দূষণে বিপর্যস্ত তুরাগ ‘নদ’

জহিরুল ইসলাম, গাজীপুর

প্রকাশিত: মার্চ ৫, ২০২৫, ০৯:০৭ এএম

দূষণে বিপর্যস্ত তুরাগ ‘নদ’

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

জীবন সত্তার তুরাগ দেখলে এখন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় এটা একটা নদ। কোনো স্রোত নেই, প্রাণ নেই। নদের পাড়ের মানুষ প্রতিনিয়ত ময়লা-আবর্জনা ফেলছে এতে। কল-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যরে দূষণেও বিপর্যস্ত নদটি। ফলে এর বিভিন্ন জায়গা এখন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। 

বংশী নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে গাজীপুর ও ঢাকা জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদটির দৈর্ঘ্য ৬২ কিলোমিটার। গড় প্রস্থ ৮২ মিটার। নদ অববাহিকার আয়তন ১ হাজার ২১ বর্গ কিলোমিটার। সারা বছর পানির প্রবাহ থাকলেও সাড়ে ১৩ মিটার গভীরতার নদটিতে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত পানির প্রবাহ কম থাকে। 

তখন এর গভীরতা হয়ে যায় সাড়ে ৪ মিটার। নদটি সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নে এসে দুটি ধারায় বিভক্ত হয়েছে। মূল শাখাটি আমিনবাজার হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে পড়েছে। অপরটি বিরুলিয়া থেকে আশুলিয়া-টঙ্গী হয়ে বালু নদে মিলিত হয়েছে।

অন্যদিকে তুরাগ নদের ছোট একটি শাখা গাজীপুরের কালিয়াকৈরের কাছ থেকে উৎপন্ন হয়ে কড্ডা এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে টঙ্গী খালে পড়েছে। স্থানীয়রা এই শাখা নদকেও তুরাগ নদ নামে চেনে। 

গ্রীষ্মকালে ক্ষীণকায় হয়ে পড়লেও এটি একটি সক্রিয় নদ, যা সারা বছর নৌচলাচলের জন্য উপযোগী। গত কয়েক দিন নদ অববাহিকা ঘুরে দেখা গেছে, কোনাবাড়ী বিসিক, মৌচাক ও আশপাশের এলাকার শত শত কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য পানি জুরাইন বাইদ এলাকার একটি খাল দিয়ে সরাসরি নদীতে এসে পড়ছে। 

চান্দনা চৌরাস্তা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বাইপাইল ব্রিজের নিচ দিয়ে বিষাক্ত বর্জ্য পানি নামছে তুরাগে। ইসলামপুরের ভাঙ্গা ব্রিজ এলাকার একটি ড্রেন দিয়ে কালচে রঙের পানি নামছে সর্বক্ষণ। কাশিমপুর, গাজীপুর সদর উপজেলার মনিপুর, টঙ্গীর বিসিকসহ বিভিন্ন এলাকার শিল্পকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে এই নদে। 

একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, প্রায় ৪০০ শিল্প কারখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে এ নদে । নৌকায় করে ঘুরে বিভিন্ন জায়গায় দেখা গেল অবলীলায় বর্জ্য ফেলা হচ্ছে এতে। 

নদের পাড়েই জন্ম ৭০ বছর বয়সি নেপাল চন্দ্র বর্মনের। নদের এই অবস্থা দেখে তার মুখে শুধুই আফসোস। তার শৈশবের স্মৃতি বর্ণনা করে বলেন, একসময় এই নদে স্রোত ছিল। চোখের সামনে কীভাবে নদটি ধীরে ধীরে দূষণের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে গেল, তা তার কাছে অবিশ্বাস্যই মনে হয়। নেপাল বলেন, আগে তুরাগ নদ অনেক সুন্দর ছিল।

 বর্তমানে এটা ড্রেনের উপযুক্ত হয়ে গেছে। তার মতো অনেকেই শৈশবে গোসল, সাঁতার কাটাসহ মাছ শিকার করেছেন এই নদে। নদে মাছ ধরে অনেকেই যেমন জীবন-জীবিকা চালিয়েছেন, তেমনি খাবারের পাতেও তুরাগের মাছ ছিল একটি স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু দূষণে বিপর্যস্ত এ নদে এখন মাছের দেখা মেলে না। 

বর্ষাকালে পানির প্রবাহ বাড়লে জেলেদের মাছ ধরতে দেখা গেলেও সেই মাছে থাকে দুর্গন্ধ। মাছ ধরে দু-চারদিন পানিতে না রেখে সে মাছ খাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। গত সোমবার টঙ্গী ব্রিজ থেকে নৌকায় করে পূর্বদিকে গিয়ে দেখা যায় নদের পানি একবারেই কালো। পানিতে দুর্গন্ধ। 

