রাজধানীর বনশ্রী এলাকার ডি-ব্লকে নিজ বাসার সামনেই ছিনতাইকারীদের আক্রমণে গুলিবিদ্ধ হন স্বর্ণ ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আনোয়ারুল ইসলাম। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতের এ ঘটনায় আনোয়ার প্রাণপনে চেষ্টা করছিলেন দীর্ঘদিন ভাড়ায় বসবাস করা নিজের বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকতে। আনোয়ারকে বাঁচাতে এসে ভবনের প্রধান ফটকের ওপারে থেকেই স্বামীর ওপর সন্ত্রাসী হামলা দেখেন সহধর্মিণী পান্না আক্তার; বাবার ওপর নির্মম হামলা হতে দেখেন মেয়ে ফারজানা আক্তার।
আহাজারি করা ছাড়া আনোয়ারের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না পান্না বা ফারজানার কাছে। কারণ তাদের মাঝে ‘চীনের প্রাচীরের’ মতো দাঁড়িয়ে ছিল ভবনের মূল ফটক। ফটকটি তালা দিয়ে আটকে চাবি নিজেদের কাছে রেখেছেন আনোয়ারের বাড়ির মালিক।
এভাবেই রাজধানী ঢাকার হাজার হাজার ভাড়াটিয়ারা জিম্মি থাকেন তাদের ফ্ল্যাট বা বাড়ির মালিকদের কাছে। নিজেদের কষ্টার্জিত টাকায় ভাড়া পরিশোধ করেও যেন তারা রয়েছেন এক জেলখানায়। এই জেলখানার বন্দিদের নেই চলাচলের স্বাধীনতা, নাগরিক সুবিধা পাওয়ার অধিকার কিংবা গোপনীয়তা। বাড়ির মালিকদের কাছে ভাড়াটিয়ারা এতটাই জিম্মি যে, গণমাধ্যমে পরিচয় প্রকাশ করে নিজেদের অভিজ্ঞতা জানাতে চান না অনেকেই। কারণ মালিক জানলেই ছেড়ে দিতে হয় বাসা। উপরন্তু, নগদ অর্থে নেওয়া ভাড়া, কর ফাঁকি দেওয়া আয়ের অন্যতম উৎস মালিকদের কাছে।

রাজধানীর মিরপুর-১ এলাকার বাসিন্দা নাজমুন নাহার লাকী কাজ করেন দেশের একটি মূলধারার গণমাধ্যমে। মাসে অন্তত এক দিন বেশ আতঙ্কেই কাটে তার। লেট নাইট শিফট শেষে নিরাপদে বাড়ি ফেরার চেয়ে লাকীকে দুশ্চিন্তা করতে হয় ভবনের মূল ফটক খোলার বিষয়ে। পেশাগত দায়িত্বের এমন রাতগুলোতে লাকীকে হয় বাড়ির মালিক, নয়তো কেয়ারটেকারের (গার্ড) দয়ায় আস্থা রাখতে হয়। নিজের সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরে লাকী বলেন, ‘সকাল ৬টার আগে আর রাত ১১টার পরে গেট বন্ধ। মেইন গেট তালা দিয়ে চাবি বাড়িওয়ালা নিয়ে যায়। এই বাড়িতে ভাড়া দিয়ে থাকি। সেই ভাড়ার টাকা যে চাকরিতে আয় করি, সেই চাকরিও শান্তিতে করতে পারি না। আগে থেকে অনুরোধ করলে, চাবি সিকিউরিটি গার্ডের কাছে থাকে। রাতে যখন বাসায় ফিরি তখন এই গার্ডের শারীরিক ভাষায় মনে হবে সে নিজেই বাড়ির মালিক। সাংবাদিক বলে মাসে এক আধবার এই সুযোগ আমি পাই। অন্য ভাড়াটিয়ারা সেটাও পান না।’ গেট বন্ধের পাশাপাশি বহুতল ভবনে থাকা ভাড়াটিয়ারা ‘সার্ভিস চার্জ’ দিয়েও অনেক সময় পান না লিফট সুবিধা।
