নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি গঠনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আর কার্যকর থাকবে, না বিলুপ্ত হবে- এ নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। শুক্রবার নবগঠিত দলটির আহ্বায়ক ও আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম জানিয়েছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে একটি রাজনৈতিক দল তৈরি হয়েছে।
ফলে বৈষম্যবিরোধী বা সমন্বয়ক পরিচয় এখন আর কার্যকর নেই। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেছেন, প্ল্যাটফর্মটি বিলুপ্ত করার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেশ কয়েকজন সংগঠনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্ল্যাটফর্মটির ব্যানারে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হলে তাতে যোগ দেন বিভিন্ন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের কর্মী, বিভিন্ন মত ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এসব শিক্ষার্থীর বড় একটি অংশের নেই কোনো রাজনৈতিক পরিচয়।
আবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অনেকেই যোগ দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টিতে। ফলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। নতুন দলে যারা যোগ দিয়েছেন তাদের অনেকেই এই প্ল্যাটফর্মটি রাখার পক্ষে না থাকলেও যারা দলটিতে যোগ দেননি তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন টিকিয়ে রাখার পক্ষে মত দিচ্ছেন।
সরকারে চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ নেয় জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে। এই গণঅভ্যুত্থানেই তোপের মুখে পদত্যাগ করে দেশে ছেড়ে চলে যান শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত এই আন্দোলনে ছাত্র-জনতা সংগঠিত হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে।
অভ্যুত্থানের আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর যেসব দাবি সামনে রেখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, সেগুলো পূরণ হওয়ায় সংগঠনটির আর কোনো প্রয়োজন নেই বলে বলে জানিয়েছেন সংগঠনের অনেকেই। তাদের মধ্যে ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেক সমন্বয়ক প্ল্যাটফর্মটি থেকে পদত্যাগও করেছিলেন।
এ ছাড়াও অনেকে এই প্ল্যাটফর্মটিতে রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত করার কথাও বলেছিলেন। তবে ওই সময় সংগঠনের অনেকেই বলেছিলেন, এই প্ল্যাটফর্মটি কোনো রাজনৈতিক দলে রূপান্তর করা হবে না। এ ছাড়াও আন্দোলন চলাকালে যাদের হত্যা করা হয়েছে, তাদের ক্ষতিপূরণ ও হত্যার বিচারের দাবি, আহতদের সুচিকিৎসার বিষয়টি দেখভাল এবং শিক্ষার্থীদের নানা দাবি আদায়ে সংগঠনটি কাজ করে যাবে।
আন্দোলন চলাকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছিল না কোনো সুপরিকল্পিত সাংগঠনিক রূপ। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এসে প্ল্যাটফর্মটি অনেক সমন্বয়ক নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। পরে সারা দেশের সমন্বয়ক কমিটি বিলুপ্ত করে নতুনভাবে সংগঠনটির কাঠামো তৈরি করা হয়।
কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পাশাপাশি সারা দেশের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন করে দেওয়া হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটি।
অন্যদিকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সংহতি ও প্রতিরোধের চেতনায় বাংলাদেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর করা হয় জাতীয় নাগরিক কমিটি। এই কমিটির নেতৃত্বেও ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। এরপর নাগরিক কমিটিও সারা দেশের জেলা পর্যায়ে তাদের কমিটি দেয়। একইসঙ্গে তারা তৈরি করে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত।
সময়ের পালাবদলে বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করতে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করল নতুন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। নতুন দলের আহ্বায়ক হয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্য সচিব করা হয়েছে আখতার হোসেনকে।
