেও বাস্তবে মুখ থুবড়ে পড়েছে পার্কিং ব্যবস্থাটি। যথাযথ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় সম্পদের সর্বোচ্চ স্বার্থ নিশ্চিত করে পার্কিং সেবা দ্রুত চালুর দাবি জানিয়েছেন সাধারণ নগরবাসী।
আপনার মতামত লিখুন :