রাজধানীর পল্লবী এলাকার বি-ব্লকের একটি ভবনের ৭ তলায় ভাড়া থাকেন সাদ রহমান। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সাদ বলেন, ‘২ রুমের ফ্ল্যাট ২২ হাজার টাকা ভাড়া দেই, গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল আলাদা। পানির বিলসহ কেয়ারটেকার, লিফট ও জেনারেটর এসব মিলিয়ে সার্ভিস চার্জ হিসেবে দেই আরও ৬ হাজার টাকা। তারপরও ১১টায় বাসায় ফিরলে দেখি গেট বন্ধ। গেট খুললেও লিফট চালু করে না, অথচ এই লিফট বাবদ টাকা দেই। বিল্ডিংয়ের ফ্ল্যাট মালিকরা মিলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, রাত ১১টার পর ভাড়াটিয়াদের জন্য লিফট ছাড়া হবে না। অথচ ফ্ল্যাট মালিকরা আসলে লিফট চালু করা হয়।’
বাড়ির মালিকের আতঙ্কে পরিচয় গোপন রাখার শর্তে মোহাম্মদপুরের বসিলা এলাকার এক ভাড়াটিয়া রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘২০২১ সালে সবেমাত্র এই বাসায় উঠেছি। ২ মাস পর ব্যবসার কাজে ঢাকার বাইরে যাই। একদিন চট্টগ্রাম থেকে রাত ২টায় আসাদ গেটে নামি। বাসায় এসে প্রায় ৪০ মিনিট দরজা ধাক্কালেও দাড়োয়ান দরজা খোলেনি। ফোনে কল দিলেও ধরেনি। আমি একাই থাকি বাসায়, ১০ তলায়। সেদিন ক্লান্ত শরীরে বেশকিছু দূরে আমার ব্যবিসায়িক গোডাউনে কোনোরকম রাত কাটাই। পরে ফজরের পর দরজা খুললে বাসায় আসতে পারি। এ ছাড়া ১২টার পর আসলে কোনোরকমে কাকুতি মিনতি করে দরজা খুললেও লিফট চালু করে না। হেঁটে ১০ তলায় উঠতে হয়। গত মাসের ২৮ তারিখে দাড়োয়ান বলেছে যে, আর ১২টার পর গেটও খুলবে না, বাইরে থাকতে হবে। এটাই আমাদের ভাড়াটিয়ার নিয়তি। বাড়ির গেট ও লিফট বন্ধের বিষয়টি ভাড়াটিয়ার জন্য এক আতঙ্কের, যেখানে টাকা দিয়েও স্বাধীনতা ভোগ করা সম্ভব না। সাক্ষাৎকার নেওয়া ভাড়াটিয়াদের কাছে প্রশ্ন ছিল যে, এমন মালিকদের বাড়িতে ভাড়া থাকেন কেন তারা। জবাবে প্রায় একই সুরে তারা জানান যে, অধিকাংশ বাড়ির মালিকই এমন। কাজেই বাসা বদল সমাধান না। উপরন্তু, বাসা বদলে গুণতে হয় বাড়তি খরচ।
নওরিন আক্তার নামে মালিবাগ এলাকার গৃহিণী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আগে বাড়ির মালিকদের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতাম। কিছু বললেই তারা বাসা ছেড়ে দিতে বলে। এভাবে অনেকবার বাসা পাল্টিয়েছি। প্রতিবার বাসা বদলে ৫ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। বছরে কয়বার বাসা পাল্টাব? বাসা পালটিয়ে তো সমাধান আসছে না। কোথাও ফ্ল্যাট মালিক ভালো হলে আবার মালিক সমিতি মিলে এমন সিদ্ধান্ত নেয়। যে ভবনে ভাড়াটিয়ারা এমন ভবনে থাকে যার ফ্ল্যাট মালিক ওই ভবনে থাকে না, তাদের জন্য সমস্যা আরও কঠিন করে তোলে সমিতির লোকজন।’
এতসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকার পরেও ভাড়াটিয়াদের নেই সামাজিক গোপনীয়তা। বাসায় কে আসল, কে থাকল এসব নিয়েও অতি উৎসাহী হতে দেখা যায় অনেক মালিককে।
