স্থানীয়ভাবে আধিপত্য বিস্তারসহ চোরাকারবারির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে বরিশালে সুরুজ গাজী নামের এক যুবদল নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
গত সোমবার সন্ধ্যা রাতে মেট্রোপলিটন কাউনিয়া থানা থেকে আধা কিলোমিটার দূরত্বে শহরের ৩নং ওয়ার্ডের হাউজিং এলাকায় ত্রিশোর্ধ্ব যুবক সুরুজকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ফেলে রাখে একই এলাকার বাসিন্দা ও স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা শাহিন মিয়া এবং তার অনুসারীরা।
রাতেই তাৎক্ষণিক যুবদল নেতাকে উদ্ধার করে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে নেওয়ার আগে তার মৃত্যু হয়। এই হামলায় যুবদল নেতার দুই সহযোগীও গুরুতর আহত হয়েছেন, যাদের শেবাচিমে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
প্রাণবিয়োগের এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সোমবার রাতেই অভিযুক্ত ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক শাহিন মিয়ার ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
এ নিয়ে রাতভর কাউনিয়ায় উত্তেজনা চললেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযুক্তদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
পুলিশ ও বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, পূর্ববিরোধীয় জেরে সোমবার রাত ৮টার দিকে ৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সুরুজ গাজীর ওপর স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা শাহিন মিয়া সদলবলে হামলা করেন।
এবং একপর্যায়ে প্রকাশ্যে তিনিসহ তার বাহিনী যুবদল নেতাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করেন। এই সশস্ত্র হামলা প্রতিরোধ করাসহ যুবদল নেতাকে উদ্ধার করতে গিয়ে নয়ন এবং জাহিদ নামের দুইজন গুরুতর আহত হয়েছেন, যারা যুবদল নেতার অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে শেবাচিম হাসপাতালে নেওয়ার আগেই পথে যুবদল নেতা সুরুজের মৃত্যু হয় এবং নয়ন-জাহিদের শারীরিক অবস্থাও তেমন একটা ভালো নয় বলে জানা গেছে। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ জনতা স্বেচ্ছাসেবক দল নেতাকে না পেয়ে তার বাড়িতে আগুন জ¦ালিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
সংশ্লিষ্ট কাউনিয়া থানা পুলিশ এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কারণ কী তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বলতে না পারলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে তাদের অপরাধের একগুচ্ছ ফিরিস্তি। সূত্র নিশ্চিত করেছে, কাউনিয়ায় সোমবার রাতে যুবদল নেতার প্রাণহানির ঘটনার পেছনে রয়েছে স্থানীয়ভাবে আধিপত্য বিস্তারসহ কয়েকটি চোরাচালান নিয়ে নিজেদের মধ্যকার বিরোধ।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ শাসনামলে দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে মিলেমিশে এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা শাহিন মিয়া সব অবৈধ ব্যবসার ভাগ নিতেন, যার একটি অংশ যুবদল নেতা সুরুজকেও দেওয়া হতো।
৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তন হলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা পালিয়ে গেলে এই বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিএনপির সহযোগী সংগঠন যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের দুই নেতা শাহিন এবং সুরুজের মধ্যকার বিরোধ প্রকাশ্যে চলে আসে।
এবং তারা উভয়ে অবৈধ বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে গিয়ে মহানগর বিএনপি-যুবদল নেতাদের শেল্টার নিয়ে চলছিলেন।
সূত্র জানিয়েছে, মহানগর বিএনপি এবং যুবদলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে শাহিন মিয়া ও সুরুজ গাজী বিভাজিত হয়ে যে যার মতো করে এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছিলেন।
বিশেষ করে স্বর্ণ চোরাকারবারিসহ মাদক বাণিজ্য এবং ময়লাখোলায় আধিপত্য ধরে রাখা নিয়ে একসময়কার দুই বন্ধু শাহিন ও সুরুজের মধ্যে তুমুল বিরোধ তৈরি হয়।
