মূল্যস্ফীতির চাপ আর ডলার সংকটকে সামনে রেখে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগামী বাজেট দিতে যাচ্ছে। জাতীয় সংসদের কার্যক্রম না থাকায় রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে এ বাজেট ঘোষণা করা হবে আগামী জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে।
এখনো বাজেট ঘোষণার তারিখ ঠিক হয়নি। তবে বাংলাদেশ টেশিভিশনে সরাসরি এই বাজেট উপস্থাপনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে অর্থ বিভাগ থেকে। যদিও বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত রূপ পায়নি।
তা ছাড়া এই সরকার নির্বাচনের সম্ভাব্য যে তারিখ ঘোষণা করেছে, সে হিসেবে বর্তমান সরকার বাজেটের পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্বে থাকবে না। নির্বাচিত সরকার বাজেটের একটা অংশ বাস্তবায়ন করবে।
এমন বাস্তবতা সামনে রেখেই আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৮ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট তৈরির চিন্তা করছে সরকার যা জিডিপির ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা যা জিডিপির ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। সে হিসাবে আগামী বাজেটের আকার ৫১ হাজার কোটি টাকা বাড়বে।
রাজস্ব সংগ্রহের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি ঋণ নিয়ে বাড়তি অর্থ সংগ্রহ করবে সরকার। তবে নির্বাচিত সরকার বাজেট তৈরি করলে তা আকাড়ে আরও বড় হতো। যেমন- ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটের (প্রকৃত) আকার ছিল ৬ লাখ ১০ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
দেশে বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকলেও তা আগামী বাজেটে তা ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় সরকার। এ জন্য বাজেটে কিছু নীতি সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি আছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ, যা সংশোধন করে ৮ শতাংশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, মূল্যস্ফীতির প্রকৃত তথ্য এখন উঠে আসছে। সে কারণেই সাধারণ মানুষের মতো রেকর্ড-ছোঁয়া খাদ্য মূল্যস্ফীতি দেখেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদও।
শীত মৌসুমের কারণে শাকসবজির দাম এখন কম, কিন্তু নতুন বাজেট ঘোষণা হবে আগামী জুনে। ততদিনে কম দামে শাকসবজি পাওয়ার কথা নয়।
এদিকে মার্কিন ডলারের সংকট পুরোপুরি কেটে যায়নি। শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের অবস্থা খারাপ। রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ের প্রবাহটা একটু ভালো থাকলেও সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে টেকসই অবস্থাটা আসেনি এখনো।
এসব বিষয় সামনে রেখে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হতে পারে ৬ শতাংশ। যা টাকার অংকে ৬৩ লাখ ১৫ হাজার ৯২৩ কোটি। আর মার্কিন ডলারে এই অংক ৫১৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন।
চলতি অর্থবছরে এ লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ বা ৫৫ লাখ ৯৭ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা ধরা হলেও গত মাসে তা সংশোধন করে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ বা ৫৬ হাজার ৪৫ হাজার ১১৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
যদিও বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রাক্কলন অনুযায়ী এই হার ৫ শতাংশ অর্জন করাও সম্ভব হবে না।
২০২৫ সাল শুরুর আগে থেকেই নতুন বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে অর্থ বিভাগ ও এনবিআর সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছে।
এসব বৈঠকে উঠে আসা সুপারিশের প্রতিফলন রাখা হবে বাজেটে। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের বাজেট বক্তব্যেও তার উল্লেখ থাকবে।
এ ছাড়া অর্থ উপদেষ্টা বিভিন্ন খাতে নেওয়া সংস্কার কমিশন ও কমিটিগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা বলবেন বাজেট বক্তব্যে।
সেই সঙ্গে তাঁর বক্তব্যে থাকবে ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে শহিদ ও আহত ব্যক্তিদের অবদানের স্বীকৃতি। তবে অন্যান্য বাজেট বক্তব্যের মতো এবারের বাজেট বক্তব্য অত বড় হবে না।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সরকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য ২ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখতে পারে, জিডিপির ৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
