জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) অর্থাৎ পঙ্গু হাসপাতালের প্রধান ফটকে ভাঙা দুই হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শিশু আরিফ (৯)। অপেক্ষা করছে তার বাবা সিএনজি নিয়ে আসবে। তবে ডাক্তার বলেছেন, দুই হাত নাড়া-চাড়া ও ঝাঁকুনি থেকে বিরত রাখতে। শিশু আরিফ জানায়, তার বাবার সামর্থ্য নেই লক্ষ্মীপুর যেতে আবারও অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করবে।
তারা সিএনজি নিয়ে সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল যাবে, সেখান থেকে লক্ষ্মীপুরের ভাড়া ৩০০ টাকা। অ্যাম্বুলেন্সের সঠিক নীতি, সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের ঘাটতি ও সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি থাকায় পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা এবং চিকিৎসা শেষে বাড়িতে ফিরে যেতে রোগীদের পোহাতে হয় এক দুঃসহ কষ্ট। নিটোরের পাশেই শিশু হাসপাতালেও রয়েছে অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে সিএনজি সিন্ডিকেট।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) শয্যা রয়েছে ১ হাজার। তবে দেশে দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় রোগীর সংখ্যা বেড়েছে হাসপাতালটিতে; যাতে মেঝে ও বারান্দাতেও রোগীর চাপ দেখা যায়।
সরেজমিনে পঙ্গু হাসপাতাল ঘুরে জানা যায়, প্রতিদিন বিশেষায়িত এই হাসপাতালে রোগী আসে ১ হাজার ৩০০ জনের বেশি। আউটডোর রোগী আসে ৯০০ থেকে ১ হাজার এবং ইমার্জেন্সিতে গড়ে ২৫০ থেকে ৩৫০ জন রোগী আসে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে।
ঢাকার অদূরে সাভার নবীনগর থেকে ডান হাত ভেঙে গার্মেন্টসকর্মী আবুর নাদের হাসান এসেছেন জরুরি বিভাগে। সঙ্গে আসা সহকর্মী রাজু (২৮) বলেন, তারা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে এসেছেন ২ হাজার ৩০০ টাকায়। হাতের অপারেশন হয়েছে। তবে বুকের ব্যথার জন্য ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে যাবার পরামর্শ দিয়েছেন ডাক্তার।
নিটোর থেকে ঢাকা মেডিকেল যেতে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া চাচ্ছে ১৩০০ থেকে ১৫০০ টাকা। যেহেতু এখনো বেতন হয়নি, তাই তাদের সামর্থ্য নেই এই গাড়ি ভাড়া জোগানোর।
তিনি বলেন, হাসপাতালের সামনে অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও ভাড়া হয়ে গেছে বলেই প্রথমে জানায় সবাই। এদিন সকালে এক লোক গাড়ির ব্যবস্থা করে দিচ্ছে আশ্বাস দিয়ে রোগী দেখতে আসেন। রোগীর অবস্থা দেখে আমাকে আড়ালে ডেকে ১৭০০ টাকা দাবি করে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য। অনেক অনুরোধ করার পর এক হাজার টাকায় গাড়ি ব্যবস্থা করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ২০০ টাকা নিয়ে যায় আর ফিরে আসেনি।
মিরপুরের শিক্ষার্থী সাদাদ হোসেন সাকিব রাস্তা পারাপারের সময় বাসের ধাক্কায় কোমরে আঘাত পেয়ে প্রথমে যান ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে। ঢাকা মেডিকেল থেকে তাকে রেফার করা হয়েছে নিটোরে। আসতে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া গুনতে হয়েছে ১২০০ টাকা।
ঢাকা মেডিকেলে বা নিটোরে কোনো সরকারি অ্যাম্বুলেন্স সেবা আছে বলে জানেন না সাদাদের মা দিলারা বেগম। দিলারা বেগম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ঢাকার ভেতর এতটুকু রাস্তা আসতে ১২০০ টাকা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া দিতে হয়েছে।
মধ্যবিত্তরা চিকিৎসা নেবে কীভাবে? তারপর ঢাকা মেডিকেল থেকে বলা হলো দ্রুত সময়ের ভেতর নিটোরে আনা না হলে অবস্থা গুরুতর হবে। ফলে বাধ্য হয়েই অ্যাম্বুলেন্স নিয়েছি। এমন ডাকাতি চলতে থাকলে সাধারণ মানুষ আর সেবা নিতে হাসপাতালে আসতে পারবে না বলে জানান তিনি।
