ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪

শিখন সংকটের শঙ্কা দশম শ্রেণির ৩৭ লাখ শিক্ষার্থীর

উৎপল দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: নভেম্বর ২১, ২০২৪, ১২:৩১ এএম

শিখন সংকটের শঙ্কা দশম শ্রেণির ৩৭ লাখ শিক্ষার্থীর

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

২০২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বিতরণের জন্য ৪০ কোটির বেশি বিনামূল্যের পাঠ্যবই মুদ্রণে কাজ করছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। মোট বইয়ের মধ্যে প্রাথমিকে ৯ কোটির বেশি ও মাধ্যমিক স্তরে রয়েছে ৩১ কোটি বই। বই মুদ্রণ পরিস্থিতির বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আগামী শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা জানুয়ারি প্রাথমিক স্তরের সব শিক্ষার্থীরাই বই পাবে। কিন্তু মাধ্যমিক স্তরের সব শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সব বই পাবে না। সব বই ছাড়া শিক্ষাবর্ষ শুরু হলে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির সব শিক্ষার্থীই কমবেশি শিখন সংকটে পড়বে। তবে সর্বোচ্চ শিখন সংকটে পড়ার শঙ্কা রয়েছে ২০২৫ সালে নবম থেকে দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের। কারণ, এই শিক্ষার্থীরা ২০১২ সালের কারিকুলামে তৈরি পাঠ্যবইয়ের দুই বছরের সূচি (কনটেন্ট) এক বছরে শেষ করে ২০২৬ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নিবে। তাই ৩৭ লাখেরও বেশি আগামীর এসএসসি পরীক্ষার্থীদের শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন থেকেই পাঠ্যসূচিসহ সব বই দিয়ে শ্রেণিকক্ষে শিখন-শেখানো কার্যক্রম নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি নিশ্চিত না হলে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে এই শিক্ষার্থীদের বড় ধরনের শিখন সংকট তৈরি হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিক্ষক, গবেষক ও কারিকুলাম বিশেষজ্ঞরা।   

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের গত ১ সেপ্টেম্বরের পরিপত্রে বলা হয়েছে, ‘২০২৫ সালে দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা (২০২৬ সালের অনুষ্ঠিতব্য পরীক্ষা) নেওয়ার লক্ষ্যে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখা অব্যাহত রেখে পূর্বের জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০১২ এর আলোকে প্রণীত সংশোধিত ও পরিমার্জিত পাঠ্যপুস্তকসমূহ (অর্থাৎ ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ব্যবহৃত পুস্তক) শিক্ষার্থীদের সরবরাহ করা হবে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০১২ অনুসারে প্রণীত শাখা বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষাভিত্তিক এই পাঠ্যপুস্তকসমূহের একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা হবে যাতে শিক্ষার্থীরা এক শিক্ষাবর্ষের মধ্যেই পাঠ্যসূচিটি সম্পন্ন করতে পারে। পাঠদান ও মূল্যায়ন পদ্ধতি জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০১২ অনুসারে পরিচালিত হবে’।

মাধ্যমিক স্তরের দশম শ্রেণির সংশোধিত ও পরিমার্জিত এসব বইয়ের বিষয়ে এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, এই শ্রেণির প্রায় ৩৭ লাখ ৬৮ হাজার ৪৫৬ শিক্ষার্থীর মধ্যে বিতরণের জন্য প্রয়োজন প্রায় ৫ কোটি ৪১ লাখ ৩০ হাজার ১২টি বই। ২০২২ সালের কারিকুলাম অনুযায়ী, এই  শ্রেণিতে বিষয় ছিল ১৪টি। ২০১২ সালের কারিকুলাম অনুযায়ী আগামী শিক্ষাবর্ষে এই শ্রেণির বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষায় রয়েছে মোট ৩৩টি বিষয়। অর্থাৎ বিষয় বেড়েছে প্রায় ১৯টি। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে এই শ্রেণির প্রতি শিক্ষার্থী পাবে ১৫টি বই।