যা চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা যা জিডিপির ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। সে হিসাবে বরাদ্দ বাড়তে পারে মাত্র ৫ হাজার কোটি টাকা। আর গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে (প্রকৃত) এই বরাদ্দ রাখা ছিল ১ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা যা জিডিপির ৩ দশমিক ৯ শতাংশ (প্রকৃত)।
সরকার ৮ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকার ব্যয় করতে ৫ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ করার লক্ষ্য ঠিক করেছে যা জিডিপির ৯ দশমিক ৩ শতাংশ।
এর মধ্যে কর রাজস্ব ৫ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা যা জিডিপির ৮ দশমিক ৫ শতাংশ, এনবিআর কর রাজস্ব ৫ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা যা জিডিপির ৮ দশমিক ২ শতাংশ, এনবিআরবহির্ভূত কর রাজস্ব ১৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ০ দশমিক ৩ শতাংশ এবং করবহির্ভূত রাজস্ব ৪৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ০ দশমিক ৭ শতাংশ।
বাজেট বাস্তবায়ন করতে রাজস্ব আহরণ করার পরও ঘাটতি রয়ে যাবে। এই ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা যা জিডিপির ৪ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যা ছিল ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা যা জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এই হিসাবে ঘাটতি বাড়বে ৭ হাজার কোটি টাকা।
ঘাটতি পূরণে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করবে যা জিডিপির ২ দশমিক ৪ শতাংশ। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ নিবে ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা যা জিডিপির ২ শতাংশ।
আর বৈদেশিক উৎস থেকে নিবে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা যা জিডিপির ১ দশমিক ৭ শতাংশ। গত অর্থবছরে যা ছিল ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি যা জিডিপির ২ দশমিক ৯ শতাংশ, ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি যা জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ ও ৯৫ হাজার কোটি টাকা যা জিডিপির ১ দশমিক ৭ শতাংশ।
সূত্রগুলো জানায়, অর্থনীতির বিদ্যমান বাস্তবতায় আগামী বাজেট অত বড় করার ইচ্ছা নেই সরকারের। কারণ, সরকারের আয়ের অবস্থা ভালো নয়।
অথচ ব্যয়ের চাপ ঠিকই আছে। মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখতে চলতি অর্থবছরে নিত্যপণ্য আমদানিতে অনেক শুল্ক ছাড় দিতে হয়েছে সরকারকে।
এ ঘাটতি পূরণে নতুন করে কিছু পণ্যে আবার মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আরোপ করতে আইন সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী চলতি অর্থবছরের বাজেট পাস হওয়ার দেড় মাস না যেতেই বিদায় নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। বর্তমান সরকার এক মাস আগেই সংশোধন করে তা ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনে।
এডিপির বরাদ্দের দিক থেকে আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে এরই মধ্যে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা।
জানা গেছে, আগামী বাজেটে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়া হবে না। প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে দেশি অর্থায়নের তুলনায় বিদেশি অর্থায়নে নজর থাকবে বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বেতন-ভাতা বাবদ প্রায় ৮২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, সাড়ে আট লাখ কোটি টাকার পরিবর্তে আগামী বাজেট বাস্তবভিত্তিক করা উচিত। মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নামিয়ে আনার অতি আশাবাদী চিন্তা থেকেও সরকারের সরে আসা দরকার।
অংশীজনদের সঙ্গে এখনই আলোচনা শুরু করার পরামর্শ দিয়ে সেলিম রায়হান বলেন, বাজেট পাসের এক মাস পার হওয়ার পরই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলো।
তখন আমরা দ্রুত একটি লক্ষ্যভিত্তিক পর্যালোচনা দাবি করেছিলাম। কাজটি হয়নি। বরাদ্দের অঙ্কে চোখের শান্তি মেলে। তার দরকার নেই। এখন সরকার অন্তত জুলাই আন্দোলনের চেতনার প্রতি সম্মান রেখে আগামী বাজেটে অর্থনৈতিক রূপরেখা দিক। এতে মানুষ দীর্ঘমেয়াদে উপকৃত হবেন।