দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে শুরু করা হয় অপারেশন ডেভিল হান্ট। বিগত বেশ কয়েক দিন ধরে এই অভিযান চললেও শয়তানের তৎপরতা কমার বদলে চুরি-ছিনতাই-ডাকাতি-খুন ও ধর্ষণ চলছে একই গতিতে।
জানা যায়, ডেভিল হান্ট অপারেশনেও স্বস্তি না ফিরে এতে মানুষের মধ্যে বেড়েছে আতঙ্ক। এ অবস্থায় দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারকে আরও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞদের দাবি-দলমত নির্বিশেষে প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা না গেলে পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। তবে সন্ত্রাস দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, অপরাধ দমনে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি সমাজের সচেতনতা বাড়াতে হবে। পুলিশি ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করতে হবে, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা দরকার। বর্তমান পরিস্থিতিতে চোখ-কান খোলা রেখে সরকারকে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
ড. তৌহিদুল হক বলেন, ডেভিল হান্ট অপারেশনের যে লক্ষ্য তা যেন সামগ্রিকভাবে পরিচালিত হয়। অর্থাৎ এটি শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা প্রশ্ন এবং আইনশৃঙ্খলার নিরাপত্তা প্রশ্নও খুব একটা ফলাফল তৈরি করবে না।
পুলিশের সূত্র ও বিভিন্ন জরিপ অনুযায়ী, দেশে গত ৩ মাসে অন্তত ১২৫টির বেশি জায়গায় প্রকাশ্যে গুলিবর্ষণ করে চুরি-ছিনতাই-ডাকাতি-খুন ও ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে এক শিশুকে হত্যার ঘটনায় ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করেছে।
জানা গেছে, গতকাল শুক্রবার মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে নিখোঁজের দুই দিন পর দিঘি থেকে ফাতেমা আক্তার নামের ছয় বছরের এক শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় সাব্বির নামের একজনকে আটকের পর রিমান্ডে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। ধর্ষণচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে শ্বাসরোধে হত্যার পর গুমের উদ্দেশ্যে তার মরদেহ ফেলে দেওয়া হয় দিঘিতে।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, ওয়াজ মাহফিলে যায় ফাতেমা। পরে সেখানে থাকবে বলে বায়না ধরলে তার খালা মাদ্রাসাপড়ুয়া ফাতেমার বড় ভাই ইসমাইলের কাছে তাকে রেখে আসে। কিন্তু ইসমাইল তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে ফাতেমা খেলাচ্ছলে রাস্তার দিকে গিয়ে নিখোঁজ হয়।
স্থানীয়রা ওয়াজ-মাহফিলের আইসক্রিম বিক্রেতা সাব্বিরকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করে পুলিশে দেয়। এ ঘটনায় ফাতেমার মা (মামলার বাদী) বিলকিস বেগম বলেন, ‘সাব্বিরকে প্রধান অভিযুক্ত করে সিরাজদিখান থানায় অপহরণ মামলা করেছি আমরা।
ধর্ষণচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে শ্বাসরোধে হত্যার পর লাশ গুম করতে দিঘিতে ফেলে দেয়। আমরা এ ঘটনার সঠিক বিচার পাব কি না, বলতে পারছি না। তবে সঠিক বিচার চায় এবং সাব্বিরের ফাঁসি চাই।’
সিরাজদিখান থানার ওসি শাহেদ আল মামুন জানান, এ ঘটনায় দায়েরকৃত অপহরণ মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তর হয়েছে। শিশুটি সিরাজদিখানে ওয়াজ মাহফিল শোনাকে কেন্দ্র করে ধর্ষণের শিকার হন। প্রাথমিক তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এর আগে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় স্বামীর নির্যাতনের ভিডিও দেখিয়ে স্ত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি নাজমুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। র্যাব-১১-এর লেফটেন্যান্ট কর্নেল (সিও) এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন এসব তথ্য জানান।
অন্যদিকে রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে প্রায় ছয় বছর আগে ট্রেনের পরিত্যক্ত বগিতে প্রেমিকাকে ধর্ষণের পর হত্যার দায়ে মারুফ হাসান বাঁধন নামের এক যুবকের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। পুলিশ সদর দপ্তরের নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, গত দুই সপ্তাহে ধর্ষণের অভিযোগে অন্তত ৪৪টির বেশি ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে।
এসব ঘটনায় মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিস কেন্দ্র বলেছে, নারীর প্রতি সহিংসতা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, খুন, শারীরিক নির্যাতন ও নিপীড়ন, অপহরণ অনেকটাই প্রকট আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও তাদের এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার শিকার হতে দেখা যাচ্ছে, যা কাম্য নয়।
রাজধানীর ধানমন্ডির বাসিন্দা আদিবা নুসরাত বলেন, ‘আগে কখনো আমাকে ধানমন্ডি এলাকায় হয়রানি হতে হয়নি। কয়েক দিন আগে রিকশায় বাসায় ফেরার পথে কিছু উচ্ছৃঙ্খল ছেলের ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছি, যা নিজের এলাকায় কখনো কল্পনাও করিনি।’
গত দুই থেকে তিন সপ্তাহে ছিনতাই, ডাকাতি ও প্রকাশ্যে কুপিয়ে জখম করার মতো কয়েক ডজন ঘটনায় দেশজুড়ে নাগরিকরা নিরাপত্তাহীনতায় উদ্বেগের কথা জানান। সন্ধ্যার পর চলাচলে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আতঙ্কের কথা জানান।
