জাতীয় নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে বিএনপি। সে লক্ষ্যে সংসদের এলডি হলে আয়োজন করা হয়েছিল বর্ধিত সভা। দলটির সব মনোযোগ এখন নির্বাচন ঘিরে। প্রয়োজনীয় ন্যূনতম সংস্কার শেষ করে যত দ্রুত সম্ভব দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন।
এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপেও রাখতে চায় দলটি। নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানামুখী আলোচনার মধ্যে অর্ধযুগেরও বেশি সময় পর বর্ধিত সভা করেছে বিএনপি।
রাষ্ট্র মেরামতের ন্যূনতম সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে দলটির বর্ধিত সভায় লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এই কথা বলেন।
দেশ আজ সংকটময় সময় অতিক্রম করছে উল্লেখ করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, আপনাদের এবং ছাত্রদের সমন্বিত আন্দোলনের ফলে ফ্যাসিস্ট শাসক বিদায় নিয়েছে।
একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে, তাদের কাছে জনগণের প্রত্যাশা রাষ্ট্র মেরামতের ন্যূনতম সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করা।
তিনি বলেন, দীর্ঘ ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে যারা শহিদ হয়েছেন, সম্প্রতি জুলাই-আগস্টে ফ্যাসিবাদের ভয়াবহ দমন নীতির কারণে গণহত্যায় যারা শহিদ হয়েছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। যারা আহত হয়েছেন তাদের প্রতি জানাচ্ছি আন্তরিক সমবেদনা। আমি চিকিৎসার কারণে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করলেও সবসময় আপনাদের পাশেই আছি।
খালেদা জিয়া বলেন, দীর্ঘ ১৫ বছর গণতন্ত্রের জন্য, আমার মুক্তির জন্য আপনারা যে নিরন্তর সংগ্রাম করেছেন এবং অসংখ্য নেতাকর্মী প্রাণ দিয়েছেন, গুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, সোয়া লাখ মামলায় জড়িয়ে ন্যায়বিচারের জন্য এখনো আদালতের বারান্দায় দৌড়াচ্ছেন, আপনাদের গণতন্ত্রের জন্য এই ত্যাগ শুধু দল নয়, এই জাতি চিরকাল স্মরণ রাখবে।
এর আগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে দেশে স্বৈরাচারের দোসররা পুনর্বাসিত হবে। দলটির বর্ধিত সভায় লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এই মন্তব্য করেন।
তারেক রহমান বলেন, গণতন্ত্রকামী জনগণ মনে করে, স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সেটি হবে সারা দেশে পলাতক স্বৈরাচারের দোসরদের পুনর্বাসনের একটি প্রক্রিয়া যা সরাসরি গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষাবিরোধী। গণহত্যাকারী টাকা পাচারকারী দুর্নীতিবাজ মাফিয়া চক্রকে পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার এই ফাঁদে বিএনপি পা দেবে না।
বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচার করবে জানিয়ে বলেন, বিএনপি জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি জনরায়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে গণহত্যাকারী-মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সারা দেশে গণহত্যাকারীদের দোসর মাফিয়া চক্রকে পুনর্বাসনের ‘স্থানীয় নির্বাচন’ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা থেকে সরে আসুন। অবিলম্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আগামী দিনের সুনির্দিষ্ট ‘কর্ম পরিকল্পনার রোডম্যাপ’ ঘোষণা করুন।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন নিয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা পাচ্ছেন না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হল প্রাঙ্গণে বিএনপির বর্ধিত সভার স্বাগত বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, দেশের মানুষের অনেক আশা-ভরসা- ৫ আগস্ট পরিবর্তনের পরে, ফ্যাসিস্ট হাসিনা দেশ থেকে পলায়নের পরে, আমাদের দেশের অবস্থার পরিবর্তন হবে। অতিদ্রুত দেশের জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হবে, তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন এবং তাদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারবেন। কিন্তু আমরা দুঃখের সঙ্গে দেখছি, সে লক্ষ্যে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আমরা পাচ্ছি না।
মির্জা ফখরুল বলেন, আপনারা দেখেছেন, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি বিএনপিকে গণতন্ত্রের জন্য, জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য কি পরিমাণ ত্যাগের মধ্য দিয়ে সংগ্রাম করছে।
