ঢাকা সোমবার, ১০ মার্চ, ২০২৫

শিক্ষার্থী ঝরে পড়া ঠেকাতে কৌশলপত্র

উৎপল দাশগুপ্ত
প্রকাশিত: মার্চ ১০, ২০২৫, ০৯:১৯ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া ঠেকাতে শিখন ঘাটতি নিরূপণ করে তা পূরণ করার লক্ষ্যে ‘কৌশলপত্র’ প্রণয়ন করা হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের ‘লার্নিং এক্সিলারেশন ইন সেকেন্ডারি এডুকেশন (লেইস)’ প্রজেক্ট এটি প্রণয়ন করেছে। স্কুলগুলোতে এটি বাস্তবায়নের জন্য এরই মধ্যে দেশের ৯টি শিক্ষা অঞ্চল এবং জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছে মাউশি। কৌশলপত্রে পাওয়া তথ্য ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, কোনো বিষয়ে প্রত্যাশিত শিখন ও অর্জিত শিখনের পার্থক্যই হলো শিখন ঘাটতি। বিভিন্ন কারণে এই শিখন ঘাটতি তৈরি হয়। ঘাটতিসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা পরবর্তী শ্রেণিতেও শ্রেণি কার্যক্রমের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে এসব শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।

বিভিন্ন জরিপের তথ্য থেকে জানা গেছে, মাধ্যমিক স্তরে বিগত দুই বছরে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে, যা মোট শিক্ষার্থীর ২৪ শতাংশ। তবে দেড় দশক আগেও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার ছিল প্রায় ৫৫ শতাংশ। বর্তমান সময়ে ঝরে পড়ার হার কমলেও তা যথেষ্ট নয় বলে মত সংশ্লিষ্টদের।

কোভিড-১৯ অতিমারিকালীন শিখন ঘাটতি নিরূপণের জন্য ২০২২ সালে মাউশির নির্দেশনায় বাংলাদেশ এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট ইউনিট, বাইস একটি গবেষণা পরিচালনা করে। শিক্ষার্থীর শিখন ঘাটতি চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে গবেষণায় অষ্টম শ্রেণির (২০২১ শিক্ষাবর্ষে নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত) বাংলা, ইংরেজি ও অঙ্ক বিষয়কে নির্বাচন করা হয়। 

গবেষণায় দেখা গেছে, ওই সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইংরেজি ও গণিতে যথাক্রমে ৭৬ শতাংশ ও ৬৯ শতাংশ শিখন ঘাটতি ছিল। এছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও শিখনে ব্যাপক পার্থক্য এবং ডিজিটাল ডিভাইস ও ইন্টারনেট সুবিধায় বৈষম্য ছিল, যা ঘাটতির মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই চিত্র সামনে রেখে উল্লেখিত কৌশলপত্রে ঘাটতি পূরণের কৌশল বিষয়ে সুপারিশ করা হয়।

গবেষণায় ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করা প্রশ্নপত্র ও প্রশ্নমালা পরিমার্জনের জন্য ৩০টি প্রতিষ্ঠানে পাইলট প্রোগ্রাম পরিচালনা করা হয়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান থেকে নমুনায়নের ভিত্তিতে ২০ জন করে প্রায় ৬০০ শিক্ষার্থী ও ১২৮ জন বিষয়ভিত্তিক শিক্ষককে পাইলটিং কার্যক্রমের আওতায় নেওয়া হয়।

ওই গবেষণায় দেশের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতির মাত্রায় উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখা গেছে। শ্রেণি ও গড় স্কেল স্কোর বিবেচনায় সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে তিনটি বিষয়ের ক্ষেত্রেই উচ্চমাত্রায় শিখন ঘাটতি দেখা গেছে। অন্যদিকে খুলনা ও রংপুর বিভাগের ঘাটতির মাত্রা সবচেয়ে কম এবং তা জাতীয় পর্যায়ের শিখন ঘাটতির চেয়েও কম ছিল।

বিভিন্ন জেলার ক্ষেত্রেও শিখন ঘাটতির মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে দেখা গেছে। তিনটি বিষয়ের ক্ষেত্রেই রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত উচ্চ শিখন ঘাটতিসম্পন্ন শিক্ষার্থী চিহ্নিত হয়েছে। দৃশ্যত এ দুটি জেলার প্রায় সব শিক্ষার্থীকেই নিরাময়ের আওতায় আনা প্রয়োজন। কুমিল্লা জেলায়ও শিখন ঘাটতি দেখা গেছে।

জাতীয় পর্যায়ে বাংলা বিষয়ে উচ্চমাত্রায় শিখন ঘাটতি ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর। মধ্যম ও স্বল্পমাত্রার ঘটতি রয়েছে যথাক্রমে ৩১ ও ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর। ইংরেজিতে উচ্চমাত্রার ঘাটতি রয়েছে ১৮ শতাংশ, মধ্যম ও স্বল্পমাত্রার ঘাটতি রয়েছে ৩৮ ও ২০ শতাংশ। অঙ্কে উচ্চমাত্রার ঘাটতি ৩৯ শতাংশ, মধ্যম ও স্বল্পমাত্রার ঘাটতি ১৬ ও ১৪ শতাংশ। সার্বিকভাবে বাংলা বিষয়ে ৫৫ শতাংশ, ইংরেজিতে ৫৬ শতাংশ ও গণিতে ৫৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর ঘাটতি পূরণে ব্যবস্থা নিতে হবে।

শিখন ঘাটতির ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ের মধ্যে পার্থক্য দেখা না গেলেও গ্রাম ও শহরের মধ্যে দেখা গেছে। ওই তিন বিষয়ে উচ্চমাত্রার ঘাটতি গ্রামে সর্বোচ্চ ৪৩ ও শহরে সর্বোচ্চ ৩৬ শতাংশ। সমতল অঞ্চলের চেয়ে পাহাড়, উপকূল, চর ও হাওড় অঞ্চলে অধিক মাত্রায় শিখন ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। পাহাড়ি অঞ্চলে শিখন ঘাটতির মাত্রা সবচেয়ে বেশি। বিষয়ভেদে সমতল অঞ্চলে উচ্চমাত্রার শিখন ঘাটতিসম্পন্ন শিক্ষার্থীর হার ২৮ থেকে ৩৭ শতাংশ, উপকূল, চর ও হাওড় অঞ্চলে উচ্চমাত্রার শিখন ঘাটতিসম্পন্ন শিক্ষার্থীর হার ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ। পাহাড়ি অঞ্চলে শিখন ঘাটতির হার সর্বোচ্চ ৭৩ শতাংশ।

নিরাময়মূলক সহায়তা প্রদানের কৌশল : ঘাটতি পূরণে পূর্বালোচনা, পৃথক ক্লাস, দূরশিক্ষণ/অনলাইন কার্যক্রম গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে কৌশলপত্রে। পূর্বালোচনার ক্ষেত্রে নিয়মিত ক্লাসের সময় বৃদ্ধির ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে। পৃথক ক্লাস নেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকেরা আগ্রহী নন, তাই খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থার সুপারিশ রয়েছে কৌশলপত্রে। এছাড়া স্কুলের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অনলাইন ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট প্রদান, কেন্দ্রীয়ভাবে টেলিভিশনে সম্প্রচার এবং কিশোর বাতায়নে অনলাইন ক্লাস সম্প্রচারেরও ব্যবস্থা করার সুপারিশ রয়েছে কৌশলপত্রে।

এছাড়া যেসব জেলায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী উচ্চ শিখন ঘাটতিতে রয়েছে, যেমনÑ রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও কুমিল্লাÑ সেখানে প্রত্যক্ষ শ্রেণি কার্যক্রমের চেয়ে অনলাইন ক্লাস বা অন্যান্য ব্যবস্থার ওপর অধিক জোর দিতে হবে। কারণ এসব জেলায় নিরাময়ের জন্য প্রচুর স্কুল আওয়ার (ঘন্টা) প্রয়োজন হবে, যা প্রত্যক্ষ শ্রেণি কার্যক্রমের মাধ্যমে সম্ভব নয়। এছাড়া এসব জেলায় দ্রুত খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ করে নিবিড় পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে বিষয়টি পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট (বেডু) এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে কৌশলপত্রে।

বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে ৫০ শতাংশের অধিক শিক্ষার্থীর মধ্যম ও উচ্চমাত্রার শিখন ঘাটতি থাকায় এটি কেন্দ্রীয়ভাবে নিরাময়ের ব্যবস্থা নিতে হবে। শিখন ঘাটতি সংশ্লিষ্ট শিখন ফলগুলোর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয়ভাবে দূরশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনায় উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। ক্লাস সম্প্রচারের পাশাপাশি একটি ইউটিউব চ্যানেল খুলে সেখানে ক্লাসগুলো আপলোড করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ক্লাসের চেয়ে ঘাটতিসম্পন্ন শিক্ষার্থীর হার বিবেচনা অধিক যৌক্তিক হবে। ক্লাস ডিজাইনের দায়িত্ব যৌথভাবে বেডু ও এনসিটিবিকে দেওয়া যেতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সামর্থ্য অনুযায়ী নিরাময়মূলক কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে।

বিষয়ভিত্তিক যেসব শিখনফলের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ বা অধিক ঘাটতিসম্পন্ন শিক্ষার্থী চিহ্নিত হয়েছে, সে সব ক্ষেত্রে স্ব স্ব জেলার প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে নিরাময়মূলক ক্লাস পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে। জেলা পর্যায়ে ক্লাসের ধরন (প্রত্যক্ষ/অনলাইন) নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনতা দিতে হবে। যেসব শিখনফলের ক্ষেত্রে ৫০ থেকে ৫৯ শতাংশ ঘাটতিসম্পন্ন শিক্ষার্থী চিহ্নিত হয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে নিরাময়মূলক কার্যক্রম হিসেবে নবম-দশম শ্রেণির ক্লাসের শুরুতে অষ্টম শ্রেণিতে ছিল এমন প্রাসঙ্গিক বিষয়ে পূর্বালোচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে ক্লাসের সময় বাড়াতে হবে।

এছাড়া নবম শেণিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অষ্টম শ্রেণির প্রাসঙ্গিক বিষয়ের ওপর টপিক-ভিত্তিক ক্লাস টেস্ট গ্রহণ করা যেতে পারে। জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের জন্য জেলা পর্যায়ের নিরাময়মূলক কার্যক্রম জেলা শিক্ষা অফিসের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন করার নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে।

সুপারিশে বলা হয়েছে, শিখন ঘাটতি মোকাবিলায় গুগল ক্লাসরুম প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নিরাময়মূলক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি ব্লেন্ডেড লার্নিং প্রোগ্রামেও শিক্ষকেরা অবদান রাখতে পারবেন। অনলাইন শ্রেণি কার্যক্রমে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে শহর-গ্রামের সব শিক্ষার্থীর ডিভাইস প্রাপ্তি ও ইন্টারনেট কানেকটিভিটির বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি।

কৌশলপত্র প্রণয়নকারী লেইস প্রজেক্টের প্রকল্প পরিচালক প্রফেসর শিপন কুমার দাস এ বিষয়ে রূপালী বাংলাদেশকে জানান, বর্তমানে শিখন ঘাটতি কিছুটা কমলেও কোভিড-১৯ অতিমারিকালীন গবেষণার ওপর ভিত্তি করেই ঘাটতি মেটাতে এই কৌশলপত্র প্রস্তুত করা হয়েছে।

তিনি বলেন, মাউশির মাধ্যমে ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা কর্মকর্তাদের কৌশলপত্রটি বাস্তবায়নের জন্য পাঠানো হয়েছে। এখন স্কুল বন্ধ, তাই ঈদের পর এটি বাস্তবায়নে প্রোগ্রাম চালু করা হবে। এটি বাস্তবায়নের জন্য প্রথম কাজ হবে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা কর্মকর্তা ও প্রধান শিক্ষকদের এক জায়গায় নিয়ে এসে বিষয়টির সবিস্তার জানানো। এছাড়া এটি বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হবে।

মাঠ পর্যায়ে এটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে কি না, তা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, সে প্রশ্নে প্রকল্প পরিচালক বলেন, মাউশির মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে বিষয়টি নিয়মিত পর্যালোচনা করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করতে পারলে মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে বলে আশাবাদী তিনি।