রূপালী বাংলাদেশকে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী

নির্বাচন দেরিতে হওয়ার কোনো সুযোগ নেই

এফ এ শাহেদ

প্রকাশিত: মার্চ ৫, ২০২৫, ০৯:৪৪ পিএম

দেশে গণতান্ত্রিক ধারা সচল রাখতে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপিসহ বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সরব অবস্থান। দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের দাবি। আবার জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ কিছু দল বলছে, আগে সংস্কার তারপর নির্বাচন। সংস্কারের ফল এখনো দৃশ্যমান নয়। দ্বিতীয় রিপাবলিক নিয়ে প্রচার চালানো হচ্ছে। নির্বাচন না সংস্কার- এসব প্রশ্নের মারপ্যাঁচের মধ্যে দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে। রাজধানীসহ সারা দেশে প্রতিনিয়ত ঘটছে অপ্রীতিকর ঘটনা। সংস্কার, ভোট, আইনশৃঙ্খলার অবনতিসহ সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক এফ এ শাহেদ

রূপালী বাংলাদেশ: দেশে গণতান্ত্রিক ধারা চালু ও অনুশীলন শুরু করতে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ২৪-এর অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কাক্সিক্ষত সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে করণীয় কি?

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: দীর্ঘ বছর ধরে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচনের পরিবেশ না থাকায় দেশের শান্তিশৃঙ্খলা থেকে শুরু করে সব কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত ১৬ বছর ধরে বিভিন্ন ত্যাগ শিকার করে আমরা গণমানুষের অধিকার ফিরিয়ে দিতে রাজপথে লড়াই-সংগ্রামে যুক্ত ছিলাম। দেশের জনগণের মালিকানা ফিরিয়ে দিতেই আমরা সবাই মিলে লড়াই-সংগ্রাম করেছি। সংগ্রামের মুল আশা-আকাক্সক্ষাই ছিল গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হবে। প্রত্যেকটি মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারবে, দল গঠন করতে পারবে, তার দলের চিন্তাভাবনা জনগণের কাছে নিয়ে যেতে পারবে এবং জনগণের সিদ্ধান্তে ভোটের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকার গঠন করতে পারবে। যে নির্বাচিত সরকার জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ এবং নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীদের নির্বাচিত করা গণতন্ত্র ব্যবস্থার অন্যতম একটি শর্ত এবং দেশের একজন নাগরিক হিসেবে এটা তার ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকারও। ফলে, মূল স্প্রিট এবং দেশের প্রকৃত মালিকানা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে তা হলেই গণতান্ত্রিক ধারা চালু হবে। 

রূপালী বাংলাদেশ: জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের নতুন দলকে কীভাবে দেখছেন?

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: জুলাই অভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্যই ছিল একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা। যেখানে স্বাধীনভাবে দল গঠন করতে পারবে, দলের চিন্তাভাবনা জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারবে। ছাত্ররা আগে দুটি দল গঠন করেছিলেন আরও একটি দল নতুন করে ঘোষণা করেছে, সামনে আরও দল গঠন হবে এটা ভালো দিক, আমরা এটাতে স্বাগত জানাই।  উন্মুক্ত-স্বাধীনভাবে অধিকারের জন্যই আমরা সবাই মিলে যুদ্ধ করেছি। তবে, নতুন দল নিয়ে তাদের চিন্তা-ভাবনা, পরিকল্পনা যেটায় থাকুক সেটা তারা জনগণের কাছে নিয়ে যেতে পারেন। এগুলো বাস্তবায়নের একমাত্র পথ হলো জনগণের ম্যান্ডেড নিয়ে সংসদে যাওয়া। সংসদে উপস্থাপনের মাধ্যমে তাদের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণের অন্য কোনো পথ নেই। 

যারা নতুন চিন্তা-ভাবনা নিয়ে আসছেন তারা জনগণের কাছে আদর্শ নিয়ে যাবেন জনগণ তাদের ম্যান্ডেড দিলে সে আশা পূরণ করবেন। আমার দলের যেমন চিন্তাভাবনা আছে অন্যান্য দল-গোষ্ঠীরও তেমন আছে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। এগুলোর প্রতি সবাইকে সহনশীল হতে হবে। ভিন্নমতকে সম্মান জানাতে হবে, সেই সংস্কৃতি বাংলাদেশে আনতে হবে। এই সংস্কৃতি না আনলে গণতান্ত্রিক যে আকাক্সক্ষা তা পূরণ করা যাবে না।

রূপালী বাংলাদেশ: আগামী নির্বাচনে বিএনপি জনগণের কী আশা-আকাক্সক্ষা তুলে ধরবে এবং কীভাবে বাস্তবায়ন করবে?

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষিত রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে বিএনপির এই ৩১ দফার বার্তা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে বিএনপি। আগামী নির্বাচনে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে ৩১ দফা বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে দেশ ও জাতির সমঅধিকার বাস্তবায়ন করবে। এসব দফা আমি চাইলেই বাস্তবায়ন করতে পারব না, আমার কোনো অধিকার নেই। এটি জনগণের অধিকার। আগামী নির্বাচনে জনগণের রায়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনলে সংসদে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। 

সুতরাং, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের অধিকার আছে তাদের নিজস্ব আশা-আকাক্সক্ষা, মতাদর্শ তুলে ধরার। জনগণের ম্যান্ডেড নিয়ে ক্ষমতায় গেলে তারা সংসদে তা বাস্তবায়ন করবেন। এখানে দ্বিতীয় রিপাবলিক বা যেকোনো চিন্তা একটি দলের থাকতেই পারে, আমি তার সাথে ভিন্নমতও পোষণ করতে পারি। তবে সম্মান রাখতে হবে সবার মতামতের ওপর। জনগণ যাতে সমর্থন দেবে তা কার্যকর করতে কোনো সম্যস্যা নয়। ভিন্নমত থাকার অর্থ এই নয় যে, আর কোনো মতামত থাকতে পারবে না। 

রূপালী বাংলাদেশ: জুলাই অভ্যুত্থানের বিচারের আগে নির্বাচন নয়- এর যৌক্তিকতা দেখেন? আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: কিছু মানুষের চাওয়া এমন হতে পারে, এটি তাদের মতামত। আপনি যদি এখন কোনো পরিবর্তন চান সেক্ষেত্রে দুভাবে করতে পারেন। একটি, ঐকমত্যের ভিত্তিতে, অন্যটি জনগণের ভোটের মাধ্যমে। গণতন্ত্র বিশ্বাস করলে এর বাইরে কোনো পথ খোলা নেই।  গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে ভিন্নমত থাকবে যা সম্মানের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে হবে। সাংঘর্ষিক রাজনীতি যেটা শেখ হাসিনা দেশকে দিয়েছিল, সেদিকে দেশ যেন না যায় এটাই বিএনপির মূল চিন্তা। প্রত্যেকের একে অন্যের মতের প্রতি সহিষ্ণু-সহনশীলতা ও সম্মান থাকতে হবে। জনগণের মতামতকে সম্মান দেখিয়ে আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালাতে হবে। অন্য কোনো মন-মানসিকতা থেকে গণতন্ত্র সচল রাখা সম্ভব নয়। 

রূপালী বাংলাদেশ: জাতীয় নির্বাচন ডিসেম্বরের পর বা আরও দেরি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি?
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: নির্বাচন বিলম্ব হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জুলাই আন্দোলনে বেশি মৃত্যুবরণ করেছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। সবচেয়ে বেশি নেতাকর্মী জেলে গেছেন, পঙ্গু হয়েছেন। তবে, এই আন্দোলনের সফলতা বাংলাদেশের মানুষের। আজকে যে সরকার আছে সেটা সবার সমর্থনপুষ্ট সরকার।  কিন্তু তারা যদি নিরপেক্ষতা হারায়, বিশ্বাস হারায়, আস্থা হারায় তাহলে এ দায়-দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে। নির্বাচন দেরিতে হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এখন নির্বাচন যত দেরি হবে, দেশ তত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে, দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, দেশের দ্রব্যমূল্যের বিষয়টি দিন দিন খারাপ হচ্ছে, সেটা আরও খারাপের দিকে যাবে। 

সুতরাং ডিসেম্বরের ভেতরই নির্বাচন হবে, পরে হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এত ত্যাগ, তাদের নির্বাচিত সরকার, প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার প্রয়োজন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা নির্বাচিত সরকারের হাতে দেশের ভার দিতে পারব তত দ্রুত সম্যাসার সমাধান হবে। খালি সরাকরি কর্মকর্তা দিয়ে সমস্যা সমাধান ও দেশ চালানোর সুযোগ নেই। 

রূপালী বাংলাদেশ: জাতীয় ঐকমত্যের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকারের সঙ্গে বিএনপির অবস্থান কি?

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: জাতীয় ঐকমত্যের প্রেক্ষিতে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের সঙ্গে বসতে বিএনপির কোনো আপত্তি নেই। বিএনপি বরাবরই জাতীয় ঐকমত্যের বিষয়ে সহমত পোষণ করে আসছে। এটার জন্য আমরা সবসময় প্রস্তুত। 

রূপালী বাংলাদেশ: অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আস্থাহীনতার কোনো জায়গা সৃষ্টি হচ্ছে কি?আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: স্বৈরাচার সরকার পতনের পর বিশেষ মুহূর্তে ক্ষমতা গ্রহণ করে অন্তর্বর্তী সরকার। তারা মৌলিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে দ্রুততম সময়ের একটি সুশৃঙ্খল, সুন্দর, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে যেটি তাদের সবচেয়ে বড় কাজ।  দেশের ক্রিয়াশীল সব রাজনৈতিক দলসহ সর্বোপরি দেশের মালিক যে জনগণ তারাও দ্রুত নির্বাচন চায়। যে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণই নির্ধারণ করবে তার প্রতিনিধি হয়ে কে বা কারা আগামী দিনে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। কাজেই যত দ্রুত সম্ভব অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেটি করবে, তত দ্রুততম সময়ে দেশের সবকিছু স্বাভাবিক হবে।  অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে না পারলে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে না। সবার সমর্থন নিয়ে গঠিত এই সরকার যদি আস্থা হারায় বা আস্থার জায়গা ভেঙে যায় সেটি হবে খুবই দুঃখজনক। 

আমরা আশা করব, তারা সেই আস্থা হারাবে না। যে আস্থার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে আমরা চাই সেই আস্থা ভঙ্গ না হোক। দেশ আস্থাহীনতায় ফিরে না যাক। শেখ হাসিনা আস্থা হারানোর কারণে পতিত হয়েছে, আমরা আর সেই আস্থা হারানোর জায়গাতে ফিরে যেতে চাই না। 

রূপালী বাংলাদেশ: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: আপনাকে এবং দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকেও ধন্যবাদ।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!