দেশীয় প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন নিয়মিত কমছে। ফলে ঘাটতি পূরণে চড়া দামে বিদেশ থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে হয়। এতে সংকটে থাকা বৈদেশিক মুদ্রা ডলারের রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। উৎপাদন কমতে থাকলে আমদানি আরও বাড়তে থাকবে।
এই পরিস্থিতি সামলাতে দেশে গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে নতুন কূপ খনন, সাইসমিক জরিপে নতুন প্ল্যান্ট সংগ্রহ এবং রিগ কেনার প্রকল্প নিতে যাচ্ছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়কে।
তাই ১৫টি প্রকল্পের জন্য ২ হাজার ২২৫ কোটি টাকা অর্থ বিভাগের কাছে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক চিঠির সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এর একটি অনুলিপি রূপালী বাংলাদেশের হাতে এসেছে।
বাপেক্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মর্তুজা আহমদ ফারুক চিশতী বলেন, স্থানীয় গ্যাসের উত্তোলন বৃদ্ধি ও নতুন মজুদ আবিষ্কারের প্রয়োজন রয়েছে। তবে স্থলভাগে যেসব এলাকা এখনো অনাবিষ্কৃত বা যেসব স্থানে অনুসন্ধান চালানোর মতো কারিগরি সক্ষমতা বাপেক্সের নেই, সেসব এলাকায় বিদেশি কোম্পানিগুলোকে কাজে লাগানো যেতে পারে।
বিদেশি কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে বিবিয়ানা, তিতাসের মতো বড় গ্যাসফিল্ড আবিষ্কার হয়েছে। এখন সেটা কেন করা যাচ্ছে না? বরং এখন বিদেশি কোম্পানিগুলো ঠিকাদারের মাধ্যমে কূপ খনন, সংস্কার ও ওয়ার্কওভারের কাজ করাচ্ছে। এর চেয়ে বরং স্থলভাগে পিএসসি চুক্তি করে বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে অনুসন্ধান-আবিষ্কারের জন্য বড় আকারে কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
চিঠিতে অর্থ বিভাগের সচিব ড. মো. খায়েবুজ্জামান মজুমদারকে বলা হয়েছে, দেশজ তেল-গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে কূপ খনন, কূপ ওয়ার্কওভার, দুটি রিগ ক্রয়, ইআরএস ইউনিট-২ নির্মাণ, ২ডি এবং ৩ডি সাইসমিক জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা, খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান, বিস্ফোরক পরিদপ্তরের সক্ষমতা বাড়ানো, জিএসবির খনন সক্ষমতা বাড়ানো ও শক্তিশালীকরণসহ সাতটি প্রকল্প বাস্তবায়ন, বিপিআইয়ের প্রশিক্ষণ সক্ষমতা বাড়ানো ইত্যাদি প্রকল্প সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের ২০২৫-২০১৬ অর্থবছরে বাজেট বরাদ্দের অতিরিক্ত ২ হাজার ২২৫ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রতিশ্রুতির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
জানা গেছে, ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে চারটি প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদিত হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন ও একনেকে অনুমোদনের জন্য অপেক্ষমাণ ছয়টি প্রকল্পের জন্য ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে ৫২৫ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। এসব প্রকল্পের মধ্যে তিতাস ও বাখরাবাদ ফিল্ডে দুটি গভীর অনুসন্ধান কূপ খননের জন্য (অনুমোদনের জন্য অপেক্ষমাণ) ২৫০ কোটি টাকা চাওয়া হলেও অর্থ বিভাগ মনে করে, ৮৬ কোটি টাকা আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ দিলেও হবে।
ভুপিটিলা ১ ও কৈলাশটিলা ৯ নম্ব কূপ (অনুসন্ধান কূপ) খননের (প্রশাসনিক আদেশ জারির অপেক্ষাধীন) জন্য ১২০ কোটি টাকা চাওয়া হলেও অর্থ বিভাগ ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে চায়। রশিদপুর ১১ নম্বর কূপ খননের (অনুসন্ধান কূপ) জন্য ৫০ কোটি টাকা এবং হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ ও মেঘনা ফিল্ডে ৩-ডি সাইসমিক জরিপের (অনুমোদনের জন্য অপেক্ষমাণ) জন্য ৭৫ কোটি টাকা চাওয়া হলেও অর্থ বিভাগ ৩২ কোটি টাকা দিতে চায়।