এই দলটির সবাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংক্রিয় ছিলেন। এ ছাড়াও কমিটির অধিকাংশ ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠন। নতুন দল গঠন হওয়ার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ, সদস্য সচিব আরিফ সোহেল, মুখপাত্র উমামা ফাতিমা ও মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদসহ ১৮ সদেস্যের নির্বাহী কমিটির মধ্যে উমামা ফাতিমা ছাড়া প্রত্যেকেই যোগ দিয়েছে নতুন রাজনৈতিক দলে।
এ ছাড়াও গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়কদের উদ্যোগে নতুন ছাত্রসংগঠনের ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’র আত্মপ্রকাশ হয়। ‘স্টুডেন্ট ফার্স্ট, বাংলাদেশ ফার্স্ট’- এই স্লোগানকে সামনে রেখে সংগঠনটি আত্মপ্রকাশের সময় সংগঠনটির নেতারা বলেছেন, ছাত্র-নাগরিকের স্বার্থ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করবে তারা। নতুন ছাত্রসংগঠন কারো লেজুড়বৃত্তি করবে না। কোনো ‘মাদার পার্টির’ এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে না। নতুন সংগঠনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে।
এদিকে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পর নতুন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বহাল থাকবে বলেও জানিয়েছেন অনেকে। অন্যদিকে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নাগরিক কমিটির (জানাক) ১১তম সাধারণ সভায় জানাকের কমিটি বিলুপ্তসহ ভবিষ্যৎ নিয়ে একাধিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
জানাকের তৎকালীন মুখপাত্র সামান্থা শারমিন এক বিজ্ঞপ্তিতে জানাকের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গৃহীত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানান। তিনি বলেন, আহ্বায়ক, সদস্য সচিব, মুখপাত্র, মুখ্য সংগঠক ব্যতীত জাতীয় নাগরিক কমিটির অবশিষ্ট অর্গানোগ্রাম, নির্বাহী কমিটি, সেলসমূহ ও সার্চ কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
রাজনৈতিক দলে যোগদানকারী সব কেন্দ্রীয় সদস্যের সদস্যপদ বাতিল হিসেবে গণ্য হবে। দলে যোগ দিচ্ছেন না- এমন সদস্যদের পদ বহাল থাকবে।’ বিজ্ঞপ্তিতে তিনি জানান, আহ্বায়ক, সদস্য সচিব, মুখপাত্র, মুখ্য সংগঠক ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে পরবর্তী ১৫ দিন অনানুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন। তাদের উদ্যোগে জাতীয় নাগরিক কমিটির তিনজন আনুষ্ঠানিক ফোরাম পরবর্তী অর্গানোগ্রাম নির্ধারণ করবেন।
আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে গত শুক্রবার জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে একটি রাজনৈতিক দল তৈরি হয়েছে বলে বৈষম্যবিরোধী বা সমন্বয়ক বলে যে পরিচয়টা এখন আর এক্সিস্ট করে না সেই অর্থে।
ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অনুরোধ থাকবে যদি কেউ বৈষম্যবিরোধী বা সমন্বয়ক পরিচয় ব্যবহার করে অপকর্ম করে তাহলে তারা তাদের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।
তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিলুপ্তির কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। তিনি নতুন দলটিতেও যোগ দেননি। উমামা ফাতেমা বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্মটি বিলুপ্ত করার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অংশীদার ছাত্রদের সবাই নতুন রাজনৈতিক দল বা নতুন ছাত্র সংগঠনে যুক্ত হয়নি। অংশীদারদের আলোচনা ছাড়া প্ল্যাটফর্ম বিলুপ্ত হবে না। তাই বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ রইল।
একই কথা বলছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন সেল সদস্য রাকিবুল হাসান রাজ। তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আমাদের অস্তিত্বের নাম।
২৪ এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছি এর অন্যতম কারিগর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাই এটি বিলুপ্ত হওয়ার প্রশ্নই আসে না। তিনি বলেন, আন্দোলনে শহিদ পরিবার, আহত যোদ্ধা ও দেশপ্রেমিক জনতার সমন্বয়ে নতুন করে নতুন নেতৃত্বে সুসংগঠিত হবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
আপনার মতামত লিখুন :