ঢাকা সোমবার, ০৩ মার্চ, ২০২৫

মুজিব কর্নারের নামে শতকোটি টাকা জলে

মাইনুল হক ভূঁঁইয়া
প্রকাশিত: মার্চ ২, ২০২৫, ১০:২২ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ’ কর্নার প্রতিষ্ঠার নামে শতকোটি টাকা রীতিমতো জলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এই কর্নার তৈরি করতে গিয়ে কেবল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন ১৮টি প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২২ কোটি টাকা অপচয় করা হয়েছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় এ প্রতিষ্ঠানের শাখাগুলোতে তৈরি হয়েছিল ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার’। 

গণগ্রন্থাগার ছাড়া সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নিজ উদ্যোগে কর্নারটি তৈরি করে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও জাতীয় জাদুঘর এ জন্য কোনো প্রকল্প হাতে নেয়নি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার’ স্থাপনের সিদ্ধান্ত আসার পর প্রতিষ্ঠান দুটি তাদের বার্ষিক ব্যয় থেকে এটি প্রতিষ্ঠা করে। 

বাংলা একাডেমি কথিত কর্নার বানিয়েছে ৪০০ বই দিয়ে। ড. এনামুল হক ভবনের পাঠাগারের সামনে দ্বিতীয় তলায় ছিল তাদের কর্নার। ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর বইগুলো সরিয়ে গুদামে রেখে দেওয়া হয়। জাতীয় জাদুঘরের তৃতীয় তলায় ছিল এই কর্নার। 

জানা যায়, ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত ১৮ প্রতিষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার’ প্রতিষ্ঠার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এ জন্য ব্যয় বরাদ্দ ধরা হয় ২২ কোটি ২৪ লাখ টাকা। গ্রন্থাগার অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও হিসাব) মোছা. মরিয়ম বেগমকে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। 

এরপর থেকে তার নেতৃত্বে ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে আলোচিত অর্থবছরে দেশের ১০৭১টি সরকারি-বেসরকারি পাঠাগারে এই কর্নার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর বাইরে বিভিন্ন কারাগারের পাঠাগারগুলোতেও এই কর্নার প্রতিষ্ঠা করা হয়। বইয়ের পাশাপাশি এসব পাঠাগারে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যও বানানো হয়। বই সরানোর সঙ্গে সঙ্গে এসব ভাস্কর্যও ভেঙে ফেলা হয়।

সূচনালগ্নে গ্রন্থাগার অধিদপ্তর থেকে সব সরকারি পাঠাগার ও বেসরকারি পাঠাগারগুলোতে ২৫০টি বুক সেলফ দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার কথা থাকলেও শুধু সরকারি পাঠাগার ছাড়া অন্য কাউকেই কোনোরকম অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়নি। তারা তাদের নিজস্ব উদ্যোগে নামকাওয়াস্তে কর্নার গড়ে তোলে। 

জুলাই বিপ্লবের পর ৭১ সরকারি পাঠাগার থেকে কর্নার উধাও হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যগুলোও ভাঙনের শিকার হয়।  

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুজিব কর্নার প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ও শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন-কর্ম সম্পাদিত বই সরবরাহের মাধ্যমে পাঠক, গবেষক, তথ্য সংগ্রহকারীসহ সর্বসাধারণের কাছে গ্রন্থাগারের ভূমিকাকে আরও আকর্ষণীয় ও কার্যোপযোগী করে তোলা।’

এদিকে অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, শুধু সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ই নয়, প্রায় সব মন্ত্রণালয়ের অধিদপ্তর ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে গড়ে তোলা হয় এই কর্নার। এমনকি তখন এই কর্নার প্রতিষ্ঠার মহড়া চলছিল। কার আগে কে এই কর্নার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে এ নিয়ে প্রতিযোগিতা দৃষ্টি কেড়েছিল।

সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ মূহূর্তে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল শিল্প সংস্থায় রীতিমতো ঢাক-ঢোল পিটিয়ে এই কর্নার করা হয়েছে। এ জন্য জাঁকজমক অনুষ্ঠানও আয়োজন করা হয়েছিল। 

আশ্চর্যের বিষয়, ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নিচ তলায় ক্যান্টিনের পাশে গড়ে তোলা হয়েছিল এমন একটি কর্নার। সব মিলিয়ে এসব কর্নার প্রতিষ্ঠায় প্রায় শতকোটি টাকা অপচয় হয়েছে। বলতে গেলে এই বিপুল অর্থ জলেই চলে গেছে। মুজিব শতবর্ষ উদযাপন করতে গিয়ে এসব অর্থ যেন গৌরী সেন দিয়েছে- এমন মনোভাব ছিল কর্তাদের। 

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অধীনস্ত এই কর্নার প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক উপসচিব মোছা. মরিয়ম বেগম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ডিপিপি যখন করা হয় তখন আমি ছিলাম না। আমাকে পরে পিডি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ডিপিপি অনুযায়ী সবাইকে বইসহ অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে।  

তিনি আরও বলেন, ওপরের নির্দেশে তখন আমরা এটি করেছি। এখন তা অপচয় হয়েছে কি না-সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না।