নামে বিমানবন্দর হলেও কুমিল্লা বিমানবন্দরের ভেতরে গেলেই দেখা মিলবে ডেইরি ফার্ম। আর আশপাশের জমিতে রয়েছে ধান-গমসহ বিভিন্ন ফসল। তবে এর মধ্যেই রয়েছে সেনাবাহিনীর একটি ছোট্ট ঘাঁটি। ঘাঁটিতে কয়েকজন সৈনিক ও কর্মচারী থাকলেও বাইরে একেবারেই সুনসান নীরবতা।
অবশ্য সেখানে বিমানবন্দরের সাইনবোর্ডসহ দু-তিনটি ভবনও রয়েছে। কর্মরত আছেন ২৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। দেখে বোঝার উপায় নেই, একটা সময় বন্দরটি হাজারও মানুষের পদচারণে মুখর ও কর্মব্যস্ততা ছিল।
কুমিল্লা নগরীর ঢুলিপাড়া, নেউরা ও রাজাপাড়া এলাকায় অবস্থিত এই বিমানবন্দরের আয়তন ৭৭ একর। দীর্ঘদিন অব্যবহৃত ও পরিত্যক্ত থাকায় রানওয়ের শক্তি পিসিএন (পেভমেন্ট ক্লাসিফিকেশন নম্বর) নষ্ট হয়ে গেছে। চারপাশে ধুলাবালি আর ঘাসের স্তর জমেছে। ভেঙে গেছে পিসঢালাই ও ব্লক। যত্নের অভাবে এখন রুগ্ণ দশা। প্রশাসনিক শাখার সাইনবোর্ডটি না থাকলে বোঝার উপায় নেই এটি একটি বিমানবন্দর।
জানা যায়, ১৯৯৪ সাল থেকে বন্দরটিতে বিমান ওঠা-নামা করে না। অবশ্য কিছু যন্ত্রপাতি এখনো বিদ্যমান। তবে বিভিন্ন দেশের সিগন্যাল ব্যবহার করে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৫-৩০ লাখ টাকার রাজস্ব আয় করছে সরকার।
এ রুটে চলাচল করছে আন্তর্জাতিক ৩৫-৪০টি বিমান। উদ্যোগ নিলে আবারও প্রাণ ফিরে পেতে পারে প্রাচীন এ বিমানবন্দর। এমনটিই মনে করছে বিমান কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয়রা। তাদের দাবি, ১৯৯৪ সাল আর এখনকার প্রেক্ষাপট এক নয়। ইপিজেড ও রেমিট্যান্স আয়ে কুমিল্লার শক্ত অবস্থানের কারণে বর্তমানে এটি চালু করা সময়ের দাবি।
বিমানবাহিনী সূত্রে জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তড়িঘড়ি করেই ১৯৪১-৪২ সালে কুমিল্লা শহরতলির দক্ষিণে ৩ কিলোমিটার দূরে নেউরা, ঢুলিপাড়া ও রাজাপাড়া এলাকার ৭৭ একর জমিতে এ বিমানবন্দরটি স্থাপন করে যুক্তরাজ্য। এখান থেকে দেশটির কিছু যুদ্ধবিমান ওঠা-নামা করত জাপানি বিমানকে পাহারা দেওয়ার জন্য।
মাঝে পাকিস্তান আমলসহ ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচল করত। পরবর্তী সময়ে অজ্ঞাত কারণে প্রাচীন এ বিমানবন্দরটির কার্যক্রম শিথিল হয়ে যায়। মাঝে ১৯৯৪ সালে আবারও বন্দরটি চালু করা হয়। কিন্তু তখন পর্যাপ্ত যাত্রী না থাকায় দুই সপ্তাহের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ফ্লাইট ওঠা-নামা বন্ধ।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিমান ওঠা-নামা না করলেও বিমানবন্দরটি এখনো চালু রয়েছে। সক্রিয় রয়েছে শর্ট টেক অব ল্যান্ড ল্যান্ডিং (স্টক)। প্রতিদিনই এ বন্দরের সিগন্যাল ব্যবহার করছে দেশ-বিদেশের অন্তত ৪০টি এয়ার বাস। যা থেকে বছরে কমপক্ষে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার রাজস্ব পাচ্ছে সরকার।
এখান থেকে আন্তর্জাতিক রুটের সবচেয়ে বেশি সিগন্যাল ব্যবহার করে ভারতের অভ্যন্তরীণ রুট, ব্যাংকক ও সিঙ্গাপুরের বিমান। তা ছাড়া আগরতলা বিমানবন্দরে যাওয়া বিমানও এ রুটে চলাচল করে।
এ বিমানবন্দরটির নেভিগেশন ফ্যাসিলিটিস, কন্ট্রোল টাওয়ার, ভিএইচএফ সেট, এয়ার কমিউনিকেশন যন্ত্রপাতি, ফায়ার স্টেশন ও ফায়ার সার্ভিসসহ সব সুবিধাই রয়েছে। কর্মরত রয়েছেন ২৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। যাত্রীদের জন্য আলাদা কক্ষও আছে। সব সুবিধা থাকার পরও শুধু উদ্যোগের অভাবে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বিমান ওঠা-নামা করছে না। এটি নিয়ে জোরালো কোনো পদক্ষেপও নেই।
কর্তৃপক্ষ বলছে, বন্দরটি চালু করতে খুব বেশি অর্থেরও প্রয়োজন নেই। শুধু উদ্যোগ নিয়ে রানওয়ে মেরামত, ফায়ার সার্ভিস ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ারের কয়েকজন জনবল নিয়োগ করলেই এখান থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচলের পাশাপাশি কলকাতা, আগরতলাসহ বিভিন্ন রুটে যেকোনো সময় ফ্লাইট চালু করা সম্ভব। এ জন্য মাত্র ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দই যথেষ্ট।
যাত্রীসংকটের কারণে ১৯৯৪ সালে দ্বিতীয় দফা কুমিল্লা বিমানবন্দরের ফ্লাইট স্থগিত করা হয়। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে নানা দিক থেকে এগিয়েছে কুমিল্লা। ইপিজেড ও বিসিক শিল্পনগরীসহ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে রয়েছে শতাধিক কলকারখানা। যেখানে ব্যাবসায়িক কাজে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ী, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে আসা-যাওয়া করতে হয়।
ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত রয়েছেন এ জেলার ৫০ হাজারের বেশি জনশক্তি। এখানেই রয়েছে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমিসহ রাষ্ট্রীয় অনেক প্রতিষ্ঠান। আবার কুমিল্লা বিভাগও বাস্তবায়নের পথে। সময়ের ব্যবধানে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হলেও ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলা থেকে সড়কপথে কুমিল্লায় যাতায়াত করতে অনেক সময় যানজটের কবলে পড়তে হয়।
অথচ বিমানপথে মাত্র ২৫ মিনিটে ঢাকা-কুমিল্লা যাতায়াত করা সম্ভব। এতে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগব্যবস্থার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। কুমিল্লা ছাড়াও উপকৃত হবেন চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের মানুষ।
কুমিল্লার বিসিক শিল্পনগরীর সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, গত তিন দশকে কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে ফেনী পর্যন্ত অসংখ্য কল-কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন চীন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীরা। সড়কপথে চলাচল করতে অনেক সময় তাদের সময়ের অপচয় ঘটে।
বিমান যোগাযোগ থাকলে হয়তো এমনটি হতো না। বিমানবন্দরে বিমান ওঠা-নামা চালু হলে ইপিজেড ও বিসিক শিল্পনগরীতে বিদেশি বিনিয়োগ আরও বাড়বে।
কুমিল্লা দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জামাল খন্দকার বলেন, বন্ধ বিমানবন্দরটি উন্মুক্ত হলে এ অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থার পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রও প্রসারিত হবে। কার্গো বিমানে মালামাল আনা-নেওয়া করতে পারব। তাতে আমরা সবাই উপকৃত হব। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে বন্দরটি চালু করা দরকার।
চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ডা. আজম খান নোমান বলেন, কুমিল্লায় দিনদিন ব্যবসার পরিধি বাড়ছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের মাঝামাঝি হওয়ায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের চোখ কুমিল্লার দিকে।
যাতায়াতব্যবস্থা আরও উন্নত হলে সবার জন্যই সুবিধা। তা ছাড়া ইউরোপসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে কর্মরত কুমিল্লার প্রবাসীর সংখ্যাও ১৩ শতাংশের বেশি। সুযোগ পেলে তারাও বিমানে চড়বেন। তাই বন্ধ হওয়া বিমান ফ্লাইট পুনরায় চালু করা সময়ের দাবি।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) কুমিল্লার সভাপতি অধ্যাপক নিখিল চন্দ্র রায় বলেন, কুমিল্লা একটি ঐতিহ্যবাহী শহর। এখানে প্রয়োজনের সব কিছুই আছে। বিমানবন্দরটি চালু হলে আমাদের সমৃদ্ধি আরও বাড়বে।
কুমিল্লা বিমানবন্দরের সিএনএস প্রকৌশলী নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ফ্লাইট স্থগিত থাকলেও এটি এখনো সরকারের লাভজনক প্রতিষ্ঠান। কারণ সিগন্যাল ব্যবহার করে প্রতিদিনই রাজস্ব আয় হচ্ছে। আর ফ্লাইট চালু হলে কুমিল্লার গুরুত্ব আরও বাড়বে। ফলে এখানেও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। পরিকল্পিত উদ্যোগ নিলে আবারও প্রাণ ফিরে পাবে বন্দরটি।
কুমিল্লা বিমানবন্দরের এমডি তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ফ্লাইট চালু না থাকলেও প্রতিদিনই এখান থেকে সিগন্যাল ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক রুটের ৩৫-৪০টি বিমান। এতে বছরে সরকারের রাজস্ব আয় হয় দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা। যা সম্পূর্ণ তদারকি করছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
বর্তমানে আমাদের এখানে জনবল রয়েছে ২৪ জন। রানওয়ে মেরামতসহ কিছু যন্ত্রপাতি স্থাপনের পাশাপাশি আরও ২০-২২ জন লোকবল নিয়োগ দিলে যেকোনো সময় ফ্লাইট চালু করা সম্ভব। বন্দরটি চালুর বিষয়ে আমরাও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছি।
আপনার মতামত লিখুন :