২ডি সাইসমিক সার্ভে ওভার এক্সপ্লোরেশন ব্লক ৭ ও ৯-এর জন্য ২০ কোটি টাকা এবং ভোলা নর্থ গ্যাসফিল্ডের জন্য ৬০ এমএমএসপিএফডি ক্ষমতাসম্পন্ন প্রসেস প্ল্যান্ট সংগ্রহ ও স্থাপনের জন্য ১০ কোটি টাকা চেয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
এদিকে দেশে তেল-গ্যাস কূপ খনন, কূপ ওয়ার্কওভার, সাইসমিক জরিপ, পাইপলাইন স্থাপন, রিগ ক্রয়, খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান, সক্ষমতা বৃদ্ধিসংক্রান্ত উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের বাজেটে ৯টি প্রকল্পের জন্য ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে।
এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে- একটি নতুন রিগ ক্রয় প্রকল্পের জন্য ৬০০ কোটি টাকা চাওয়া হলেও অর্থ বিভাগ মনে করে আগামী অর্থবছরের জন্য ৫৮ কোটি টাকা হলেও চলবে। ইনস্টলেশন অব ইআরএল ইউনিট-২ প্রকল্পের জন্য ৩০০ কোটি টাকা, ভোলা-বরিশাল-খুলনা গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ২০০ কোটি টাকা, ভোলা অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে পাঁচটি কূপ খনন প্রকল্পের জন্য ১০০ কোটি টাকা, ৩ডি সাইসমিক সার্ভে ওভার চরফ্যাশন-মনপুরা-হাতিয়া প্রকল্পের জন্য ১০০ কোটি টাকা, বাপেক্সের সাইসমিক জরিপ ও খনন সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের জন্য ১০০ কোটি টাকা, বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের খনন সক্ষমতা বৃদ্ধি ও শক্তিশালীকরণ এবং বাংলাদেশের প্রধান প্রধান নদীবক্ষের বালুতে মূল্যবান খনিজের অনুসন্ধান কার্যক্রমসহ আরও নতুন সাতটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ১০০ কোটি টাকা, বিস্ফোরক পরিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণে ল্যাবসহ নিজস্ব ভবন নির্মাণ প্রকল্প ৫০ কোটি টাকা এবং বিপিআইয়ের প্রশিক্ষণ সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ৫০ কোটি টাকা চেয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
জানা গেছে, দেশে স্থানীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্যাস উত্তোলনে নিয়োজিত রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত তিন কোম্পানি। গ্যাসের উত্তোলন ও সরবরাহ বাড়াতে পেট্রোবাংলার অধীন কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে নতুন কূপ খনন এবং বিদ্যমান কূপের মেরামত ও সংস্কারের (ওয়ার্কওভার) উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করবে বিদেশি তিন কোম্পানি। এগুলো হলো রাশিয়ার গ্যাজপ্রম, চীনের সিনোপ্যাক ও উজবেকিস্তানের এরিয়েল। স্থলভাগে ১৭টি কূপে কাজ করবে দিতনটি বিদেশি কোম্পানি।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২৫ সাল নাগাদ ৪৬টি কূপ খনন ও ওয়ার্কওভারের মাধ্যমে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এসব কূপ খননের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের দৈনিক সরবরাহ ৬১৫ মিলিয়ন ঘনফুট বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৭টি কূপে কার্যক্রম চালাতে যাচ্ছে বিদেশি তিন প্রতিষ্ঠান। জ্বালানি বিভাগ এখন কোম্পানিগুলোর এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবের আর্থিক বিষয়াদি খতিয়ে দেখছে।
সার্বিক অনুমোদন প্রক্রিয়া শেষে ভোলায় বাপেক্সের আওতাধীন পাঁচটি কূপে খনন কার্যক্রম চালাবে রুশ কোম্পানি গ্যাজপ্রম। আগেও সেখানে কোম্পানিটির মাধ্যমে কূপ খননের কাজ করিয়েছে বাপেক্স। চীনা কোম্পানি সিনোপ্যাক খনন করবে সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের (এসজিএফসিএল) আওতাধীন পাঁচটি কূপ। আর বিভিন্ন জেলায় বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) আওতাধীন সাতটি কূপে খনন চালাবে উজবেক কোম্পানি এরিয়েল।
