ঢাকা বুধবার, ০৫ মার্চ, ২০২৫

অনলাইন প্রতারণা ঠেকাতে নজরদারি

মেহেদী হাসান খাজা
প্রকাশিত: মার্চ ৫, ২০২৫, ০১:১৭ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ঈদের আগে অর্থাৎ রমজানের শুরুতেই অনলাইনে কম দামে ভালো প্রডাক্ট কেনাকাটা করুন- এমন চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে অনেকেই অনলাইন থেকে কেনাকাটা করে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অবশ্য এসব বিষয় নিয়ে অনলাইনে সোশ্যাল মিডিয়ায় নজরদারি জোরদার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। 

সূত্র জানায়, রমজান এলেই অনলাইনে দেশজুড়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে প্রতারক চক্র। তা ছাড়া অনলাইন কেনাকাটায় আর্থিক প্রতারণা বেড়েছে ৭০ শতাংশ।

পুলিশ ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতারণা ঠেকাতে ক্রেতাদের সচেতন হতে হবে এবং রমজানের মধ্যে অনলাইনে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে কেনাকাটায় নজরদারি বাড়াতে হবে।  তাদের দাবি, মানুষকে লোভ-লালসা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। অন্যথায় এসব অপরাধ দিন দিন বেড়েই চলবে। 

রমজান ঘিরে সক্রিয় অনলাইন প্রতারক চক্র: গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, পাল্টে গেছে প্রতারণার কৌশল। রমজানকে ঘিরে সক্রিয় হয়েছে অনলাইন প্রতারক চক্র। প্রতারকরা বিভিন্নভাবে মানুষকে ঠকিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। কেউ কেউ লোভে পড়েও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। দেশজুড়ে ছড়িয়ে আছে এ প্রতারক চক্র। 

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে নতুন কৌশলে কাজ করছে এসব চক্র। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, মধ্যবিত্তরা বেশির ভাগ কেনাকাটায় এসব প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।  ঝামেলার ভয়ে তারা আইনের আশ্রয়ও নিতে আগ্রহী নয়।

সম্প্রতি রূপালী বাংলাদেশের এক অনুসন্ধানে জানা যায়, এই প্রতারকদের প্রতারণার ভিন্ন কৌশল রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব অপর্কম করছে। 

এদিকে, প্রতারণা থেকে রক্ষা পেতে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। তারা বলছেন, অতিরিক্ত লোভের কারণে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন অনলাইন ব্যবহার করা ক্রেতারা।

অন্যদিকে এসব বিষয়ে অপরাধ বিশ্লেষকেরা বলছেন, সম্প্রতি লক্ষ্য করা গেছে, রমজানে এবং এর শুরুতে অনলাইন প্রতারণা বেড়েছে। এসব প্রতিরোধে গোয়েন্দা পুলিশ ও সাইবার ইউনিটকে সতর্ক হতে হবে এবং প্রতারকদের আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় সাধারণ মানুষ প্রতারিত হতেই থাকবে। 

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত ছয় মাসে অনলাইনে অসংখ্য মানুষ প্রতারণার শিকার হয়েছেন। মোট কথা, এ প্ল্যাটফর্মে অপরাধ বেড়েছে ৭০ শতাংশের বেশি।  যেটা গত বছরে ছিল ৫০ শতাংশের মতো। 

প্রতারিত হওয়ার গল্প: প্রতারণার শিকার হয়েছেন একটি ব্যাংকের পিয়ন আলম মিয়া।  তিনি বলেন, ‘প্রথম রমজানে অনলাইনে একটি মাধ্যমে গাজীপুর সাইনবোর্ড এলাকায় ১০০০ টাকার থ্রিপিস ২৫০ টাকায় বিক্রি করছে। 

এমন বিজ্ঞাপন দেখে ২০টি থ্রিপিসের টাকা পাঠিয়ে দিই।  এরপর চক্রটি মোবাইল নম্বর বন্ধ করে রাখে। পরে বুঝতে পারলাম, প্রতারণার শিকার হয়েছি। পুলিশকে জানিয়েছেন কি? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এসব ঝামেলায় আর যায়নি। ভেবেছি বাড়ির সবাইকে থ্রিপিস কিনে দেব, সেটা আর হলো কোথায়। ফের বেতন পেয়ে হয়তো নতুন করে কিনতে হবে। 

প্রতারণার শিকার বিলকিস খাতুন বলেন, রমজান উপলক্ষে একটি মোবাইলের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় একটি পেইজে। সেখানে বলা হয়, ১৫ হাজার টাকার মোবাইল ফোন মাত্র ৬ হাজার টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। পরে ৫টা ফোনের অর্ডার করি এবং বিকাশে প্রতারক চক্রকে ১৫ হাজার টাকা পাঠাই। পরে তারা একটি কুরিয়ারে খেলনা মোবাইল দেয়। এরপর আমি বুঝতে পারলাম প্রতারিত হয়েছি।  

রমজান উপলক্ষে অনলাইনে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে কেনাকাটা করে প্রতারণার শিকার হওয়া একাধিক ব্যক্তি জানান, প্রতারক চক্ররা ফেসবুক পেজ বা আইডি প্রমোট করে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে সর্বস্বান্ত করছে। এরা বেশির ভাগ রমজানকে টার্গেট করে। এদের ধরতে সরকার ও প্রশাসনের সহযোগিতা চান তারা।

সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়, রমজান ঘিরে দেশজুড়ে অনলাইনে সক্রিয় প্রতারক চক্র। অনলাইন কেনাকাটায় আর্থিক প্রতারণা থেকে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান করা হলো। 

প্রতারণা ঠেকাতে নজরদারি বৃদ্ধি:  ব্যক্তিগত বা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে অনলাইনে নিয়মিত আর্থিক লেনদেন করেন অনেকেই।  আর তাই সাইবার অপরাধীরা ফিশিং ওয়েবসাইট, ভুয়া বিজ্ঞাপন প্রদর্শনসহ বিভিন্ন কৌশলে ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে অর্থ চুরি করছে। এমনকি কখনো কখনো ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে পরে অর্থও দাবি করছে তারা। 

ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নিত্যনতুন কৌশলে ফাঁদে ফেলে ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আর তাই ব্যবহারকারীদের অনলাইন প্রতারণা থেকে রক্ষা করতে পুলিশের পক্ষ থেকে সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। 

সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরের একটি বৈঠকে পুলিশ প্রধান এসব নির্দেশনা দেন। সেখানে তিনি বলেন, সাইবার ইউনিট নিরাপত্তা জোরদার করে অনলাইন প্রতারকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশনা দেওয়া হলো।

এই বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) রেজাউল করিম মল্লিক বলেছেন, আমরা লক্ষ করি রমজান মাস আসলেই অনলাইনে প্রতারক চক্র সক্রিয় হয়। অভিযোগের ভিত্তিতে ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সাইবার ইউনিট আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। 

ফেসবুক ব্যবহারকারীকে বোকা বানিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে : সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রমজানে বেশির ভাগ ফেসবুক ব্যবহারকারীকে বোকা বানিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয় একটি চক্র। তারা ফেসবুক স্ক্যাম বা প্রতারণা করে থাকে।  ফেসবুক প্ল্যাটফর্মের পাশাপাশি মেসেঞ্জার ব্যবহার করেও প্রতারণা করে দুর্বৃত্তরা। আর এ কারণে প্রতারিত হওয়ার সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, কয়েকটি চক্র রমজান ও ঈদ এলে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করে প্রতারণা করে। তবে মানুষ লোভে পড়ে এমন প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। লোভ এড়িয়ে চললে অনলাইন প্রতারণা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসবে।  

এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সাইবার ক্রাইম দল ইতিমধ্যে নানা ধরনের প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছে। কোনো বিষয়ে সন্দেহ বা প্রতারিত হলেই নিকটস্থ থানা বা পুলিশের বিভিন্ন হটলাইন নম্বরে কল করে সহযোগিতা পেতে পারেন। আমরা সবাই একটু সচেতন হলেই এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়াতে পারি।

ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, সম্প্রতি ফেসবুকে বা কোনো মাধ্যমে টাকা দিয়ে পণ্য কেনাকাটায় প্রতারণার শিকার হওয়া ব্যক্তিরা আমার কাছে এসেছেন পরামর্শের জন্য। প্রথম রমজানেও একজন এসেছেন।  বিকাশ প্রতারকদের কাছে টাকা খুইয়েছেন কেউ কেউ। এসব ঘটনায় কেউ কেউ মামলাও করেছেন। 

ঢাকা মেট্রোপলিটনের পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী জানান, রমজানের কেনাকাটা উপলক্ষে ছিনতাই, টানা পার্টি, চাঁদাবাজি, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টির অপতৎপরতা রোধে পুলিশি টহল ও সাইবার ইউনিটের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।

 কেউ অনলাইনে বা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতারিত হলে সরাসরি পুলিশকে জানালে পুলিশ এসব বিষয়ে তদন্ত করবে এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

এই বিষয়ে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (অপারেশনস) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ জানান, কেউ সাইবার অপরাধের শিকার হলে পুলিশের সাহায্য নিতে পারেন। তা ছাড়া সবাইকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

এ বিষয়ে সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, সময়ের প্রেক্ষাপটে অপরাধের ধরন, অপরাধ সংঘটিত হওয়ার প্রক্রিয়া পাল্টে যাচ্ছে। বিভিন্ন ডিভাইস ও প্রযুক্তিকেন্দ্রিক উপকরণগুলো ব্যবহার করে অপরাধীরা অপরাধের ক্ষেত্র তৈরি করছে।  

বিশেষ করে রমজান এলে সাধারণ মানুষ কম টাকায় ভালো পণ্য পাওয়ার আশায় অনলাইন বেছে নিচ্ছে। আর এই সুযোগ নিচ্ছে প্রতারক চক্র। তারা সহজ-সরল মানুষকে জিম্মি করে বিভিন্ন কৌশলে অর্থ আদায় করছে। এসব প্রতারণা মোকাবিলা করতে হলে মানুষকে লোভলালসা এড়িয়ে চলতে হবে।  

এ ছাড়া পুলিশকে সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে এবং মানুষকে এসব বিষয়ে সতর্ক করতে হবে তাহলেই অনেকটা অনলাইন প্রতারণা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।