কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার পিরিজপুর ইউনিয়নের নিভৃত গ্রাম গজারিয়া। এখানকার মানুষের অন্যতম পেশা কৃষি। এলাকাজুড়েই দেখা মিলবে চিরসবুজে ছেয়ে আছে চারদিক। বছরচারেক আগেও যারা ছিলেন প্রবাসী কিংবা সাধারণ পেশার মানুষ, সময়ের পরিক্রমায় এখন এদের অনেকেই বনে গেছেন লাখপতি থেকে কোটিপতি। এমনি এক অনুসন্ধানের তথ্য উঠে এসেছে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের হাতে।
কিশোরগঞ্জ ভৈরব-আঞ্চলিক মহাসড়কের কোলঘেঁষে রয়েছে পিরিজপুর ইউনিয়নের গজারিয়া গ্রাম। এই গ্রামের শতাধিক পরিবার নানা ধরনের অনলাইন জুয়া ও ক্যাসিনোতে জড়িয়ে হয়েছেন আঙুল ফুলে কলাগাছ। এমন তথ্য পেয়ে সত্যতা যাচাইয়ে গ্রামটিতে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে সেই পরিবর্তনের।
গ্রামের বৃদ্ধ থেকে জোয়ান অনেকেই এখন অনলাইন জুয়াভিত্তিক বিভিন্ন অ্যাপস এবং ক্যাসিনোতে জড়িয়ে রয়েছেন। খবর রয়েছে এদের মধ্যে অনেকেই আবার নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছেন। জুয়ার টাকা জোগাড় করতে এলাকায় বেড়েছে চুরি, ছিনতাইয়ের ঘটনা। এ ছাড়া এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বেড়ে যাওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
গ্রামটিতে প্রবেশ করতেই বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় রূপালী বাংলাদেশের। এদের মধ্যে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানিয়েছেন, এই গজারিয়া এলাকার মৃত সিন্দু মিয়ার ছেলে হেকিম মিয়া ও সোহাগ মিয়া নামের দুই সহোদরের দুই বছর আগেও একজন ছিলেন হকার ব্যবসায়ী, অন্যজন স্কুলের পিয়ন। দুই বছর পার হতেই এখন হয়েছেন কোটি টাকার মালিক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই এলাকার একজন জানালেন হেকিম মিয়া নামের আরও একজনের গল্প। পেশা পাল্টে হেকিম হয়েছেন বেশ কয়েকটি ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। সম্প্রতি কয়েক লাখ টাকা ব্যয়ে পার্শ্ববর্তী কটিয়াদী বাজারে গড়ে তুলেছেন অত্যাধুনিক মানের সেলুন।
এ ছাড়া লাখ টাকা ব্যয়ে স্থানীয় পিরিজপুর বাজারে একটি কসমেটিকস শপ এবং গজারিয়া এলাকায় গড়ে তুলেছেন বিশালাকার একটি গবাদি পশুর খামার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই ব্যক্তি জানিয়েছেন, হেকিম পেশা পাল্টে বর্তমানে বেশ কয়েকটি অনলাইনভিত্তিক জুয়ার অ্যাপসের এজেন্ট হিসেবে এলাকাটিতে কাজ করছেন।
এলাকার বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে বেরিয়ে আসে ধারাবাহিক চাঞ্চল্যকর তথ্য। একই এলাকার কাঞ্চন মিয়ার ছেলে আব্দুল হাকিম নামের একজন বছর দুয়েক আগেও ছিলেন মোবাইল মেকানিক। তবে এখন তিনিও কোটি টাকার মালিক। জুয়াভিত্তিক বিভিন্ন অ্যাপ্সের সঙ্গে জড়িয়ে বনে গেছেন এজেন্ট হিসেবে। অভিযোগ আছে, অনেকের কাছ থেকেই হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
খাশালা গজারিয়া এলাকার শাহিন মিয়া। কয়েক বছর আগেও ছিলেন জুতার ব্যবসায়ী। অনলাইন জুয়াভিত্তিক বিভিন্ন অ্যাপ্সের সুপার এজেন্ট হয়ে শাহিন মিয়া এখন ১৪-১৫ কোটি টাকার মালিক।
অনুসন্ধানের গতি বাড়তে থাকে। কথা হয় এলাকার আরও কয়েকজনের সঙ্গে। তবে কেউই নাম প্রকাশ কিংবা ক্যামেরার সামনে আসতে রাজি হননি। তবে ধারাবাহিকভাবে জানিয়েছেন জুয়ায় মত্ত হয়ে সেই এলাকার মানুষের উত্থানের গল্প। এলাকাটিতে শতাধিক পরিবার এবং অর্ধশতাধিক এজেন্ট এসব জুয়া এবং ক্যাসিনোতে জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
তবে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এই জুয়া এবং ক্যাসিনো নিয়ন্ত্রণ হয় দেশের বাইরের কয়েকটি চক্র থেকে। অভিযোগ রয়েছে, এসব সুপার এজেন্টদের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ করেন দুবাইপ্রবাসী কাইয়ুম মিয়া নামের একজন। কাইয়ুম গজারিয়া এলাকার মান্নান মিয়ার ছেলের।
বছর দুয়েক আগেও তার এই জুয়া নিয়ে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়। একজন গার্মেন্টস কর্মী হিসেবে এলাকায় থাকতেন কাইয়ুম মিয়া। বছর কয়েক আগে থেকে জড়িয়ে পড়েন এই ক্যাসিনো কারবারের সঙ্গে। বর্তমানে দেশে এবং বিদেশে নামে-বেনামে গড়েছেন কয়েকশ’ কোটি টাকার সম্পদ।
জুয়ায় বিনিয়োগ করে নিঃস্ব হওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এলাকার এক ব্যক্তি রূপালী বাংলাদেশকে জানালেন, গত বছরের ডিসেম্বরে দুটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রায় ১৭ লাখ টাকা খুইয়েছেন।
স্থানীয় কয়েকজন জনপ্রতিনিধি জানিয়েছেন, এসব ক্যাসিনোকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও। এমনকি প্রশাসনের নাকের ডগায়ও চলে এসব অনলাইন জুয়ার রমরমা বাণিজ্য।
এ প্রসঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয় বাজিতপুর থানার ওসি মুরাদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ পাননি তিনি। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি।