অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে পণ্যমূল্যের অস্বস্তি দিয়ে শুরু হচ্ছে মাহে রমজান। সরকারের নির্দেশনা থাকলেও পণ্য সরবরাহে রয়েছে প্রবল ঘাটতি। যার কারণে অস্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে পণ্যবাজার। রমজান সামনে রেখে কয়েকটি পণ্যের আমদানি এবার ২০ থেকে ৬৪ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। তবুও রোজার আগে সবজিবাজার স্থিতিশীল থাকলেও বাজার থেকে ‘উধাও’ সয়াবিন তেল।
দেশে গত বছরের তুলনায় ৩৪ শতাংশ বেশি আমদানি হলেও ঢাকার অধিকাংশ বাজার এবং চট্টগ্রামে মিলছে না সয়াবিন। তেলের সঙ্গে দাম বেড়েছে লেবু, শসা, বেগুন, মাছ ও মাংসের। যার কারণে পণ্যমূল্যের অস্বস্তি দিয়ে শুরু হচ্ছে পবিত্র মাহে রমজান। তবে সংকট ঘিরে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিক্রেতারা বলেন, কোম্পানির ডিলাররা কয়েক দিন ধরেই সয়াবিন তেল সরবরাহ করছে না। ফলে তাদের দোকানে তেল নেই। সরবরাহ কমায় ভোগান্তিতে পড়ছেন গ্রাহকরা।
রমজানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিত্যপণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন। চাহিদা ঠিক থাকলেও এখানে প্রত্যেক পণ্যের দাম বাড়ে। এখানকার ব্যবসায়ীরা অতি লাভবান হওয়ায় সাধারণ ভোক্তাদের ভোগান্তি অনেক গুণে বাড়ে। রোজায় খেজুর, ছোলা, চিনি, মুড়ি, ডাল, বেসন ও চিনির চাহিদা কয়েক গুণ বাড়ে। তবে বাজারে সরবরাহ ঠিক থাকায় এবার এসব পণ্যের দাম বাড়েনি।
তবে লেবু, শসা, বেগুন ও মাছ-মাংসের দাম বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে সয়াবিন তেল। দেশের বাজারে মাসখানেক ধরে বোতলজাত তেলের সংকট চলছে। রোজার আগ মুহূর্তেও তা কাটেনি।
এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকার জানিয়েছে, রমজানে চাহিদাসম্পন্ন বিশেষ পণ্যগুলোর বাড়তি জোগান রাখা হয়েছে। যার কারণে সাধ্যের মধ্যেই থাকবে দাম। তবে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাজারের চিত্র অন্য কিছু বলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, রমজান সামনে রেখে কয়েকটি পণ্যের আমদানি এবার ২০ থেকে ৬৪ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। গত বছরের অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত চার মাসে দেশে চিনি আমদানি হয় চার লাখ ৫৪ হাজার ৩৪ টন, যা এক বছর আগের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি। সয়াবিন তেল আমদানি হয় ৫ লাখ ৯৮ হাজার ২৫২ টন, যা আগের বছরের চেয়ে ৩৪ শতাংশ বেশি। বিভিন্ন প্রকারের ডাল আমদানি করা হয়েছে এক লাখ ৫৭ হাজার ৮৩৭ টন, ৪৪ শতাংশ বেশি। খেজুর ২৩ শতাংশ বেশি আমদানি করা হয়েছে।
টিসিবির হিসাবে, গত রমজানের তুলনায় লিটারে ৩০ টাকা বেড়েছে খোলা সয়াবিনের দাম। লিটারে ১০ টাকা বাড়লেও মিলছে না বোতলজাত সয়াবিন। এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকার রমজানে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ বাড়াতে ও সাশ্রয়ী মূল্য স্থির করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আমদানি করা কয়েকটি পণ্য শুল্কমুক্ত করে। শুল্ক ছাড়ের ফলে কেজিতে ২০ টাকা কমে চিনির দর হয়েছে ১২০ টাকা। প্রতি কেজি খেজুরে কমেছে ৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। অপরিবর্তিত রয়েছে ছোলার দাম, প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকায়।
অন্যদিকে, ভোজ্যতেলের সংকট কমাতে দুই দফা শুল্ক প্রত্যাহার করে এনবিআর। তবুও বাজারে তেলের সরবরাহ কমায় ভুগছেন ভোক্তারা। বোতলজাত প্রতি লিটারে দাম ১৭৫ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও মিলছে না। বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স ও বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন যে ‘প্রতিশ্রুতি’ দিয়েছিল, তাতেও অমিল। গত বুধবারের মধ্যে বাজারে বোতলজাত সয়াবিনের সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ার কথা থাকলেও তা নেই।
গতকাল শনিবার ঢাকার কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মৌসুমি ফসল আলু ও পেঁয়াজ উত্তোলন শুরু করেছে কৃষক। এবারে উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়ায় এসব পণ্যের দাম অনেক কমেছে। একই সঙ্গে কাঁচা সবজি ও শাকসবজির দাম কমেছে। তবে মসলাজাতীয় পণ্য এলাচের দাম দ্বিগুণ বেড়েছে, প্রতিকেজি সর্বোচ্চ সাড়ে ৫ হাজার টাকায়। প্রতি কেজি রসুনে গুনতে হচ্ছে বাড়তি অন্তত ২০ টাকা। খাদ্যপণ্যের ভেতরে গরুর মাংসের দাম বেড়ে কেজিতে হয়েছে সর্বোচ্চ ৭৮০ টাকা। প্রতি কেজি ব্রয়লারে কমেছে অন্তত ২০ টাকা, যা এখন দুইশর ঘরেই। কেজিতে ৩০ টাকা কমেছে সোনালি মুরগি। ডজনে ১০ টাকা কমে ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকা পর্যন্ত। লেবুর হালি ৮০ থেকে ১০০ টাকা।
