স্থানীয় নির্বাচন দাবিতে দুরভিসন্ধি আছে

এফ এ শাহেদ

প্রকাশিত: মার্চ ৪, ২০২৫, ০৯:১৬ পিএম

স্থানীয় নির্বাচন দাবিতে দুরভিসন্ধি আছে

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এস এম জিলানী

রমজান ঘিরে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থামাতে অনেকটা ব্যর্থ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নাজুক অবস্থায় দেশের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা। রাজধানীসহ সারা দেশে প্রতিদিনই ঘটছে খুন, ধর্ষণ, চুরি-ছিনতাই।

এই বাজার সিন্ডিকেট ভাঙার উপায়, আইনশৃঙ্খলার উন্নতিসহ গণমানুষের অধিকার নিশ্চিতে নির্বাচনি রূপরেখাসহ সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে রূপালী বাংলাদেশের মুখোমুখি হয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এস এম জিলানী। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক এফ এ শাহেদ

রূপালী বাংলাদেশ: পবিত্র রমজান মাস ঘিরে কী ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিচালনা করছেন?  
এস এম জিলানী: বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে মুসলমানদের পবিত্র সিয়াম সাধনার মাস রমজান। দেশের সব ধর্মপ্রাণ মুসলমান নর-নারী যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে সিয়াম (রোজা) পালন করছেন।

আমরা প্রতিবছরের মতো এবারও সারা দেশে ইফতার কর্মসূচি রেখেছি। একটি সুন্দর ও কল্যাণময় রাষ্ট্র গঠনের জন্য, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার জন্য মহান আল্লাহর কাছে আমরা সবাই দোয়া চাই। 

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের সব নেতাকর্মীর সুস্থতা ও সমৃদ্ধি জীবনের জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই। মাসব্যাপী নানা ইফতার কর্মসূচির পাশাপাশি আমাদের সাংগঠনিক কর্মসূচি রয়েছে, সেগুলো সারা দেশে পরিচালিত হচ্ছে।

রূপালী বাংলাদেশ: বাজার সিন্ডিকেট ও দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে বর্তমান সরকার কতটা সক্রিয়?
এস এম জিলানী: অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা করি, রমজানে বাজার সাধারণ জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখবে। আমরা অনুরোধ করব, নিত্যপণ্যে যেন সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে না যায়। 

যদিও ইতিমধ্যে তেলের বাজারে অস্থিরতার সঙ্গে অতিপ্রয়োজনীয় চালসহ কিছু পণ্যের দামে অস্থির অবস্থা বিদ্যমান। অসাধু ও মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য একটি সিন্ডিকেট এখনো সক্রিয় রয়েছে। তবে প্রধান সমস্যা নিয়ে কেউ কথা বলে না। 

বিশেষ এই অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নিয়েছেন, তারা গণমানুষের ভোটে নির্বাচিত সরকার নয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, বর্তমান সরকার কতটুকু শক্তিশালী! তাদের জনগণের কাছে অতটা জবাবদিহিতা না থাকার কারণে চলমান কিছু বিষয়ে অস্থিরতা দূর করতে পারেনি তারা। 

যা জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার হলে সমাধান সম্ভব হতো। স্বৈরাচার পতন হলেও বাজার সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজদের সম্পূর্ণ পতন হয়নি।

রূপালী বাংলাদেশ: স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে চায় কিছু রাজনৈতিক দল, বিএনপি কী ভাবছে?
এস এম জিলানী: অতিতের ইতিহাস দেখলে স্পষ্ট  হওয়া যায়, বাংলাদেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নির্বাচন হলো স্থানীয় সরকার নির্বাচন। অতীতে যতগুলো স্থানীয় নির্বাচন হয়েছে, সেখানে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়েছে, রক্তাক্ত হয়েছে, অনেক মানুষ জীবন দিয়েছে। 

বিগত স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে ঘটেছে এমন ভয়াবহ ঘটনা। সেই বিষয়গুলো বিবেচনা করলে, দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলার নাজুক যে অবস্থা, এমন সময় স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া মানেই একটা বড় ধরনের ম্যাচাকারের দিকে দেশকে ঠেলে দেওয়া। এমন অবস্থা সৃষ্টি হলে বর্তমান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা একেবারে অসম্ভব বিষয়। 

যে বা যারা আগে স্থানীয় নির্বাচনের দাবি করছে, তাদের স্পষ্টতই একটি দুরভিসন্ধি রয়েছে। যার মাধ্যমে তারা স্থানীয় নির্বাচন আগে অনুষ্ঠিতের মধ্য দিয়ে দেশে দাঙ্গা বাধিয়ে জাতীয় নির্বাচন বিলম্ব করতে চায়। 

যেখানে জনগণ তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে এবং ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করবে একটি মহল। বলাবহুল্য, এক শ্রেণির মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। নির্বাচন যত পিছিয়ে যাবে বিএনপি তত অজনপ্রিয় হবে। যে ধারণার কোনো সত্যতা নেই।

কারণ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের মধ্যে বর্তমান সবচেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় দল বিএনপি।  স্থানীয় নির্বাচনের কথা যারা বলছে, তাদের অসৎ উদ্দেশ্য পরিষ্কার। জনগণ তাদের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে যাদের পক্ষে রায় দেবে, তারা সরকার গঠন করে দেশ শাসন করবে- এটাই হওয়া উচিত। আমরাও সেটি প্রত্যাশা করি। 

রূপালী বাংলাদেশ: বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অভিযোগ, বিএনপি সংস্কার নয় শুধুই ভোট চায়, কারণ কী? 
এস এম জিলানী: অনেকেই বলে বিএনপি সংস্কারের কথা না বলে শুধু ভোট চায়, কথাটি সঠিক নয়। বিএনপি দেশের জনগণের কথা বলে, তাদের মনের কথা তুলে ধরে। 

গত  ৩ মাস আমিসহ আমার সংগঠনের নেতাকর্মীদের একটি টিম সারা বাংলাদেশের ৫২টির বেশি জেলা ঘুরে প্রান্তিক জনগণের সাথে কথা বলেছি, তাদের মনের ভাব, আশা-আকাক্সক্ষা শুনেছি। মানুষ এখন ভোট দিতে চায়, ভোটের মাধ্যমে তাদের সত্যিকারের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করে তাদের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করতে চাই। 

এটিই বর্তমান দেশের মানুষের মনের ইচ্ছা ও আবেগ যার বাস্তব চিত্র আমরা দেখেছি। সে ক্ষেত্রে, নির্বাচিত সরকার থাকলে জনগণের কাছে জবাবাদিহি থাকবে। 

৫ বছর পর ভোটের জন্য বিবেচনা করেই জনগণের কল্যাণে কাজ করবে ভোটের সরকার। তারা কাজ না করলে জনগণ তাদের পরের বার ভোট দেবে না। ফলে, জবাবদিহিতার জাইগা থেকেই নির্বাচিত সরকার সর্বোচ্চ কাজ করবে।

অনেকে বলছে নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে। আমি বলতে চাই, জনগণ যদি বিএনপি কে ভোট দেয় ক্ষমতায় আনতে চায় তা হলে অবশ্যই ক্ষমতায় আসবে তাতে তাদের সমস্যা কোথায়! 

জনগণ সাংবিধানিকভাবে এই রাষ্ট্রের মালিক। জনগণ মালিকানা তখনই ফিরে পায় যখন তার ভোট ৫ বছর পরপর পছন্দের প্রতিনিধিকে দিতে পারে। জনগণের সেই ভোটে বিএনপি বা যেকোনো দল ক্ষমতায় আসতে পারে। সেখানে জাতীয় নির্বাচন কেন বন্ধ করতে হবে! বিএনপি নির্বাচন চায় কারণ, গ্রাম-গঞ্জ থেকে শুরু দেশের প্রতিটি মানুষ এখন জাতীয় নির্বাচন চায়।  

রূপালী বাংলাদেশ: দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং নিরপাত্তা হুমকির মুখে পড়ার কারণ কী দেখছেন? 
এস এম জিলানী: দেশের আইনশৃঙ্খলা অবনতি এবং নিরপাত্তার বিষয়ে আমরা সব সময় বলে আসছি,  বিগত স্বৈরাচারী-ফ্যাসিবাদ যে সরকার ছিল, তারা রাষ্ট্রের সবগুলো কাঠামো পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করেছে। 

বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে, গত ১৭ বছর তাদেরকে দলীয় ক্যাডার বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নষ্টই শুধু করেনি বরং মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাদের প্রতি আক্রোশ তৈরি করেছে গণমানুষের হৃদয়ে। 

যার বহিঃপ্রকাশ দেখেছি ৫ আগস্ট। পুলিশের ওপর মানুষের আক্রোশ এতটাই বেশি ছিল, আক্রমণের মধ্যে তা ফুটে উঠেছিল এবং যার রেশ এখনো বিদ্যমান। আতঙ্কের জায়গা থেকে পুলিশ এখনো রুটিন ডিউটি বা সঠিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। 

যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দুর্বল হয়ে যায়, মনোবলের ঘাটতি দেখা যায় স্বাবাভিকভাবেই সন্ত্রাসী চক্র মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়। যার ফলে, দেশে আইনশৃঙ্খলার বর্তমান পেক্ষাপটে চুরি- ছিনতাই, ধর্ষণ, ডাকাতিসহ নিরপাত্তা হুমকির মুখে পড়ছে।

রূপালী বাংলাদেশ: আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ বা নিষিদ্ধের বিষয়ে কী বলবেন?
এস এম জিলানী: গত ১৭ বছর ধরে আওয়ামী লীগের জুলুম-অত্যাচার, দুঃশাসন থেকে স্বৈরাচারী হয়ে উঠে বর্বরোচিত নির্যাতন-নিপীড়ন, হত্যা, গুম, হামলা-মামলা করেছে দেশের মানুষের ওপর । 

মানুষ সেই জুলুমের জবাব দিয়েছে ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট।  প্রথম শাস্তি আ.লীগ ইতিমধ্যই পেয়েছে। এরপর দেশে বিচারব্যবস্থা আছে, সেখানে দোষীদের বিচারের মাধ্যমে অবশ্যই শাস্তি হতে পারে। 

দেশে বিএনপি একটি অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল ও আ.লীগও একটি বড় রাজনৈতিক দল ছিল। তাদের কর্মফলের কারণে এখন কোণঠাসা। 

তবে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা অন্য একটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করতে পারি না, সে সিদ্ধান্ত নেবে দেশের জনগণ। তাদের ভোটের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করলে সেটাই হবে বড় শাস্তি। 

আমরা কোনো রাজনৈতিক দল ধ্বংস করে দেব না, গণতন্ত্র চর্চার জন্য রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন রয়েছে।

রূপালী বাংলাদেশ: যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের নিয়ে একত্রে নির্বাচন ও সরকার গঠন করবেÑ বিএনপি বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
এস এম জিলানী: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, সাংগঠনিক নেতা তারেক রহমান অনেক আগেই ঘোষণা দিয়েছেন জনগণের ভোটে ক্ষমতায় গেলেও জতীয় সরকার গঠন করবেন। 

আমাদের সঙ্গে যারা যুগপৎ আন্দোলন, লড়াই-সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন সেসব গণতন্ত্রমনা দলগুলো নিয়েই জাতীয় সরকার গঠন হবে। তারেক রহমান দেশ গঠনের ৩১ দফা ঘোষণা দিয়েছেন। সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়তে কাজ করবে বিএনপি।

রূপালী বাংলাদেশ: আগামীর বাংলাদেশের রাজনীতি কেমন দেখতে চান আপনারা?
এস এম জিলানী: আমি প্রত্যাশা করি, বিগত যে ফ্যাসিস্ট দুঃশাসনের মধ্য দিয়ে দেশের আইন-বিচার-প্রশাসাসন-শিক্ষা থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি বিভাগ ধ্বংস করে দিয়েছে, সেগুলো পুনরুদ্ধার করতে হবে। 

এদিকে, বিশেষ করে ভারত যেভাবে এই দেশকে মেধাশূন্য করার উদ্দেশ্যে শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের পরিকল্পিনা করেছিল, তা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তবে, আমরা চাই আগামী বাংলাদেশ হবে বৈষম্যহীন, সুশাসিত,  দুর্নীতিমুক্ত, দখলদারমুক্ত বাংলাদেশ।
রূপালী বাংলাদেশ: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
এস এম জিলানী: আপনাকে এবং দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকেও ধন্যবাদ।

 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!