বই মুদ্রণের বিষয়ে জানা গেছে, সংশোধিত ও পরিমার্জিত এসব বইয়ের পাণ্ডুুলিপি ও সিলেবাস চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রায় ১ কোটি ১০ হাজার বই ডিরেক্ট পারচেজ মেথড (ডিপিএম) পদ্ধতিতে মুদ্রণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেয়েছে। বাকি প্রায় সাড়ে চার কোটি বই ওপেন টেন্ডার মেথড (ওটিএম) পদ্ধতিতে মুদ্রণের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। আগামী ২৬ নভেম্বর দরপত্র খোলা হবে। তারপর মূল্যায়ন কমিটি দরপত্র মূল্যায়ন শেষ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয় কাজ শেষে নির্বাচিত প্রেসগুলোকে বই মুদ্রণের নির্দেশ দিতে ডিসেম্বরের অর্ধেক সময় চলে যেতে পারে। অর্থাৎ শিক্ষাবর্ষ শুরুর জন্য মাত্র পনেরো দিন সময় নিয়ে শুরু হতে পারে বই মুদ্রণের কাজ। ফলে এই শ্রেণির সব শিক্ষার্থী যে শিক্ষাবর্ষ শুরুর সময় থেকে সব বই পাবে না তা নিশ্চিত। ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও বই পাওয়া নিয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি হলেও দশম শ্রেণির ক্ষেত্রে বিষয়টি বড় ধরনের শিখন সংকট তৈরি করতে পারে।

শিক্ষক, গবেষক ও কারিকুলাম বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২৫ সালের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা চলতি শিক্ষাবর্ষে নবম শ্রেণিতে এক বছরের পড়া শেষে করে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার নতুন কারিকুলাম বাতিল করে ২০১২ সালের কারিকুলাম অনুযায়ী নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষার আয়োজন করছে। গত ৫ আগস্ট সাবেক সরকারের পতনের আগে-পরে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শিক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়। ফলে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সিলেবাসকে সংশোধন-পরিমার্জন করে সংক্ষিপ্ত করা হয়। কিন্তু সিলেবাস তেমন ছোট হয়নি। ফলে পড়া নিয়ে চাপে ছিল নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। যেমন- নবম শ্রেণির গণিত বিষয়ে ১০০ নম্বরের তিন ঘণ্টার বার্ষিক পরীক্ষায় একজন শিক্ষার্থীকে চার ধরনের ৪৫টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। আবার একাদশ শ্রেণিতে শিক্ষাবর্ষ শুরুর সাড়ে তিন মাস পর শিক্ষার্থীরা বই পেলেও বাংলা বইয়ে আগের ১২টি গদ্য, ১২টি পদ্য, ১টি নাটক ও ১টি উপন্যাস দিয়েই পাঠ্যসূচি পাঠানো হয় কলেজে। নবম ও একাদশ শ্রেণির পরীক্ষা নিজ প্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠিত হয়। তাই সমস্যা হলেও মানিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী- যারা ২০২৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিবে তাদের ক্ষেত্রে দুই বছরের পাঠ্যসূচি ‘কাস্টমাইজ’ বা প্রয়োজন অনুযায়ী বিন্যাস (গুছিয়ে) করে এক বছরে শেষ করা চ্যালেঞ্জিং। কারণ এক্ষেত্রে পাঠ্যসূচি প্রণয়নে ‘ভার্টিকাল’ ও ‘হরাইজন্টাল’ পদ্ধতি প্রয়োগ করে নবম শ্রেণির সঙ্গে দশম শ্রেণির, দশম শ্রেণির সঙ্গে একাদশ শ্রেণির পাঠ্যসূচির এলাইনমেন্ট বা সমন্বয় হয়েছে কী না তা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া এই সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচিকে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে প্রদানের জন্য ‘টিচার্স গাইড’ (টিজি) প্রয়োজন।

এ ছাড়া অনেক তরুণ নতুন শিক্ষক এখন নিয়োগ পেয়েছেন। দশম শ্রেণির সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচির ওপর তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণও প্রয়োজন। অর্থাৎ শিক্ষাবর্ষ শুরুর দিন পাঠ্যসূচিসহ সব বই পাওয়া, পাঠ্যসূচিতে এলাইনমেন্ট থাকা, টিজি গাইড ও শিক্ষকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ ২০২৬ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

তবে শিক্ষার্থীদের কোনো শিখন সংকট হবে না বলেই দাবি করেছে এনসিটিবি সূত্র। সূত্রের মতে, জানুয়ারির প্রথম দিনই শিক্ষার্থীদের সব বই দেওয়ার চেষ্টা করছে এনসিটিবি। তা যদি না হয় তাহলে শিক্ষার্থীদের সিলেবাসসহ অন্ততপক্ষে প্রধান পাঁচটি বই দেওয়া হবে।

বইগুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় এবং বিজ্ঞান। বাকি ১১টি বই যদি কোনো কারণে দেরি হলেও ৩১ জানুয়ারির মধ্যেও সরবরাহ করা যায় তাহলে শিখন সংকট হবে না। কারণ ১ থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা পাঁচ বিষয়ের বই পড়তে পড়তে বাকি বইগুলো পেয়ে যাবে।