কথা হয় কুষ্টিয়া থেকে চিকিৎসা নিতে আসা আবুল হোসেনের সঙ্গে। অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন থাকলেও শয্যা স্বল্পতার কারণে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে মেঝেতে আছেন তিনি।
তারা স্ত্রী আনু জানাহ বলেন, হাসপাতালের কর্মীদের কাছে সাহায্য চাইলে তারা বলেন, বেড নেই আমাদের কিছু করার সুযোগ নেই। এভাবে আর কত অপেক্ষা করা যায়, প্রশ্ন রাখেন তিনি।
জরুরি বিভাগের চিকিৎসক বলেন, সাধারণত ২৪ থেকে সর্বোচ্চ ৭২ ঘণ্টার ভেতর রোগী নিটোরে না আসলে সে রোগীগুলো আমরা ইমাজেন্সি হিসেবে ভর্তি করতে পারি না।
৭ দিন পরে কেন তারা নিটোর এসেছেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে আহতের স্ত্রী আনু জানাহ বলেন, গাড়ি ভাড়া জোগাড় করতে সময় লেগেছে। গ্রামের মানুষ চাঁদা তুলে একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে দিয়েছে, তারপর ঢাকায় এসেছি।
পঙ্গু হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সের বিষয়ে জানতে সরেজমিনে দেখা যায়, নিটোর ইমার্জেন্সি গেটের সামনের খালি অংশ, প্রধান ফটকের পাশের অংশসহ সামনের প্রধান সড়কে রয়েছে সারি সারি অ্যাম্বুলেন্স।
রূপালী বাংলাদেশের প্রতিনিধি জাহিদুল হাসান (রোগীর স্বজন সেজে) রাজশাহী রোগী নিতে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার জন্য গেলে প্রথমেই ধাক্কা খেতে হয় একদল চক্রের কাছে। তারা প্রথমে জানান, অ্যাম্বুলেন্স নেই। তবে কিছুক্ষণ পর ছোট বাবু নামে একজন জানান, ১০ হাজার টাকা দিলে মিলবে একটি অ্যাম্বুলেন্স।
কোনোভাবেই কমানোর সুযোগ নেই; একই সঙ্গে জানিয়ে দিলেন বাইরের কোনো অ্যাম্বুলেন্স এখানে ঢুকবে না বা ঢোকানো সম্ভব নয়।
এদিকে, শিশু হাসপাতালে রয়েছে অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে সিএনজি সিন্ডিকেট। রোগীদের টার্গেট করে সিএনজি এবং অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা হয় তাদের।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সক্রিয় সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগাযোগসহ একই গ্রুপের কিছু ব্যক্তি যুক্ত আছে নিটোর ও শিশু হাসপাতাল অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের সঙ্গে। নিটোর এবং শিশু হাসপাতালে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যায় তারা হলেন- রাজু, আলমগীর, বাবু, ছোটন, সেলিম খান ও সাজ্জাদ।
তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে পঙ্গু, শিশুসহ নিউরো সায়েন্স হাসপাতাল। তাদের এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত আছে হাসপাতালের কিছু অসৎ ডাক্তার, নার্সসহ ওয়ার্ড বয়। তথ্য আদান-প্রদানে সাহায্য করে ক্লিনার ও কিছু টলিম্যান।
এসব বিষয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) যুগ্ম পরিচালক ডা. মো. মোজাফফর হোসেন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, নিটোরে ৩টি অ্যম্বুলেন্স রয়েছে যা শুধু রাজধানীর ভেতর সেবা দিয়ে থাকে। রাজধানীর বাইরে সেবা প্রদান করার মতো পর্যাপ্ত অ্যাম্বুলেন্স আমাদের নেই।
তবে দুর্ঘটনায় হাড় ভাঙা, কাটা-ছেঁড়া রোগী দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দ্রুত সময়ের মধ্যে নিটোরে আনা হয়। সেক্ষেত্রে রাজধানীসহ দেশের সব প্রান্তে এই ধরনের রোগীকে জিম্মি করে একটি চক্র কাজ করে থাকে। নিটোরের বর্তমান যে পরিমাণ চিকিৎসক, নার্সসহ স্টাফ রয়েছে তা ১ হাজার বেডের একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য পর্যাপ্ত বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, আমাদের সপ্তাহের ৭ দিন ৬ জন করে ডাক্তার ইমার্জেন্সি সেবায় নিয়োজিত থাকেন। ৩ শিফটে প্রায় ১৫ থেকে ১৮ জন ডিউটি করেন।
প্রতিদিন এখন রুটিন ওটি ২৯টির (ওপারেশন) পাশাপাশি ৩টি ইমার্জেন্সি ওটি হয়ে থাকে। জরুরি এবং বহিঃবিভাগ মিলে গড়ে আমরা ১৩০০ থেকে ১৪০০ রোগীর সেবা দিয়ে থাকি। আমাদের হাসপাতালে এখন অত্যাধুনিক অপারেশন সম্ভব হচ্ছে, আর্টিফিশিয়াল অনেক অর্গান আমরা সফলভাবে সংযোজনসহ আধুনিক সফল অপারেশন করে থাকি।