গত সপ্তাহে রাজধানীর উত্তরায় এক দম্পতিকে কুপিয়ে জখম করার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। এরপর গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে একটি বাসে ডাকাতি ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া যায়। গত রোববার রাতেও রাজধানীর বনশ্রীতে ব্যবসায়িকে গুলি করে স্বর্ণ ছিনতাই ও একই দিন বিভিন্ন জায়গায় ছিনতাই ও ডাকাতির খবরে শহরজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
এ বিষয়ে ডিএমপির বনানী থানা, গুলশান, পল্টন, শেরেবাংলা থানাসহ একাধিক থানার পুলিশের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, ‘মানুষ এখন সবাই ত্যাগী, প্রতিবাদী ও নিযার্তনের শিকার বলে দাবি করে। এ জন্য তারা আমাদের মানতে চায় না।’
পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক নাজমুল হক বলেছেন, ব্যাপক বদলি-ওএসডিতে স্বাভাবিক মনোবল নিয়ে কাজ করতে পারছে না পুলিশ। পুলিশ যেভাবে হেলেদুলে কাজ করছে, তাতে মনে হচ্ছে বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উত্তরণে দীর্ঘ সময় লাগবে। পুলিশ তার মনোবল হারিয়েছে, কোনোভাবেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে না।
তবে পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্রের দাবি, পুলিশের চেষ্টার কমতি নেই। অপারেশন ডেভিল হান্টে অসংখ্য আসামিকে ধরা হচ্ছে, যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে সন্ত্রাস দমনে সেনা নেতৃত্বাধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর যৌথ অভিযান ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ চলার মধ্যেই বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আকস্মিক অবনতি সরকার, রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে।স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, সেনাপ্রধান ও পুলিশপ্রধানসহ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বারবার সতর্ক করলেও জনমনে স্বস্তি ফেরেনি বলে অভিযোগ করেছেন সাধারণ মানুষ।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভসহ নানা ধরনের কর্মসূচিও পালন করেছেন শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তাতেও তেমন কোনো পরিবতন হয়নি বলে দাবি নগরবাসীর।
এদিকে এসব বিষয় নিয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সদস্যরা কাজ করছে না, এটার বড় কারণ হচ্ছে, অনেকের বিরুদ্ধে মামলা, অনেকেই জেলে।
এই অর্গানাইজেশনগুলোকে আন্ডারমাইন্ড করে যদি আপনারা মনে করেন, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বিরাজ করবে, তা হবে না। কোনো বাহিনীকে বাদ দিয়ে, কারও ওপর কলঙ্ক চাপিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা যাবে না।
অন্যদিকে পুলিশের দেওয়া অপরাধের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গত কয়েক বছরের মধ্যে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে অপরাধের মাত্রা বেড়েছে। খুন, অপহরণ, ডাকাতি, ছিনতাই, চুরি এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত ছয় বছরের মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এসব অপরাধ সবচেয়ে বেশি হয়েছে।
এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী আবু আহমদ ফায়জুল কবির বলেন, প্রতিদিন কোথাও না কোথাও প্রকাশ্য দিবালোকে গুলিধর্ষণ ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় এক ধরনের ভয় কাজ করছে মানুষের মধ্যে।
আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার কারণে মানুষের মধ্যে বাড়ছে আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা। গত মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর উত্তরা বিএনএস সেন্টার এলাকায় ছিনতাইকারী সন্দেহে দুই যুবককে পিটিয়ে গুরুতম জখম করে উত্তেজিত জনতা।
পরে দুইজনকেই ফুটওভার ব্রিজের ছাদের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়। একই রাতে গাজীপুরের টঙ্গী এলাকায় ছিনতাইকারী সন্দেহে এক যুবককে পিটিয়ে মারে উত্তেজিত জনতা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি ফেব্রুয়ারিতে সারা দেশে গণপিটুনিতে অন্তত ৫০ জন নিহতের খবর আসছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. সাজ্জাত আলী বলেন, ‘আমি কোনোভাবেই সাধারণ মানুষকে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে বলছি না। ল ইনফোর্সিং এজেন্সির কাছে তাদের তুলে দেন।’
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, অপরাধীদের দৌরাত্ম্য যতটা বাড়ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপরতা তার চেয়ে পিছিয়ে আছে, যে কারণে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ‘মব’ নামের উপদ্রব।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার ভূমিকার কারণে মানুষ আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক ইনামুল হক বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখতে জনগণের ভূমিকা লাগবে। মাঠে কর্মরত পুলিশ সদস্যরা জনগণের ক্ষোভের মুখে পড়ছে।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা ছাড়া অন্য দলের বা অন্য কোনো বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে গেলে কিছু জায়গায় অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটছে বলে স্বীকার করেন এ পুলিশ কর্মকর্তা।
পুলিশের সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক ইনামুল হক বলেন, ‘আমরা লক্ষ করছি, হঠাৎ করেই প্রতিনিয়তই অপরাধের ধরন পাল্টাচ্ছে। এক বছরের জানুয়ারিতে অপরাধ বাড়লে পরের বছরের জানুয়ারিতে অপরাধ কমে। পুলিশ জনগণের নিরাপত্তা দিতে সবসময় সক্রিয় ও সচেষ্ট আছে।’
আপনার মতামত লিখুন :