পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মরিয়া ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই বড় চ্যালেঞ্জ দেশে ব্যাপকমাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়া অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা।পুলিশ বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে জনগণের আস্থা না থাকার সুযোগে বাহিনীতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়।
পুলিশ আগের চেয়ে কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়ে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি দেশজুড়ে উচ্ছৃঙ্খল জনতার উত্থান ঘটেছে। নিরাপত্তা নিয়ে দেশবাসী উদ্বিগ্ন হয়ে উঠায় সরকারপ্রধান যেকোনো উপায়ে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন বলে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সূত্র নিশ্চিত করেছে।
দেশের মহানগর ও আশপাশের এলাকাগুলোয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী মহানগর এবং রেঞ্জের আওতাধীন এলাকাগুলোয় নানা ধরনের অপরাধের ঘটনা ও এর প্রতিকার চেয়ে করা মামলার সংখ্যা বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কঠোর অবস্থানে সরকার।
চুরি-ছিনতাই প্রতিরোধে কয়েকটি স্থানে রাতে এলাকাবাসী ব্লকভিত্তিক পালাক্রমে এলাকা পাহারা দিচ্ছেন। সবমিলিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।
নাগরিকের নিরাপত্তাই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা ও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক সংরক্ষিত এবং নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকারের রক্ষাকবচ হলেও এখন প্রকাশ্যে গুলি, ধারালো অস্ত্র দিয়ে রিকশাযাত্রীদের সবকিছু ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এককথায়, নাগরিকরা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে।
রাজধানীর ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সি এবং ভাসমান ও ছদ্মবেশী অপরাধীরা এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। ঠিকানাবিহীন এসব অপরাধী যেকোনো ধরনের অপরাধ সংঘটিত করে নির্বিঘ্নে কেটে পড়ে। এদের শনাক্ত করতে গিয়ে বেগ পেতে হচ্ছে।
ঢাকায় ৬ হাজারের বেশি অপরাধীকে ডিএমপির ডাটাবেজে যুক্ত করা হয়েছিল ২০২৩ সালের দিকে। তবে ভাসমান ও ছদ্মবেশী অপরাধীদের ডাটাবেজের আওতায় আনা হয়নি কখনো। এজন্য যারা ভাসমান অপরাধী রয়েছে তাদের শনাক্ত করাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
পুলিশ, র্যাব ও সিটিটিসির সমন্বয়ে যৌথ অপারেশন শুরু করেছে। পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিজিবির সমন্বয়ে যৌথ টহল এবং তল্লাশি চলছে ২৪ ঘণ্টা। এরমধ্যেও অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে আতঙ্কিত করে তুলেছে দেশবাসীকে। প্রকাশ্যে গুলি, চাপাতি দিয়ে কোপানো এবং ভয় দেখিয়ে চুরি-ছিনতাই ও চাঁদাবাজির ঘটনা দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে।
সম্প্রতি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া বেশকিছু ঘটনায় মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আতঙ্কে অনেকেই ঘর থেকে বেরোতেও ভয় পাচ্ছেন। সন্ধ্যার পর শহরাঞ্চলের অলিগলি ও রাস্তাঘাটে বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা। কোথাও কোথাও এসব ঘটনা সামাজিকভাবে প্রতিরোধের চিত্রও দেখা যাচ্ছে।
ক্রমাগত হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের কারণে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম না হলে রাষ্ট্র ও সরকারের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। পুলিশের একটি সূত্র বলছে, পতিত আওয়ামী লীগের দোসররা এরই মধ্যে বেশকিছু অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করেছে। সেসব ফুটেজ গোয়েন্দাদের হাতে এসেছে। তাদের চিহ্নিত করে দ্রুতই আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলছেন, ঢাকাসহ সারা দেশে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনায় ৫ আগস্টের পর যাদের নাম আসছে তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এমনকি সম্প্রতি কারাগার থেকে জামিনে আসা শীর্ষ সন্ত্রাসীদেরও নজরদারিতে আনা হয়েছে।