তবে এক চিকিৎসক নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, পঙ্গু হাসপাতালে ইমারজেন্সি অপারেশন থিয়েটার (ওটি) রয়েছে ৬টি, রেগুলার থিয়েটার রয়েছে ৩৬টি- এই মোট ৪২টি অপারেশন থিয়েটারে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০টির বেশি অপারেশন করা সম্ভব বলে জানান। কিন্তু হাসপাতালে প্রফেসর সংকটে আগত রোগীদের সময়মতো অপারেশন হচ্ছে না। ওর উত্তরণে অতি জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার বলে জানান ওই চিকিৎসক।
ডা. মো. মোজাফফর হোসেন বলেন, শুক্রবার ছুটির দিনসহ ঈদে আমাদের রোগীর চাপ সব সময়ই বেশি থাকে। আর রোগীর অবস্থার ওপর বিবেচনা করেই আমরা সেবা প্রদান করে থাকি। অনেক সময় রোগীর স্বজনেরা ভুল ভাবতে পারে তবে, তাদের সে ভুল ভাঙানোর মতো সময়ও আমরা পাই না।
অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের বিষয়ে তিনি বলেন, একটি গ্রুপ আগে খুবই সক্রিয় ছিল, তবে বর্তমানে তেমন একটা সিন্ডিকেটের বিষয়ে আমরা সংবাদ পাই না। হাসপাতালের ভিতর কোনো অবৈধ চক্র বা সিন্ডিকেট সক্রিয় নেই। তিনি বলেন, আমি মনে করি, সারা দেশের জেলা থেকে বিভাগীয় হাসপাতালগুলোর অর্থোপেডিকস বিভাগকে আরও সক্রিয় করা উচিত। একই সঙ্গে সেখানে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।
রোগী গেলেই নিটোরে রেফার করা বন্ধ করা গেলে একটি সিন্ডিকেট এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। জেলা বা বিভাগীয় হাসপাতালে যে চিকিৎসক রয়েছে তারা আমাদের প্রায় একই মানের চিকিৎসক সুতরাং সেবাকে মহৎ পেশা হিসেবে নিয়ে সেবা নিশ্চিতে কাজ করতে হবে।
হাসপাতালের একজন নার্স বলেন, হাসপাতালে যে হারে রোগী আসে তাতে পুরোনো রোগীদের দ্রুত ছেড়ে দিতে বাধ্য হতে হয়। যাদের ১৫ দিন হাসপাতালে রাখা দরকার তাদের ১০ দিন পরই বাড়িতে চলে যেতে বলা হচ্ছে।
এছাড়া আমাদের হাতে আর কোনো বিকল্প নেই। ফলে, তারা পুরোপুরি ক্যাপাবল থাকে না সুতরাং তাদের জার্নিটা আরামদায়ক হওয়ার জন্য আমরা গাড়ি ব্যবহার করতে পরামর্শ দিয়ে থাকি মাঝে মাঝে। তবে কোনো সিন্ডিকেটের সঙ্গে আমরা জড়িত নই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম ও অসুবিধা দূর করে আধুনিক, মানসম্মত ও সেবাধর্মী অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস প্রচলনের লক্ষ্যে ‘অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস নীতিমালা-২০২৩’ এর একটি খসড়া প্রণয়ন করা হলেও সেটি চূড়ান্ত হয়নি।
শুধু সম্পূর্ণ যুক্ত অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে আমদানিকৃত ডুয়েল এয়ারকন্ডিশন্ড বিশিষ্ট মোটরযানকে এই সার্ভিসে ব্যবহার করা যাবে। মাইক্রোবাস জাতীয় মোটরযানকে স্থানীয়ভাবে রূপান্তর করে অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।
ভাঙা, কাটা ছেড়া রোগীরা যখন সর্বোচ্চ নাজুক অবস্থায় থাকে তাদের জন্য প্রয়োজন হয় এসি, অক্সিজেনসহ আরামদায়ক বেড। তবে, যা অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করা হচ্ছে তার বেশির ভাগই পুরোনো মডেলের মাইক্রো কেটে বানানো হয়, ন্যূনতম সেবা সেখানে নিশ্চিত নয়।
নীতি অনুযায়ী অ্যাম্বুলেন্সে রোগীকে শোয়ানোর জন্য উপযুক্ত পরিমাণের বেড সংবলিত স্ট্রেচার থাকতে হবে এবং কমপক্ষে একজন প্যারামেডিকস (নার্স/মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট) থাকতে হবে।
অ্যাম্বুলেন্সে মেডিকেল যন্ত্রাংশ এবং ব্যবহারযোগ্য মেডিকেল দ্রব্যাদি (অক্সিজেন সিলিন্ডার, নেবুলাইজার মেশিন, ইন্ট্রাভেনাস ইনজেকশন স্ট্যান্ড, ফার্স্ট এইড বক্স, ফার্স্ট এইড কীট, ট্রমা প্যাডস ইত্যাদি) রাখার জন্য পর্যাপ্ত এবং নিরাপদ জায়গা থাকতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :