পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনীতিতে ক্রমশই জোরালো হচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের ইস্যু। দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে সরব রয়েছে বিএনপি। জাতীয় নির্বাচনের আগে কোনোভাবে স্থানীয় নির্বাচনে যাবে না দলটি।
রাজনৈতিক সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি রাজপথে সরব থাকলেও মাঠে কৌশলে এগিয়ে আছে জামায়াত। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। দু’দলের প্রায় দুই যুগের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে। এতদিন পর্দার আড়ালে ইস্যুটি চাপা থাকলেও তা এখন প্রকাশ্যে এসেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ‘জামায়াত উর্দু শব্দ, আওয়ামী লীগও উর্দু। দুটি একসঙ্গে মিলবে ভালো। আওয়ামী লীগ জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে, কিন্তু বেআইনি ঘোষণা করেনি। তাহলে কি তলে তলে তাদের পরকীয়া প্রেম চলে?’ এর অর্থ, আওয়ামী লীগ গোপনে জামায়াতের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। আওয়ামী-জামায়াত হবে, বিএনপি-জামায়াত আর হবে না বলে মন্তব্য করেন বিএনপির এই নেতা।
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন ও সংস্কার চান। সরকারের সঙ্গে বৈঠকে এবং দলীয় কর্মকাণ্ডে এমন দাবি জানালেও তৃণমূলে উল্টো। সংসদ ভোটের প্রস্তুতি নিতে দলীয় সংসদ সদস্য প্রার্থী ঘোষণাসহ তৃণমূল চষে বেড়াচ্ছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। এক্ষেত্রে বিএনপি এখনো তেমন কোনো কার্যক্রম হাতে নেয়নি। তবে বিএনপির কিছু মনোনয়নপ্রত্যাশীরা কেউ কেউ মাঠে নামলেও সেটা ব্যক্তিগত।
বিরামহীনভাবে তৃণমূলে ছুটছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী: খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সুনির্দিষ্ট তারিখ ঠিক না হলেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সে হিসেবে চলতি বছরের ডিসেম্বর কিংবা ২০২৬ সালের মাঝামাঝি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনকে সামনে রেখে দলকে সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে বিরামহীনভাবে তৃণমূলে ছুটছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ইতিমধ্যে ঠিক করে ফেলেছে প্রার্থীদের তালিকাও। আবার জোট গঠনের জন্য বিভিন্ন ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে অব্যাহত রয়েছে দৌড়ঝাপ। দল গোছানোর পাশাপাশি নির্বাচন ঘিরে সারা দেশে মাঠে সরব দলটির নেতাকর্মীরা। সব মিলিয়ে নির্বাচনের মাঠে এবার বেশ কৌশলী ও সবর ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে জামায়াতকে।
ইতিহাস সৃষ্টি করাই জামায়াতে ইসলামীর টার্গেট: দলীয় সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশ দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে সরব, মাঠে পিছিয়ে বিএনপি। দ্রুত নির্বাচন না চাইলেও মাঠ চষে বেড়াচ্ছে জামায়াত। ইতিহাস সৃষ্টি করাই জামায়াতে ইসলামীর টার্গেট।
৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এখন থেকেই মানবিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনমত তৈরির সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে দলটি। ইতোমধ্যে তাদের দুই শতাধিক আসনে দলীয় সম্ভাব্য প্রার্থী চূড়ান্ত হয়ে গেছে। বাকি আসনের প্রার্থী তালিকা বাছাইয়ের প্রক্রিয়া চলছে।
সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় নানা দলীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। এছাড়া জামায়াতের পক্ষ থেকে দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান, নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ও মাওলানা আ ন ম শামসুল ইসলাম, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাক্তুম, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, হামিদুর রহমান আযাদ, মাওলানা আবদুল হালিম, অ্যাডভোকেট মোয়ায্যম হোসাইন হেলাল, মাওলানা মো. শাহজাহান ও অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য আব্দুর রব নিয়মিতভাবে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় জামায়াতের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে দলকে সংগঠিত করার চেষ্টা করতে দেখা গেছে। প্রতিদিনই অংশ নিচ্ছেন বিভিন্ন সভা-সমাবেশে।