বরিশালের চিহ্নিত স্বর্ণ প্রতারক সোনা কাওসারসহ কজন ছাত্রলীগ নেতার উসকানিতে এই বিরোধ থেকে সোমবার রাতে সংঘাত-রক্তপাত এবং শেষ পর্যন্ত প্রাণবিয়োগের মতো ঘটনার জন্ম দিল।
এ নিয়ে নিহত যুবদল নেতা সুরুজ গাজীর স্বজনেরা মিডিয়ায় মুখ না খুললেও যুবদলের একটি অংশ বলছে, স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা শাহিন এবং সোনা কাওসারদের সব অপকর্মের প্রতিবাদ করতে গিয়ে খুন হয়েছেন সুরুজ।
এলাকার বাসিন্দা জেলা যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক উলফৎ রানা রুবেলও অনুরূপ অভিযোগ করেছেন।
তিনি জানান, শাহিন স্বেচ্ছাসেবক দলের পদধারী নেতা হলেও আওয়ামী লীগের পুরো শাসনামল দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে মিলেমিশে এলাকায় মাদক বাণিজ্যসহ স্বর্ণ চোরাকারবারি করে আসছিল। এতে তার ছেলে ইমনসহ ছাত্রলীগের আরও কজন জড়িত ছিলেন।
এই যুবদল নেতার অভিযোগ, ৫ আগস্টের পরে আওয়ামী দোসররা অনেকে পালিয়ে গেলেও বেশ কয়েকজনকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে আগলে রেখেছিলেন স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা শাহিন মিয়া।
বিশেষ করে চিহ্নিত স্বর্ণ প্রতারক সোনা কাওসারকে আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেনি বিএনপি এবং তার সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এর প্রতিবাদ করছিলেন সুরুজসহ বিএনপির ত্যাগী নেতাকর্মীরা।
ধারণা করা হচ্ছে, অবৈধ কার্যকলাপের প্রতিবাদ করতে যাওয়াই কাল হয়েছে সুরুজের। পূর্বপরিকল্পিতভাবে তাকে সোমবার রাতে বাসার সম্মুখে কুপিয়ে হত্যা করেছে পড়শি স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা শাহিন ওরফে সোনা শাহিন।
নিহত যুবদল নেতার মরদেহের ময়নাতদন্ত করার জন্য লাশ শেবাচিমের মর্গে রাখা আছে জানিয়ে কাউনিয়া থানার ওসি নাজমুল নিশাত রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, যুবদল নেতার খুনের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার-পরবর্তী আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পুলিশ রোববার রাত থেকেই কাজ শুরু করে।
পাশাপাশি উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় ঘটনাস্থলে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে যে স্বর্ণ চোরাকারবার নিয়ে বিরোধ রয়েছে, তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কিছু আঁচ করতে পেরেছে। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেছেন, যুবদল নেতা খুনের অনেকগুলো হেতু রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কর্মকর্তা জানান, কাওসার ওরফে সোনা কাওসার একজন তালিকাভুক্ত স্বর্ণ প্রতারক, তার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগসহ ডজনখানেক মামলাও রয়েছে।
তিনি আওয়ামী লীগের গোটা শাসনামল চোরাকারবারিতে জড়িত ছিলেন এবং তার সেই বাণিজ্যের শেল্টার দেওয়া নিয়ে বিএনপির সহযোগী সংগঠনের দুই নেতার মধ্যেকার বিরোধ দেখা দেয়, যা উসকে দেয় শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা।
এই বিরোধীয় জের এবং রোববার রাতে এ নিয়ে বাসার সামনে কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে যুবদল নেতা সুরুজের ওপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা করে সোনা শাহিন ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা।
তাদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে সুরুজসহ তিনজন আহত হলে তাদের উদ্ধার করে শেবাচিমে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এর আগেই পথে যুবদল নেতার মৃত্যু হয়েছে।
সোমবার বিকেল ৩টার দিকে এ রিপোর্ট লেখার সময় বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে বলছেন, এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ধরতে একাধিক টিম কাজ শুরু করেছে এবং একটি হত্যা মামলার প্রস্তুতি চলছে। এতে যে বা যারা জড়িত থাকুক, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে, মন্তব্য করেন বিএমপির এই শীর্ষ কর্মকর্তা।
আপনার মতামত লিখুন :