গত শুক্রবার মধ্যরাতে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের চরপাড়া ঘাটের কাছে মাদক সেবনে বাধা দেওয়ায় ডিউটিতে থাকা ইউসুফ নামে পুলিশের এক এসআইকে মারধরের ঘটনা ঘটেছে। হামলাকারীরা তার মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ এবং ওয়্যারলেস সেট ছিনিয়ে নেয়।
একাধিক পুলিশ সদস্য এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে বর্তমানে কোনো ধরনের ঝুঁকি নিচ্ছেন না। নির্ধারিত সময় অনুযায়ী থানায় ডিউটি করা মূল টার্গেট থাকে। পুলিশ সদস্যদের বেশি মনোযোগ দৈনিক হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করা এবং থানার ভেতরে টেবিলওয়ার্ক।
বাইরে ডিউটি করতে গেলে নানা ধরনের অপরাধের শিকার হয়ে ভুক্তভোগীরা তাদের কাছে আসেন। কিন্তু তাদের জন্য তেমন কিছুই করার থাকে না। ছিনতাইকারীকে ধরতে গেলেও হামলার শিকার হতে হয় তাদের। এমন পরিস্থিতিতে নিয়মিত টহল এবং তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক রূপালী বাংলাদেশকে জানান, অপরাধ দমনে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি সমাজের সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
সম্প্রতি দেখা গেছে, সরকার এসব বিষয়ে কঠোর হচ্ছে। তবে, পুলিশি ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করতে হবে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে চোখ-কান খোলা রেখে সরকারকে বিভিন্ন অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পাশাপাশি দেশের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সচেতন হতে হবে। তাহলে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।
চলমান অপারেশন ডেভিল হান্ট, রাজধানীজুড়ে পুলিশের কম্বাইন্ড পেট্রোলিং ও ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের অলআউট অ্যাকশন চলমান। এর বাইরে সরকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদারকিতে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সব ইউনিটকে সক্রিয় করেছে।
ইতিমধ্যে রাজধানীসহ সারা দেশের পরিস্থিতির উন্নতি করতে অপরাধপ্রবণ এলাকায় জোরদার অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট, বিজিবি সদস্যদের সমন্বয়ে যৌথবাহিনী গঠন করে টার্গেট এলাকায় জোরদার অপারেশন পরিচালনা করছে। রাজধানীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কে নৌবাহিনীর একটি অতিরিক্ত পেট্রল এবং কিছু এলাকায় কোস্টগার্ডের একটি অতিরিক্ত পেট্রল নিয়োজিত রয়েছে।
সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতির প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতির উন্নতিতে অন্তর্বর্তী সরকার যেকোনোভাবেই স্বাভাবিক করতে চায়। জণগনকে স্বস্তি দিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
তিনি বলেন, সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযানে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিনরাত নিরলসভাবে কাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার পুরোপুরি হার্ডলাইনে।
সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে ‘অলআউট অ্যাকশন’: ডিবিপ্রধান
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) রেজাউল করিম মল্লিক বলেছেন, মহানগরীর বিভিন্ন এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘অলআউট অ্যাকশনে’ যাচ্ছে ডিবি। সেই সঙ্গে ছোট-বড় যেকোনো অপরাধ ও অপরাধীর ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অবলম্বন করা হয়েছে। গতকাল শনিবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
শনিবার থেকে আমরা ডিবির চলমান কার্যক্রমের পাশাপাশি রমজানকে সামনে রেখে বিশেষ অভিযান শুরু করেছি। এটা হচ্ছে এক ধরনের বিশেষ গোয়েন্দা অভিযান। যেটাতে ছদ্মবেশে আমাদের সদস্যরা মানুষের মধ্যে থেকে অপরাধীদের শনাক্ত করবে। রোজার সময় মানুষের কর্মযজ্ঞ বৃদ্ধি পায়।
বিশেষ করে আর্থিক লেনদেন বেশি হয়। শপিংমল, ব্যাংক, বিমাগুলোতে মানুষের ভিড় বাড়ে। রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল ও সদরঘাটসহ অন্যান্য জায়গাতে মানুষের উপস্থিতি বাড়ে। এসব জায়গায় কেউ যাতে নাশকতা করতে না পারে, সে জন্য আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি দূরের যাত্রাপথ বিশেষ করে বাসে কোনো দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে, সে লক্ষ্যে গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে আমরা আগে থেকেই ডিবির তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াচ্ছি।