পণ্যমূল্য বৃদ্ধি সম্পর্কে সিপিডির গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বাজার নিয়ন্ত্রণে সঠিক নীতি গ্রহণের পাশাপাশি গুটি কয়েক প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। প্রয়োজন নজরদারি বাড়িয়ে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। কয়েকজন বড় ব্যবসায়ীর কাছে আমাদের বাজার জিম্মি রয়েছে। এ বিষয়ে সরকার কোনো রকম উদ্যোগ নিচ্ছেন না।’
ঢাকার যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, কাপ্তানবাজার, শান্তিনগর, কারওয়ান বাজার ও মহাখালী কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা যায়, আমদানি করা সাদা চিনির কেজি ১২০ টাকা এবং লাল চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায়। মুড়ি বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা দরে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের মেসার্স আমজাদ ট্রেডার্সের মোহাম্মদ রাসেল বলেন, ‘আমরা যে দামে পামু তাই বিক্রি করমু। লাল চিঁড়া ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছি। মুড়ি বা চিঁড়ার কোনোটারই দাম বাড়েনি। রেগুলার দামেই তো বিক্রি করছি।’
কারওয়ান বাজারে কিচেন মার্কেটে ছোলা ও বেসন কিনতে আসা হালিমা খাতুন বলেন, ছোলার দাম দুই দিন আগে একটু বেড়েছিল। খবরে দেখলাম আমদানি বেশি, তাই কিনিনি। এখন ২০ টাকা কমে ১১০ টাকায় পেলাম।’
রাজধানীর শান্তিনগরে ‘মা-বাবার দোয়া ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের’ দোকানি রাজু আহমেদ বলেন, ‘ডাবলি এখন ৭০ টাকা কেজি দাম চাই। দরদাম করলে ৬৫ টাকায় দিয়া দেই। সবাই দাম করে, তাই ৫ টাকা বাড়ায়া বলি।’
ভোগাচ্ছে সয়াবিন তেল
সয়াবিন তেলের বাজারে সংকট চলছে। রোজা এলেও তা কাটেনি। বাজারে তেল যা পাওয়া যাচ্ছে, তার বেশির ভাগই দুই ও ৫ লিটারের বোতল। ফলে খোলা সয়াবিন তেলের বিক্রি বেড়েছে। প্রতি লিটারের দাম পড়ছে ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকা। কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটে খোলা সয়াবিন দুই লিটার বিক্রি হচ্ছে ৩৩০ টাকায়। বোতলের সয়াবিন তেলের সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য হচ্ছে প্রতিলিটার ১৭৫ ও ৫ লিটার ৮৫০ টাকা।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স ও বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বলেছিল, রোজায় ভোজ্যতেলের সংকট হবে না। আমদানি করা নতুন তেল ‘৭ থেকে ১০ দিনের’ মধ্যে বাজারে আসবে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়। তাদের সেই বিজ্ঞপ্তির ১২ দিন পার হলেও বাজারে তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি।
চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে একই চিত্র
নারায়ণগঞ্জ শহরের সবচেয়ে বড় পাইকারি ও খুচরা বাজার দিগুবাবুর বাজার। এ বাজারে সয়াবিন তেলের বোতলের সংকট দেখা দিয়েছে। কয়েকটি দোকানে তেল বিক্রি হলেও দাম নেওয়া হচ্ছে বেশি। বাজারের অন্তত ১২টি দোকানে সয়াবিন তেলের খোঁজ নিলে নয়জনই জানান, তাদের কাছে বোতলজাত সয়াবিন নেই। বাকি তিনটি দোকানে লিটারপ্রতি অন্তত ২০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হতে দেখা যায়।
একই চিত্র চট্টগ্রামের বাজারেও। রোজার আগ মুহূর্তে চট্টগ্রামের সবজি বাজার স্থিতিশীল থাকলেও বাজার থেকে ‘উধাও’ সয়াবিন তেল। গতকাল শুক্রবার নগরীর বিভিন্ন বাজার ও পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোতে সয়াবিন তেলের সংকট দেখা গেছে। নগরীর বৃহত্তর বাজার রেয়াজউদ্দিন বাজারে বিভিন্ন দোকান ঘুরে কোথাও সয়াবিন তেল পাওয়া যায়নি। বিক্রেতাদের দাবি, প্রায় এক মাস ধরে সয়াবিন তেলের সংকট চলেছে। গত কয়েক দিন ধরে এ সংকট আরও প্রকট হয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠান তেল সরবরাহ করছে না।
ব্যবসায়ীরা বলেন, কোম্পানির ডিলাররা তেল সরবরাহ করছেন না। ফলে তাদের দোকানে তেল নেই। প্রায় এক মাস ধরে সয়াবিন তেলের সংকট চলছে। গত কয়েক দিন ধরে এ সংকট আরও প্রকট হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :