আগামী চা মৌসুমের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ৩০ কোটি টাকা জোগান দেওয়া না হলে মৌসুমের চা উৎপাদন ব্যাহত হবে। একই সঙ্গে কোম্পানির পরিচালনার জন্য কৃষিব্যাংক থেকে বাৎসরিক ১২০ কোটি টাকা শস্য বন্ধকী ঋণ চেয়েছে ন্যাশনাল টি। মূলত কোম্পানির ঋণসীমা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ন্যাশনাল টি কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান মামুন রশীদ স্বাক্ষরিত এক চিঠির সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। চিঠির অনুলিপি অর্থ মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও দপ্তরগুলোতে পাঠানো হয়েছে। যার অনুলিপি রূপালী বাংলাদেশের হাতেও এসেছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, কোম্পানির সার্বিক উন্নয়নে ইতিমধ্যে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। তবে শ্রমিকদের ৫ সপ্তাহের বকেয়া মজুরি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৪ মাসের বেতন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ৬ মাসের বকেয়া বিল, শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ তহবিলের ২ বৎসরের অর্থ।
এ ছাড়া মৌসুমভিত্তিক চা বাগানগুলোর কার্যক্রম শুরু করা জরুরি। মূলত আবহাওয়ার ওপর চা মৌসুম নির্ভরশীল। যে কারণে এ মুহূর্তে চা বাগানগুলোকে আগামী মৌসুমের জন্য প্রস্তুত করার জন্য ক্রনিং, ড্রেনেজ সিস্টেম, কারখানার মেশিনারিজ ওভারহোলিংসহ অন্যান্য কাজ জরুরি ভিত্তিতে করা প্রয়োজন। তাই কোম্পানির শ্বাস-প্রশ্বাসের স্থান হিসেবে এই মুহূর্তে বকেয়া পরিশোধের জন্য ৩০ কোটি টাকা জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন। নয়তো আগামী মৌসুমে চা উৎপাদন ব্যাহত হবে।
জানা গেছে, পাওনা বকেয়া হওয়ায় দেশের এই শীর্ষস্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য সুপারিশ প্রণয়ন ও শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধ সম্পর্কিত বিষয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সভাপতিত্বে ২০২৪ সালের ২৮ নভেম্বর একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় বলা হয়, তাৎক্ষণিক শ্রমিক অসন্তোষ নিরসণে ঋণ হিসেবে পাওয়া ৭.৫০ কোটি টাকা পর্যাপ্ত নয়। তাই অতিপ্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য ৩২.৮৮ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়। এবং সম্ভাব্য ব্যয় ৪৬.৩৮ কোটি টাকা চেয়ে কৃষি ব্যাংককে পত্র দেওয়া হয়।
ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ আগামী এপ্রিল মাসের মধ্যে পরিশোধ করারও পরিকল্পনা নিয়েছে টি কোম্পানি। চলতি মার্চ-এপ্রিল মৌসুমে গুণগত মানসম্পন্ন উন্নত চা-পাতা উৎপাদনের মোক্ষম সময়। উন্নত ও গুণগত মানসম্পন্ন উৎপাদিত চা-পাতা অধিক মূল্যে বিক্রি করা। আর নগদ টাকার জোগান বাড়াতে স্থানীয় মার্কেটে ৫০ শতাংশ বিক্রি করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। যা বর্তমানে কোম্পানির উৎপাদনের ২৫ শতাংশ বিক্রি করা হয়।
সূত্র জানায়, কোম্পানির অবিক্রীত ২২ লাখ কেজি চা দ্রুত অকশনে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যার মধ্যে বর্তমানে চট্টগ্রামে অকশনে নিলামে বিক্রির অপেক্ষায় ১৬ লাখ কেজি চা মজুদ রয়েছে।
জানা গেছে, কোম্পানির কার্যক্রম বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক থেকে শস্য বন্ধকী ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ২০২৪ সালের উৎপাদন মৌসুমের মূলধন সংকুলানের জন্য বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক থেকে ১৫০ কোটি টাকার চা উৎপাদন ঋণপ্রাপ্তির আবেদন করা হয়। কিন্তু চা উৎপাদন ঋণ বাবদ ৮৬ কোটি টাকার অনুমোদন দেওয়া হয়।
কিন্তু এই ঋণের অর্থে খরচ সংকুলান না হওয়ার কারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পুনরায় বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের কাছে ৪৪ কোটি টাকা চাওয়া হয়। কিন্তু কৃষি ব্যাংক থেকে দুর্গাপূজার বোনাস বাবদ ৭.৫০ কোটি টাকা ঋণ পাওয়া যায়। এই ঋণ চলতি মূলধন ও অন্যান্য ব্যয় সংকুলানে ব্যবহার করার ফলে ২০২৪ সালে শেষ সময়ে কোম্পানি চলতি মূলধন ঘাটতির সম্মুখীন হয়। ফলে কোম্পানির অধীনস্থ ১২টি চা বাগানের ১২ হাজার শ্রমিকের সাত সপ্তাহর মজুরি বন্ধ ছিল।
ন্যাশনাল টি কোম্পানি চা উৎপাদনে জাতীয় পর্যায়ে প্রায় ৭ শতাংশ অবদান রাখছে এবং কোম্পানিতে অসংখ্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে। এ ছাড়া প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ১২ হাজার শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তার কর্মসংস্থান জড়িয়ে রয়েছে। ন্যাশনাল টি কোম্পানি লিমিটেড সরকার ও জনগণের যৌথ মালিকানাধীন চা খাতের একমাত্র শেয়ারবাজারে নিবন্ধিত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি। যার অধিকাংশ শেয়ারের মালিক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা।
সূত্র জানায়, কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা অর্থসচিব, কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে ঋণপ্রাপ্তির বিষয়ে আলোচনা করেন। ওই আলোচনায় বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক অবহিত করে যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী এসবিইএল (একক ঋণগ্রহীতার এক্সপোজার সীমা) অতিক্রম করায় এই মুহূর্তে কৃষি ব্যাংক থেকে পুনরায় ঋণ দেওয়া সম্ভব নয়।
তাই সিদ্ধান্ত হয়, কৃষি ব্যাংক একক ঋণগ্রহীতার এক্সপোজার সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ বিভাগে পাঠাবে। এ ছাড়া ন্যাশনাল টি কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার বাড়ানোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কোম্পানির অবিক্রীত ২২ লাখ কেজি চা দ্রুত অকশনে বিক্রয় করে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে হবে। এ ছাড়া মার্চ-এপ্রিল নতুন চা মৌসুমে আরও গুণগত মানসম্পন্ন চা বিক্রির মাধ্যমে কৃষি ব্যাংক থেকে পাওয়া শস্য বন্ধকী ঋণ পরিশোধের প্রচেষ্টা চলমান থাকবে।
উল্লেখ্য, ৫ আগস্ট দেশের পট পরিবর্তনের পর তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের ৬ জন পরিচালকের পদত্যাগ পরবর্তী সময়ে ন্যাশনাল টি কোম্পানি লিমিটেডের পূর্ণাঙ্গ পর্যদ ইতিমধ্যে গঠিত হয়েছে। ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের যাত্রা শুরু হওয়ার পর এই রুগ্ন প্রতিষ্ঠানকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য কোম্পানির পরিচালনা পর্যদ ৬৮৩তম সভায় কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে মামুন রশীদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
পর্ষদে অন্য পরিচালকদের মধ্যে রয়েছেন সৈয়দ আহসান হাবীব, যিনি ওয়ার্ল্ড ব্যাংকসহ বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে আইটি খাতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। রয়েছেন দুজন ব্যবসায়ী ও লাভজনক চা বাগানের কর্ণধার যথাক্রমে উত্তরবাগ চা বাগানের কর্ণধার মো. সারোয়ার কামাল এবং শ্রীগোবিন্দপুর চা বাগানের কর্ণধার মো. মহসিন মিয়া ও ব্যবসায়ী মোহাম্মদ বিন কাশেম,পরিচালক হিসেবে অছেন মো. শাকিল রিজভী, যিনি বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে একজন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব।
এ ছাড়া পর্ষদে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মনোনীত পরিচালক হিসেবে রয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আবদুর রহিম খান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মেহেদী মাসুদুজ্জামান, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবুল হোসেন এবং সাধারণ বীমা করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হারুন-অর-রশীদ।
সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এইচ এস এম জিয়াউল আহসান এবং কোম্পানি সচিব এ কে আজাদ চৌধুরীকে পুনরায় একই পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।