কখনো কখনো দুর্গন্ধের মাত্রা এতটাই তীব্র যে নৌকায় বসে থাকা মুশকিল। নদের তীরে যেসব কল-কারখানা দেখা গেছে, তার প্রায় সব কটির বর্জ্যই এসে পড়ছে নদে। কোনো কোনো কারখানা থেকে বিভিন্ন ‘রঙের’ পানি এসে পড়ছে। নদের দুই ধারে যেসব জনবসতি আছে, সেখানকার মানুষ আবর্জনা ফেলছে এই নদে। 

গত মঙ্গলবার কাশিমপুর থেকে নৌকায় করে ঘুরে দেখা যায় নদের পানিতে ভাসছে নানা ধরনের আবর্জনা। প্লাস্টিক, পলিথিন ব্যাগ, কাপড়, মরা পশুর দেহসহ নানা ধরনের আবর্জনা। কোথাও কোথাও নদে দীর্ঘদিন ধরে আবর্জনা ফেলায় ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। 

তুরাগ নদের দুই পাড়ে দীর্ঘ এলাকাজুড়ে একদিকে যেমন ঘনবসতি গড়ে উঠেছে, অন্যদিকে শিল্প-কারখানা হয়েছে সমানতালে। নদের বিভিন্ন জায়গা এখন ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলেই দেখা যায়। গত কয়েক বছরে তুরাগতীরের বিভিন্ন জায়গা অবৈধ দখলমুক্ত করা হলেও দূষণের মাত্রা কমেনি বলে পরিবেশবাদীরা জানান। 

পরিবেশবাদীরা বলছেন, একটা সময় শিল্প-কারখানা স্থাপনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল বেশি, পরিবেশকে নয়। বেসরকারি মালিকানায় শিল্প-কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে সব আমলেই সরকার উদার দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছে। বেশি শিল্প স্থাপন করে বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাই ছিল লক্ষ্য। 

আর সেজন্য পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়েছে বরাবরই। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে তুরাগ নদে দূষণের মাত্রা বাড়তে থাকে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। অনেক শিল্পকারখানা থেকে দূষণের মাত্রা কমলেও নতুন নতুন শিল্প গড়ে ওঠায় সার্বিকভাবে দূষণের মাত্রা কমেনি। 

তুরাগপাড়ে যেসব শিল্প-কারখানা আছে, তাদের অনেকেরই তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার বা ইটিপি নেই। আবার যাদের ইটিপি রয়েছে, তাদের অনেকেই খরচ বাঁচানোর জন্য সেটি ব্যবহার করছেন না, যার কারণে তরল বিষাক্ত বর্জ্য সরাসরি নদে পড়ছে।

 গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ইটিপি রয়েছে, তাদের অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিক যথাযথভাবে ইটিপি ব্যবহার করতে চান না। কারণ, এর সঙ্গে প্রায় বড় অঙ্কের খরচ জড়িত। 

ওই কর্মকর্তা বলেন, একটি কারখানা যদি যথাযথভাবে তরল বর্জ্য পরিশোধন করে, সেই প্রতিষ্ঠানের মাসে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা খরচ হয়। ফলে অনেক কারখানার মালিকই এই আর্থিক ব্যয়ভার বহন করতে চান না। ঐ কর্মকর্তা আরও বলেন, নদীদূষণের জন্য শুধু কারখানার বর্জ্যই দায়ী নয়, সঙ্গে পয়ঃবর্জ্যও দায়ী। 

যেসব শিল্পে ২০০ জনের বেশি শ্রমিক থাকবেন, তাদের পয়ঃবর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা নিতে হবে। বাস্তবতায় এ ধরনের পয়ঃবর্জ্য পরিশোধনাগার দেখা যায় না। 

এ বিষয়ে গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আরেফিন বাদল রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, তুরাগ নদ দূষণমুক্ত রাখতে পরিবশে অধিদপ্তরের গাজীপুর অফিস সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যেই ইটিপিবিহীন কারখানাগুলোর তালিকা তৈরি করে তাদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। 

বেশ কয়েকটি কারখানার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যাদের ইটিপি থাকার পরেও তা যথাযথভাবে ব্যবহার করছে না, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। 

তবে বিশিষ্টজনেরা মনে করছেন, নদী দূষণমুক্ত করার লক্ষ্যে পরিবশেবাদীরা অনেক আন্দোলন করলেও বিষয়টি নিয়ে নদীতীরের বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে কোনো সচেতনতাই নাই। নদী দূষণমুক্ত রাখতে হলে নদীতীরের মানুষকে সর্বাগ্রে সচেতন করাই জরুরি।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!