সোবহানবাগ এলাকার এক বাসিন্দা পরিচয় গোপনের শর্তে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘কিছুদিন আগে দুপুরে এক আত্মীয় বাসায় আসেন। রাত ১১টার দিকে ফ্ল্যাট মালিক এসে জানতে চান যে, সেই আত্মীয় চলে গেছেন নাকি আমার বাসায় আছেন। এ ছাড়াও উনি নানা অজুহাতে বিভিন্ন সময় আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়েন।
কারণ জানতে চাইলে বাড়ির মালিক বলেন, এটা তার জানা দরকার যে, বাসায় কারা থাকবে, কেন থাকবে, বাড়িতে কী হচ্ছে। অথচ আমি বিভিন্ন সময় দেশের বাইরে গেলে দেখি যে, ভাড়াটিয়াদের কি পরিমাণ গোপনীয়তা দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আলবেনিতে আমার এক আত্মীয় নতুন বাড়ি কিনেছেন। বাড়িটি বেশ সুন্দর হওয়ায় ভেতর থেকে দেখতে চাইলেও আমাকে নিয়ে বাড়ির সীমানায় প্রবেশ করেননি সেই আত্মীয়। জিজ্ঞেস করলে বলেছিল যে, বাড়িটি তার হলেও যেহেতু অন্যের কাছে ভাড়া দেওয়া তাই ওই বাড়ির সীমানায় প্রবেশ করতে হলে ভাড়াটিয়াকে আগে থেকে নোটিশ দিয়ে অনুমতি নিতে হবে। আর আমাদের এখানে ভাড়াটিয়াদের কোনো সামাজিক গোপনীয়তা নেই।’
ভাড়াটিয়াদের এসব সমস্যার সমাধানে আশ্বাস দিয়েছেন ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ।
রূপালী বাংলাদেশকে ডিএনসিসি প্রশাসক বলেন, এ বিষয়ে বাড়িওয়ালাদের সঙ্গে আলোচনা করছি। ভাড়াটিয়ারা কোনো অভিযোগ জানালে ব্যবস্থা নেব। বড় কোনো অ্যাসোসিয়েশন হলে কেউ আসলে, আমি নিজেই কথা বলব (তাদের সাথে)। অন্যথায় (একক অভিযোগকারী) ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে অভিযোগ জানাতে পারে। অন্যদিকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাড়ির মালিকরা নগদ অর্থে ভাড়ার টাকা বুঝে নেন। তাই মালিকদের ভাড়া বাবদ আয়ের হিসাব নিরূপণ করা বেশ কঠিন। ফলে আয়কর এবং হোল্ডিং ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়াও বেশ সহজ তাদের জন্য।
এ বিষয়ে সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, পুরো বিষয়টিকে আমি ‘হাউজিং জাস্টিস’ বলি। এই হাউজিং জাস্টিস শুধু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য না। ঢাকা শহরের ৭০ শতাংশ বাসিন্দা ভাড়াটিয়া। তাদের হাউজিং জাস্টিস কীভাবে করা যায়, সেটি একটা বড় বিষয়। এটা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি যে, ভবন মালিকরা ভাড়াটিয়াদের থেকে মোটা অঙ্কের আয় করলেও, কর দিচ্ছেন খুবই সামান্য। কারো হয়তো চার তলা বাড়ি আছে, সে আবাসিক ভবনের কর দেয়; কিন্তু ভাড়াটিয়াদের থেকে অনেক ভাড়া নেয়। এগুলো ডিজিটালাইজ করছি। ভাড়াটিয়া চাইলে দেখতে পারবে যে, মালিক কত টাকা ট্যাক্স দেয় এবং কম দিলে ভাড়াটিয়া চাইলে অনলাইনে অভিযোগ দিতে পারবে। হাউজিং জাস্টিস ওই পর্যায়ে নেব কারণ ঢাকা শহরকে খাঁচায় পরিণত থাকতে দেব না। এই ব্যবস্থাকে আমরা ভাঙব।
আপনার মতামত লিখুন :