ভোলার আওতাধীন পাঁচটি কূপ খননে গ্যাজপ্রমের দেওয়া প্রস্তাবের কারিগরি ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলো মূল্যায়ন শেষে এরই মধ্যে জ্বালানি বিভাগে প্রতিবেদন দিয়েছে বাপেক্স। এই প্রস্তাব নিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে বৈঠকও হয়েছে। বর্তমানে বিষয়টি নিয়ে গ্যাজপ্রমের সঙ্গে জ্বালানি বিভাগের দর-কষাকষি চলছে। বাপেক্স সূত্রে জানা গেছে, এই পাঁচ কূপের মধ্যে অনুসন্ধান কূপ একটি, বাকিগুলো উন্নয়ন কূপ। এগুলো খননের জন্য রুশ কোম্পানিটি ১২০ মিলিয়ন ডলার চেয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাপেক্সের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পাঁচটি কূপ খননে গ্যাজপ্রম কাজ পাচ্ছে এটি নিশ্চিত। তারা পাঁচটি কূপ খননে ১২০ মিলিয়ন ডলার চেয়েছে। জ্বালানি বিভাগ থেকে তাদের প্রস্তাবিত মূল্য কমানোর কথা বলা হয়েছে। তবে প্রকল্পের খরচ আরও বাড়তে পারে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, স্থানীয় গ্যাসের সংকট মোকাবিলা এবং সরকারের কূপ খননের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাপেক্সের পাশাপাশি বিদেশি কোম্পানিরও প্রয়োজন রয়েছে। কারণ এতগুলো কূপ খনন এখন বাপেক্সের একার পক্ষে সম্ভব নয়। সেই পরিমাণ রিগ ও জনবল তাদের নেই।
তবে এখানে দেখতে হবে বাপেক্সের সক্ষমতা বসিয়ে রেখে বিদেশি কোম্পানিকে কাজ দেওয়া হচ্ছে কি না এবং অনেক বেশি মূল্যে কাজ দেওয়া হচ্ছে কি না। যদি সেটি হয়ে থাকে, তাহলে তা হবে দেশের জ্বালানি খাতের জন্য নেতিবাচক।
পেট্রোবাংলা বলছে, গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহ একটা পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য কূপ সংস্কারে জোর দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ১৬টি কূপ সংস্কারের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে সাতটি কূপের কাজ শেষে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে। সব কটি শেষ হলে উৎপাদন আরও বাড়বে। এখন কূপ খননের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) দ্রুত অনুমোদন করে দিচ্ছে জ্বালানি বিভাগ।
দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। সাধারণত ৩০০ কোটি ঘনফুটের মতো সরবরাহ করে মোটামুটি সামলানো হচ্ছিল কয়েক বছর ধরে। এর মধ্যে দেশীয় গ্যাস থেকে আসত ২২০ কোটি ঘনফুট। বাকিটা এলএনজি আমদানি করে মেটানো হতো।
দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর না দিয়ে আমদানির দিকে ঝুঁকে যায় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। এতে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন টানা কমতে থাকে। এখন এটি ২০০ কোটি ঘনফুটের নিচে নেমে এসেছে। আবার চড়া দামের কারণে চাহিদামতো এলএনজি আমদানিও করা যায়নি। ব্যাপক সংকটে পড়ে ২০২২ সালের মাঝামাঝি ৫০টি কূপ খননের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এটিও অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়ন করা হয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর দিয়ে কূপ খননের কাজ হাতে নিয়েছে। আগামী বছর থেকে আরও ১০০ কূপ খননের পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাসের সংকট সমাধানে দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই। যথাযথ সংস্কার ও প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটিয়ে পুরোনো গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। একই সঙ্গে দেশের স্থলে ও সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে জোর তৎপরতা চালাতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :