শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর

গাঁটছড়া বাঁধা ইইডির কর্মকর্তারা!

সেলিম আহমেদ

প্রকাশিত: মার্চ ৫, ২০২৫, ১২:৩২ এএম

গাঁটছড়া বাঁধা ইইডির কর্মকর্তারা!

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ক্ষমতার পট পরিবর্তনে বিভিন্ন দপ্তর-অধিদপ্তরে আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখন অনেকটা কোণঠাসা। অনেকে হারাচ্ছেন চাকরি, আবার কাউকে বদলি করা হচ্ছে ঢাকার বাইরে। 

তবে এর ব্যতিক্রম শুধু শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে (ইইডি)। দপ্তরটিতে আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তারা এখনো বুক উঁচু করে ছড়ি ঘুরাচ্ছেন অন্যের ওপর। অনেকে পাচ্ছেন অস্বাভাবিক পদোন্নতিও।

 তাদের একজন সিরাজুল ইসলাম। বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা প্রকৌশলী পরিষদের কয়েকবারের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম আওয়ামী লীগের ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে টানা ১৭ বছর ছিলেন প্রধান কার্যালয়ে। 

ক্ষমতার পরিবর্তনের পর আবার পেয়েছেন পদোন্নতিও। এখন তিনি মানিকগঞ্জ জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী। একই অবস্থা আওয়ামীপন্থি এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জাফর আলী শিকদারেরও। 

তিনিও টানা ১৮ বছর প্রধান কার্যালয়ে থেকে ছড়ি ঘুরিয়েছেন সবার ওপরে। তবে ছাত্রদের আপত্তির  মুখে সম্প্রতি তাকে বদলি করা হয়েছে। এ দুই কর্মকর্তার বাইরে আরও অন্তত ১১ জন আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা টানা ৭ থেকে ২২ বছর পর্যন্ত কর্মরত রয়েছেন ইইডির প্রধান কার্যালয়ে। 

এ নিয়ে ক্ষুব্ধ অধিদপ্তরটির বিগত সরকারের আমলে বঞ্চিতরা। তারা বলছেন, গত সরকারের আমলে আমাদের দলীয় ট্যাগ দিয়ে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছিল। এখনো দেখি একই অবস্থা। 

সরকার পরিবর্তনের পর আওয়ামীপন্থিরা এখনো বহাল তবিয়াতে রয়েছেন। ফলে পট পরিবর্তন হলেও আমাদের কোনো লাভ হচ্ছে না। 

তবে এ প্রসঙ্গে ইইডির প্রধান প্রকৌশলী (রুটিন দায়িত্ব) মো. আলতাফ হোসেন বলেন, চাকরিবিধি অনুযায়ী সব নিয়ম মেনেই পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। আর এই পদোন্নতি, বদলি ও পদায়ন করা হচ্ছে মন্ত্রণালয় থেকে। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইইডিতে সিরাজ ও জাফর ছাড়াও আরও অন্তত ১১ জন সহকারী ও উপসহকারী প্রকৌশলী আছেন, যারা টানা ৭ থেকে ২২ বছর পর্যন্ত কর্মরর্ত রয়েছেন। 

তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন বিগত সরকারের আমলে সুবিধাভোগী। তারা দলীয় ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে উন্নয়নকাজে অনিয়ম, ঠিকাদারদের সঙ্গে আঁতাত, মাসোহারা, নিজস্ব লোককে কাজ দেওয়া ছাড়াও আত্মীয়স্বজনের নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুলে কাজ করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। 

অনেকেই করেছেন ঢাকায় বাড়ি-গাড়ি। জীবনযাপনও করছেন বিলাসবহুল। অথচ সরকারি আইনমতে, একজন সরকারী কর্মকর্তা একই কর্মস্থলে তিন বছরের বেশি সময় কর্মরত থাকতে পারবেন না। 

ইইডির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দপ্তরটিতে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরতদের তালিকায় আরও রয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম। তিনি প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত দীর্ঘ ৯ বছর ধরে। 

এর বাইরে উপপরিচালক আবু সাঈদ চৌধুরী ২২ বছর, সহকারী প্রকৌশলী গোলাম সাকলাইন ১০ বছর, জরজিসুর রহমান ১৭ বছর, মফিকুল ইসলাম ১০ বছর, উপসহকারী প্রকৌশলী শাহ মোহাম্মদ রাকিব ৭ বছর, মিজানুর রহমান ৭ বছর, জালাল হুসেন, ৮ বছর, মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ ৭ বছর,  আব্দুর রহিম রাসেল, ৬ বছর, মেহেদী হাসান ৭ বছর এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা লোকমান হোসেন  ১৯ বছর ধরে প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত রয়েছেন। 

ইইডির সংশ্লিষ্ট অনেক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে এসব কর্মকর্তা প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত থাকার কারণে দেশজুড়েই রয়েছে তাদের নেটওয়ার্ক। 

কাজ দেওয়া-নেওয়ার অনিয়মের পাশাপাশি অনেকেই নিজেদের আত্মীয়স্বজনকে দিয়ে ঠিকাদারি করিয়েই কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সিরাজুল ইসলাম ও জাফর আলী শিকদার। 

এ দুই কর্মকর্তা মিলে রাজধানীর খিলগাঁওয়ে বানিয়েছেন বিশাল বাড়ি। বাড়ির তথ্যটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য সরেজমিনে যান এই প্রতিবেদক। বাড়িটির কেয়ারটেকারের সঙ্গে কথা হলে তারা বাড়িটি এ দুই প্রকৌশলীর বলে জানান। 

এছাড়া বাড়িটি টু-লেটের বিজ্ঞাপনের নম্বরে কল দিয়ে দেখা যায় সেটি জাফর আলী শিকদারের নম্বর। 

সূত্র আরও জানায়, সিরাজুল ইসলামকে পদোন্নতি দিয়ে মানিকগঞ্জে বদলি করা হলেও জাফর আলী শিকদারকে বহাল রাখা হয় প্রধান কার্যালয়ে। 

এ নিয়ে সম্প্রতি কিছু শিক্ষার্থী শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে কেন তাকে প্রধান কার্যালয়ে এখনো রাখা হয়েছে জানতে চান। পরে তাকে বদলি করা হয় ঢাকা জেলায়। 

এদিকে সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীদের প্রতি তিন বছর পর পর বদলি করতে হবে। অর্থাৎ, একই দপ্তরে তিন বছরের বেশি সময় থাকা যাবে না। বিষয়টি নির্দিষ্ট করে সরকার প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে। 

২০১৫ সালের ৮ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জেলা ও মাঠ প্রশাসন) মো. মাকছুদুর রহমান পাটওয়ারীর সই করা ‘মাঠ পর্যায়ে কর্মরত কর্মচারীদের বদলি’সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘একই পদে তিন বছরের অধিককাল যাবৎ নিয়োজিত কর্মচারীকে বাস্তব অবস্থাভেদে অন্যত্র বদলি করতে হবে।’ 

এসবের চর্চা ইইডিতে হয় না বললেই চলে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইইডির কর্মকর্তারা চলছেন অনেকটা নিজেদের খেয়ালখুশিমতো। এই দপ্তরে যারা ক্ষমতাসীন, দলীয় লবিং এবং যে যত বেশি অনিয়ম করতে পারবেন, তার অবস্থান ততটা শক্তিশালী। 

অন্যদিকে গত ১০ ফেব্রুয়ারি ১৩ জন নির্বাহী প্রকৌশলীকে বদলি ও পদায়ন এবং ৮ জন ডিপ্লোমা প্রকৌশলীকে পদোন্নতি দিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্ব দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। 

সূত্র বলছে, এতে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি সিরাজুল ইসলামকে নির্বাহী প্রকৌশলী করা হয়। অথচ এই পদে পদোন্নতির জন্য সাত বছর সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি করার বিধান রয়েছে। 

কিন্তু পাঁচ বছর চাকরিকাল থাকা অবস্থায় তাকে পদোন্নতি দিয়ে মানিকগঞ্জে পদায়ন করা হয়েছে। এর বাইরে পদোন্নতি পাওয়া বাকি সাত ডিপ্লোমা প্রকৌশলীর মধ্যে অন্তত চারজন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের বঙ্গবন্ধু পরিষদে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। 

সূত্র আরও বলছে, বাকি যে ১৩ জন নির্বাহী প্রকৌশলীকে বদলি করে কম গুরুত্বপূর্ণ জেলায় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাদের অনেকেই বিএনপি-জামায়াত মতাদর্শে বিশ্বাসী। 

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সাবেক প্রধান প্রকৌশলী বলেন, প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে মো. আলতাফ হোসেনের দায়িত্ব গ্রহণের এক মাসের কম সময়েও এত পদোন্নতি-পদায়ন ইইডির ইতিহাসে নজিরবিহীন। 

আর যারা পদোন্নতি ও ভালো জেলায় পদায়ন পেয়েছেন, তারা বেশির ভাগই আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগেী হিসেবে পরিচিত। দেখে মনে হচ্ছে, এর পেছনে আওয়ামী লীগেরই কেউ কলকাঠি নাড়ছেন। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছিুক অন্তত ১০ জন নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী আলতাফ হোসেন চাঁদপুরে বাড়ি ‘হ’ আদ্যক্ষরের সদ্য সাবেক এক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর ঘণিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। 

আর এই তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির ক্যাশিরার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তিনিই মূলত ইইডির হর্তাকর্তা ছিলেন। 

তারা আরও জানান, সাধারণত ‘বিশেষ উদ্দেশ্য’ ছাড়া দায়িত্বে গ্রহণের মাত্র এক মাসের মাথায় কোনো প্রধান প্রকৌশলী এত বড়সংখ্যাক নির্বাহী প্রকৌশলী পদোন্নতি-পদায়ন করেন না। 

এর পেছনে অন্য কোনো ‘অনৈতিক সুবিধা’ অথবা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির বিষয়ও জড়িত থাকতে পারে। এর আগে গত ২০ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতৃত্বে থাকা এবং নানা অনিয়মের অভিযোগে প্রধান প্রকৌশলী (রুটিন দায়িত্ব) মো. রায়হান বাদশা, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আফরোজা বেগম, সমীর কুমার রজক দাসকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করে অফিস আদেশ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। 

আর প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব দেওয়া হয় চট্টগ্রাম সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জালাল উদ্দিন চৌধুরীকে। এরপর জালাল উদ্দিন অবসরে গেলে গত ১৯ জানুয়ারি দায়িত্ব পান তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আলতাফ হোসেন। 

প্রসঙ্গত, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, নতুন ভবন নির্মাণ, বিদ্যমান ভবনগুলোর সম্প্রসারণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত ও সংস্কার এবং আসবাব সরবরাহ করে। এ ছাড়া মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, আইসিটি ল্যাব স্থাপন, ইন্টারনেট সংযোগ, আইসিটি-সুবিধা সরবরাহও করে।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!