অদৃশ্য জাদুর কাঠির ইশারায় এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে বিতর্কিত চিত্রনায়িকা নিপুণ আক্তার। গোপনে দেশ ছাড়তে গিয়ে বিমানবন্দরে আটক হলেও বিশেষ মহলের তদবিরে সে-যাত্রায় ছাড়া পান এবং আত্মগোপনে চলে যান। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে এবং রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থেকে বিদেশে পালিয়ে যেতে তৎপর রয়েছেন।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর গ্ল্যামার জগতের বাসিন্দা নিপূণ জুলাই-আগস্টে প্রকাশ্যে ছাত্র-জনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে রাজপথ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সব ক্ষেত্রে নিপুণের সরব উপস্থিত ছিল চোখে পড়ার মতো। সাত মাস পার হলেও নিপুণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি সরকারের কোনো সংস্থা।
ছাত্র-জনতা হত্যাযজ্ঞের মদদদাতা এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু না হওয়ায় নিপুণের খুঁটির জোর কোথায়, সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
গত দেড় দশকে স্বৈরাচারের দোসর ও শেখ সেলিমের বান্ধবী নিপুণ আক্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও বিএফডিসিতে ছাত্রদের বিপক্ষে অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়েছিল। অবৈধভাবে শিল্পী সমিতির প্যাড ব্যবহার করে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে স্টেটমেন্ট দিয়েছিলেন।
নিপুণের বিরুদ্ধে অভিযোগ এখানেই শেষ নয়। রাজউকে তদবির বাণিজ্য, শেখ সেলিমের সহযোগিতায় বিভিন্ন পুলিশ নিয়োগ ও বদলি, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির পিকনিক ও ইফতারের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাট, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অনুষ্ঠান ভাগিয়ে নেওয়া, এফডিসির বহুতল ভবন থেকে কমিশন, চলচ্চিত্র দিবস পালনের নামে মোটা অঙ্কের টাকা লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া মুনাফার ১০ শতাংশ প্রদানের শর্তে হিন্দি সিনেমা আমদানির পক্ষে পুরো ইন্ডাস্ট্রির বিপক্ষে গিয়ে মতামত দেন নিপুণ। পাহাড়সমান অভিযোগ নিয়ে নায়িকার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। আওয়ামী সরকারের পতনের পর থেকেই তার ব্যবহৃত মুঠোফোন বন্ধ রয়েছে।
৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর গা ঢাকা দিয়েছিলেন এই অভিনেত্রী। তবে গত ১০ জানুয়ারি সকালে সিলেট বিমানবন্দর দিয়ে বিজি-২০১ ফ্লাইটে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হলে তার পাসপোর্ট অফলোড করে দেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ। নিপুণের নামে মামলা না থাকায় পরে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেওয়া হয়। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকেই লাপাত্তা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
এরপর থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় নিপুণকেও আর মিডিয়ার সামনে আসতে দেখা যায়নি। যদিও সেদিন বিমানবন্দরে প্রথম দেখা যায় তাকে। অভিনেত্রীর বিমানবন্দরে প্রবেশের একাধিক স্থিরচিত্র পাওয়া গেলেও তার দাবি, আটকের খবর সত্য নয়। যদিও সংবাদমাধ্যমে তিনি নিজেই বলেছিলেন তার বোনকে এগিয়ে দিতে গিয়েছিলেন। পরে সুর পাল্টে আটকের খবর মিথ্যা দাবি করেন।
নিপুণের এক মুখে দুই কথা বলা এটাই প্রথম নয়, এর আগেও পাওয়া গেছে। এমনকি নিজের মনমতো প্রশ্ন কিংবা নিউজ না হলে সাংবাদিকদের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের ভয় দেখাতেন।
নায়িকা থেকে কোটিপতি বনে যাওয়া নিপুণের বিরুদ্ধে রয়েছে পাহাড়সমান অভিযোগ। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা শেখ সেলিমের আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন তিনি। মিডিয়ার সবাই জানতেন নিপুণ সেলিমের বান্ধবী এবং রক্ষিতা। বিষয়টি অনেকের জানা থাকলেও সামনে আসেনি কখনো। তবে ক্ষমতার পালাবদলের পর বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। বিগত দিনে বিভিন্ন অত্যাচার সহ্য করে নীরব থাকলেও সরকারপতনের পর মুখ খোলেন তার সাবেক স্বামী।
নায়িকার বিরুদ্ধে হুমকিসহ আনেন নানা অভিযোগ। এমনকি একমাত্র কন্যাসন্তানকে বাবার কাছ থেকে রেখেছেন হাজার মাইল দূরে। যখনই সন্তানের সঙ্গে কথা বলতে চাইতেন, তখনই শেখ সেলিমের ভয় দেখাতেন বলে তার সাবেক স্বামী জানিয়েছেন।
শেখ সেলিমের ছত্রছায়ায় বেপরোয়া ছিলেন নিপুণ। এ নিয়ে চলচ্চিত্রাঙ্গনের কলাকুশলীদের ক্ষোভ অনেক দিনের। শিল্পী সমিতির নির্বাচনে পরাজিত হয়েও শেখ সেলিমকে দিয়ে আদালতে প্রভাব খাঁটিয়ে সাধারণ সম্পাদকের চেয়ার বাগিয়ে নেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন তদবির বাণিজ্য করতেন নিপুণ। মোটা অঙ্কের টাকায় রাউজক থেকে বিভিন্ন কাজ নিয়ে দিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার এই সিন্ডিকেটে ছিল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বাঘা বাঘা প্রভাবশালী ব্যক্তি।
এমনকি শেখ সেলিমের সঙ্গে নিপুণ গড়ে তোলেন অবৈধ প্রেমের সম্পর্ক। প্রকাশ্যে বাবার বন্ধু পরিচয় দিলেও নিপুণের সঙ্গে ছিল শেখ সেলিমের অনৈতিক সম্পর্ক, যা চলচ্চিত্রপাড়ায় কারো অজানা নয়। নায়িকাকে খুশি করতে বিভিন্ন উপহার থেকে শুরু করে নিপুণ যা বলতেন তা-ই করতেন একসময়ের এই প্রভাবশালী নেতা।
তার মধ্যে অন্যতম বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউতে নিপুণের প্রসাধনী ও লাইফস্টাইল কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান ‘টিউলিপ নেইলস অ্যান্ড স্পা’ পার্লারটি তাকে উপহার দেন শেখ সেলিম।
অভিযোগ রয়েছে, এই স্পা সেন্টারের আড়ালে নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালান নিপুণ। বেশ কয়েকবার প্রশাসন অভিযান চালালেও শেখ সেলিমের কারণে তা প্রকাশ্যে আসেনি। বরং বহাল তবিয়তে তার অপকর্ম চালিয়ে যান নিপুণ।
নিপুণের বিরুদ্ধে ‘টিউলিপ নেইলস অ্যান্ড স্পা’ পার্লার থেকে প্রায় কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, স্পায় অভিযান চালিয়ে দীর্ঘদিন ভ্যাট ফাঁকির তথ্য পেয়েছে এনবিআর ও ভ্যাট গোয়েন্দা বিভাগ। কিন্তু এখনো নিপুণকে আইনের আওতায় আনা হয়নি। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও বহাল তবিয়তে এই নায়িকা।
নিপুণ একটি রাজনৈতিক দলের এক কেন্দ্রীয় নেতার মাধ্যমে গোপনে মামলা থেকে রেহাই পাওয়ার তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন বলে গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করেছে। জুলাই বিপ্লবের আগে শেখ সেলিমের সহায়তায় ভ্যাট ফাঁকিসহ পার্লারে ম্যাসাজের আড়ালে অবৈধ কাযর্ক্রম চালাতেন তিনি। এবার সওয়ার হয়েছেন শিগগির নির্বাচনপ্রত্যাশী একটি দলের নেতার ওপর।
শেখ সেলিমের শত শত কোটি টাকা বিদেশে নিরাপদে পাচার করার দায়িত্ব পালনকারী হাসিনার সহযোগী এই নিপুণকে প্রশ্রয় দিচ্ছে কে প্রশ্ন চলচ্চিত্রপাড়ার অনেকের। চাউর রয়েছে, হেলাল খানের নির্দেশে লন্ডনে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাকে সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আটক করেও ছেড়ে দেওয়া হয়। নিপুণকে নিরাপদ রাখার দায়িত্ব নিয়েছেন এই নেতা। বিনিময়ে কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। নিপুণ বর্তমানে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছেন না, তেমনি প্রকাশ্যেও আসছেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও জাসাসের আহ্বায়ক চিত্রনায়ক হেলাল খান নিপুণের নতুন রক্ষক হিসেবে হাজির হয়েছেন। কর ফাঁকি, অনৈতিক ব্যবসা এবং স্বৈরাচার সরকারের সহযোগী হলেও হেলাল খানের সহযোগিতায় ধরাছোঁয়ার বাইরে বিতর্কিত এই অভিনেত্রী। বর্তমানে নিপুণ ঢাকায় বিএনপির এই নেতার নিরাপদ আশ্রয়ে রয়েছেন!
নিপুণকে নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার কারণ খুঁজতে গেলে জানা যায়, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন কিংবদন্তি গীতিকার-প্রযোজক ও পরিচালক প্রয়াত গাজী মাজহারুল আনোয়ার। সিনেমার নাম ‘আপসহীন’। আর এই চলচ্চিত্রে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন নিপুণ আক্তার।
সিনেমাটিতে বাংলাদেশের অষ্টম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন হেলাল খান। তিনি সিনেমাটির প্রযোজকও। এক দশক আগে সিনেমাটির নির্মাণকাজ শুরু হলেও এরপর আর খবর পাওয়া যায়নি। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর হঠাৎ প্রকাশ্যে আসে খালেদা জিয়ার সেই বায়োপিক মুক্তির খবর। নতুন করে আলোচনায় আসেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক উপ-কমিটির সক্রিয় সদস্য নিপুণ।
এরপর জানা যায়, নিপুণকে রক্ষা করতেই সিনেমাটির মুক্তির খবর কৌশলে সামনে আনেন হেলাল খান। পতিত আওয়ামী লীগের দোসর ও সুবিধাভোগী নিপুণ আক্তারকে শেল্টার দেওয়া এবং তার সঙ্গে যোগাযোগ বা সম্পর্কের বিষয়ে চিত্রনায়ক হেলাল খানের বক্তব্য জানতে ব্যক্তিগত দুটি মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। হোয়াটঅ্যাপ নম্বরে পাঠানো খুদেবার্তারও কোনো উত্তর দেননি তিনি।
দুদক ও এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, নিপুণের বিরুদ্ধে আলাদাভাবে কোনো অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু হয়নি। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ভাই শেখ সেলিমের দুর্নীতি ও অপকর্মের বিরুদ্ধে চলমান অনুসন্ধানে নিপুণ আক্তারের নাম উঠে এসেছে। বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চাঁদা আদায় এবং মন্ত্রণালয়গুলোতে টেন্টারবাজি, কমিশন বাণিজ্য ও তদবির সিন্ডিকেটে যুক্ত ছিলেন।
এছাড়া গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসানের গুম, খুন ও নির্যাতনে সহায়তা করতেন। জিয়াউল আহসানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে নানান অনৈতিক কর্মকাণ্ড করতেন।
সম্প্রতি জিয়াউল আহসান রিমান্ডে থাকাবস্থায় ডিএমপির নিউমার্কেট থানায় গোপনে দেখা করেন ছোট পর্দার অভিনেত্রী উর্মিলা শ্রাবন্তী কর। উর্মিলার মাধ্যমে নিপুণসহ সহযোগীদের কাছে গোপন নির্দেশনা প্রদান করেন জিয়া। এর পরই নিপুণ দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
নায়ক ফেরদৌস আহমেদ এমপি হওয়ার পর আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন নিপুণ। সরকারের পতন না হলে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলিয়াস কাঞ্চন, রিয়াজ আহমেদ ও সাইমন সাদিককে এমপি বানানোর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। যদিও নিজেই সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন ফরম কিনে দৌড়ঝাঁপ করে ব্যর্থ এই বিতর্কিত নায়িকা।
এদিকে, জালিয়াতির অভিযোগে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার হয়েছেন নিপুণ আক্তার। অনৈতিকভাবে সমিতির প্যাড ব্যবহার করে ছাত্র-জনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে মনগড়া বিবৃতি প্রদান করার অভিযোগে গত ১৯ জানুয়ারি কার্যনির্বাহী পরিষদের মিটিংয়ে সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।