এনসিটিবি সূত্রের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জানুয়ারির প্রথম দিন সাড়ে ৩৭ লাখ শিক্ষার্থীকে পাঁচটি বই দিলেও মোট বই লাগবে প্রায় দুই কোটি। এর জন্য কাগজ লাগবে ৫ লাখ ৪০ হাজার রিম। প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজার রিম ছাপার হিসেবে এই পরিমাণ বই ছাপতে লাগবে প্রায় একশ দিনের বেশি। এ ছাড়া যেখানে এই শ্রেণির বইয়ের এখনো টেন্ডার প্রক্রিয়াই শেষ হয়নি সেখানে ছাপার কাজ শুরু করতে সময় আরও বেশি লাগবে বলেই ধারণা করা যায়।

এদিকে দশম শ্রেণির বই, পাঠ্যসূচি, টিজি ও শিক্ষক প্রশিক্ষণের সার্বিক বিষয়ে এনসিটিবি সদস্য (শিক্ষাক্রম) প্রফেসর রবিউল কবীর চৌধুরী এনসিটিবি সূত্রের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন।

রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, বই, সিলেবাস সব কমপ্লিট। শিক্ষাবর্ষ শুরুর প্রথম দিনই শিক্ষার্থীরা সব পেয়ে যাবে।

তিনি আরও বলেন, যেহেতু ২০১২ সালের কারিকুলামের সঙ্গে শিক্ষকরা আগে থেকেই পরিচিত, তাই শ্রেণিকক্ষে শিখন শেখানো কার্যক্রমে কোনো সমস্যা হবে না। এলাইনমেন্টকে গুরুত্ব দিয়েই পাঠ্যসূচি প্রস্তুত করা হয়েছে। কোন অধ্যায়গুলো শিক্ষার্থীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য হতে পারে, লার্নিং আউটকাম কী বা অ্যাক্টিভিটিজ কী হবে ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েই পাঠ্যসূচি প্রস্তুত করা হয়েছে। 

কিন্তু চলতি বছরের নবম শ্রেণির পাঠ্যসূচি সংক্ষিপ্ত হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি, আবার সাড়ে তিন মাস পর একাদশ শ্রেণির বই পেলেও পাঠ্যসূচি ছিল একইÑ এ বিষয়ে  শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভিন্নমতের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা এমন হওয়ার কথা না, শিক্ষকরাই এই পাঠ্যসূচি তৈরি করেছেন।

যেহেতু কাস্টমইজড পাঠ্যসূচিতে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পড়ানো হবে তাই এ বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হবে কী না সে প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রশিক্ষণ সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে আমাদের পরামর্শ থাকবে। তবে এটি বাস্তবায়ন করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) গবেষক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, পুরো বিষয়টি বই পাওয়ার ওপর নির্ভর করছে। বই দেরিতে পেলে শিক্ষার্থীদের বাড়তি চাপ নিতে হয়। শিখন সংকটও তৈরি হতে পারে। কারণ শিক্ষার্থীদের অনেক ধরন রয়েছে। মধ্যমপারগ বা মধ্যমস্তরের শিক্ষার্থী, স্লো লেভেল শিক্ষার্থীÑ তাদের ক্ষেত্রে ‘শিখন চাপ’ তৈরি হতে পারে। আর শিখন-গ্যাপ বিষয়টি শনাক্তকরণের জন্য গবেষণা দরকার। তাই এটি এখনই বলা যাবে না। তবে স্বভাবিকভাবে এক কারিকুলাম থেকে আরেক কারিকুলামে ‘ট্রানজিকশনের’ প্রভাব পড়তেই পারে।

ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মাহবুব হাসান লিংকন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, যেহেতু নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা দশম শ্রেণিতে সম্পূর্ণ নতুন একটি সিলেবাসে দুই বছরের পড়া এক বছরে পড়বে তাই শিখন সংকটের আশঙ্কা থেকেই যায়। এটা বোঝা যাবে তাদের প্রি-টেস্ট ও টেস্ট পরীক্ষার পর। তখন শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপও বাড়বে।

এ ছাড়া রাজধানীর টিকাটুলি কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক বলেছেন, এনসিটিবি থেকে যেভাবে বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেওয়া হবে সেভাবেই বাস্তবায়ন করা হবে, তবে পাঠ্যসূচি যদি আগে দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে শ্রেণি শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় সুবিধা হয়।

আরবি/জেডআর

Link copied!