নির্বাচনের সময় এলে পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেবে বিএনপি: এদিকে বিএনপির তরফ থেকে জানানো হয়, নির্বাচনের সময় যখন আসবে, তখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করবে, সেই পরিস্থিতির আলোকে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে। এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া হবে কি নাÑ তা এখনই বলার সুযোগ নেই। তবে সব দিকেই নজর দেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেছেন, ২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছি, এগুলো ছাড়া সব নির্বাচনে আমরা অংশগ্রহণও করেছি। নির্বাচনি দল হিসেবে আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। রয়েছে সার্বিক প্রস্তুতি। বিষয়টি জামায়াতে ইসলামীর আমির পরিষ্কার করেছেন, ন্যূনতম যে সংস্কার দরকার, আমরা চাই এ সংস্কারগুলো দ্রুত করা দরকার। যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিয়ে দেওয়া উচিত।
বিএনপির বারবার নির্বাচনের তাগিদ: এদিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বারবার নির্বাচনের তাগিদ দিলেও রাজনৈতিক নানা কার্যক্রমে জামায়াতের তুলনায় পিছিয়ে আছে দলটি।
তারা গত বছরের আগস্ট মাসে দাবি জানিয়েছিল যে, তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে। এরপর দলটির তরফ থেকে দাবি জানিয়েছিল ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন। পরে তারা দাবি জানিয়েছিল, ২০২৫ এর মধ্যে নির্বাচন চাই। এখন তারা বলছে, জরুরি সংস্কার সম্পন্ন করে দ্রুত নির্বাচন চাই। আবার তাদের কেউ কেউ বলছেন যে, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে।
সরকারপ্রধানের দায়িত্ব সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেওয়া: এ বিষয়ে জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, মানুষ কখন ভোট দিয়ে তাদের নির্বাচিত সরকার ও সংসদ গঠন করতে পারবে সেটি সরকার স্পষ্ট করেনি বলেই জনমনে এক ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো মহল নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে বলেই বিএনপি বারবার সরকারকে সতর্ক করছে।
জানা যায়, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জামায়াতের পশাপাশি বিএনপিও প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সভা-সমাবেশ করছে। তৃণমূলেও ছুটে যাচ্ছেন দলের শীর্ষ নেতারা। তবে এখনো প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করতে পারেনি দলটি। পাশাপাশি বিভিন্ন পর্যায়ে কমিটি ঘোষণা করে আবার ভাঙার ঘটনাও ঘটছে বেশ।
এছাড়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনাও মানছে না অনেক নেতা-কর্মী। জড়িয়ে যাচ্ছে চাঁদাবাজি-দখলবাজিসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে। এতে করে একদিকে যেমন দলের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে, অন্যদিকে অতীতের ত্রুটিগুলোও ভোটারদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।
দিন যত যাচ্ছে, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব তত বাড়ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তারা বলছেন, বিএনপিও জামায়াতের সঙ্গে দূরত্বের কথা চিন্তা করে অন্যান্য দল নিয়ে এগোনোর চেষ্টা করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, একসময়ের বিএনপির অন্যতম মিত্রদল, একাধিকবার জোট করে ভোট করা জামায়াত-বিএনপির দ্বন্দ্ব এখন অনেকটা স্পষ্ট। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুটি দল এখন মুখোমুখি অবস্থানে। শীর্ষ নেতারা একে অপরের প্রতি করছেন কটাক্ষ। এ অবস্থায় আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দল দুটির অবস্থান শেষ পর্যন্ত কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় তা দেখার বিষয়।
বিএনপি এবং জামায়াতের বর্তমান সম্পর্ক বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. এএসএম আমানুল্লাহ মনে করেন, বাংলাদেশের ভোট মূলত বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত। তিনি বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় জামায়াত সেই ফাঁকা জায়গায় একটি শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রকাশ করতে চাইছে।
এ কারণেই তারা এখন বিএনপির বাইরে গিয়ে অবস্থান নিতে চাচ্ছেন হয়তো। তবে নির্বাচন দেরিতে হলে তাদের শক্তি আরও সংহত হতে পারে। তবে এতে ভোটের রাজনীতিতে বড় কোনো প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি না। কারণ, তাদের যে ভোট ব্যাংক, তা খুব বেশি বাড়বে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক সেলিমুজ্জামান সেলিম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, জামায়াত সরকার গঠনের যে পাঁয়তারা করছে সে ভাবনা ভুল। আমরা দাবিতে সবর আছি।
তাদের বিবেচনা করা উচিত, সংসদ নির্বাচনে সারা দেশে প্রার্থী দেওয়ার মতো সংগঠনিক শক্তি আছে কি না। তা ছাড়া একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা সারাজীবন সরকার গঠনের চেষ্টা করতে পারে, এতে বিএনপির মাথাব্যথা নেই।
আপনার মতামত লিখুন :