ইতোমধ্যে দেশের অর্থনীতির অবস্থা অত্যন্ত সূচনীয়, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আইনশৃঙ্খলা অবস্থার অবনতি হচ্ছে। ক্রমান্বয়ে শিক্ষাঙ্গনগুলো বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার পরিবেশ থাকছে না।
অবিভক্ত বাংলায় যেসব বরেণ্য, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, যারা বিশেষ করে পূর্ব বাংলার ভূখণ্ডে জন্ম হয়েছিল তাদের নামগুলোকে বাদ দিয়ে এখন কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নামকরণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ তুলেন মির্জা ফখরুল। তিনি আরও বলেন, আমরা ফ্যাসিবাদকে তাড়িয়েছি, শেখ হাসিনাকে তাড়িয়েছি।
আমরা এখন অপেক্ষা করছি আমাদের দেশের জনগণের যে আশা-আকাক্সক্ষা, আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের যে স্বপ্ন- একটি আধুনিক, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ রূপান্তরিত করার, সেই গণতন্ত্রকে বিঘ্নিত করার জন্য, বাধাগ্রস্ত করার জন্য একটি মহল বিভিন্নভাবে চক্রান্ত করার চেষ্টা করছেন। বাইরে থেকেও চেষ্টা করা হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তর থেকেও কিছু কিছু গোষ্ঠী ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এদিকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগের পতনের পর কিছুটা হলেও মুক্তি এবং স্বস্তির পরিবেশ বিরাজ করছে।
যারা এই ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনার বর্বোরচিত শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল, তারা ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনেকে আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেছে। এখনো কোনো তাদের হদিস মেলেনি। কত আয়নাঘরে বন্দি ছিল।
কতজন যে অকথ্য অত্যাচারের শিকার হয়েছেন, তারপর কোথায় তাদের ফেলে রাখা হয়েছে এখনো পর্যন্ত তাদের হদিস পাওয়া যায়নি। কত নেতাকর্মী এবং দেশের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ হারিয়ে গেছেন তার অন্ত নাই। আমরা এদের সবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
রিজভী বলেন, দীর্ঘ রক্তস্রোত আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ মুক্ত পরিবেশে আজ দলের বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বর্ধিত সভার শুরুতেই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে দলের প্রতিষ্ঠাতা ও মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীরবিক্রম, এ দেশের বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদের প্রবর্তক ছিলেন শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ন্যায়, নিষ্ঠা, সততা এবং দেশপ্রেমের এক অনন্য ক্ষণজন্ম পুরুষ বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান। যিনি তার রেখে যাওয়া পতাকাকে হাতে ধারণ করে যখনই গণতন্ত্র বিপন্ন হয়েছে, যখনই দেশ বিপন্ন হয়েছে, তখনই তিনি দেশের পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে আপসহীন থেকে গণতন্ত্রের পক্ষে সংগ্রাম করেছেন।
সেই গণতন্ত্রের প্রতীক দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনা করে ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব নেতাকর্মী সমর্থকবৃন্দ মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের সবাইকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। আজকের বর্ধিত সভায় শোক প্রস্তাব গ্রহণ করছি।
এ ছাড়া আমরা যাদের হারিয়েছি দেশের বিশ্ববরেণ্য নেতৃত্ব সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, সুরকার, গীতিকার যারা চলে গেছেন পৃথিবী থেকে আমরা তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
বর্ধিত সভায় সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। প্রধান অতিথি ছিলেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। উপস্থিত ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, নজরুল ইসলাম খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সালাহউদ্দিন আহমেদ, বেগম সেলিমা রহমান এবং হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। এ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সদস্য, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সব কর্মকর্তা ও সদস্যগণ, সব মহানগর, জেলা, থানা-উপজেলা-পৌর কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক অথবা আহ্বায়ক ও সদস্য সচিববৃন্দ।