প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। এখানে রয়েছে অসংখ্য পাহাড়, নদী, বিল, হাওর, বন, ধর্মীয় স্থান ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত, ম্যানগ্রোভসহ আছে ঋতুবৈচিত্র্য, যা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। তবে সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার পর্যটন এলাকাসহ সারা দেশের পথে-ঘাটে, এমনকি নিজের বাড়িতে যেভাবে নারীরা ধর্ষণ, নির্যাতন, বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন, তাতে ভ্রমণপ্রেমী মানুষ- যারা নিজ পরিবার, স্বজন, বন্ধু-বান্ধব পর্যটন এলাকায় ভ্রমণে ভীতসন্ত্রস্ত।
নতুনভাবে দেখা যাচ্ছে তাওহিদি জোশে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা, যা এখনই না থামাতে পারলে বহির্বিশ্বেও দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কোনো ধরনের হেনস্তাকারীকে ধর্মীয় ব্যানারে, তাওহিদি ব্যানারে সমর্থন দেওয়া যে ভুল, সেটি তুলে ধরতে হবে।
এ জন্য দেশের খ্যাতিমান আলেম, ধর্মীয় নেতা, ইমামদের এগিয়ে আসতে হবে, বলছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সোহানুর রহমান শুভ্র। তিনি বলেন, বন্ধুরা মিলে ঢাকা থেকে চাঁদপুর সাহরির জন্য ভ্রমণ করতে চেয়েছিলাম। ঈদের পর কক্সবাজার যাওয়ার প্ল্যান করেছিলাম, তবে সেসব ভাবতে সাহস পাচ্ছি না বর্তমান পরিস্থিতিতে।
জুলাই অভুত্থানের সাত মাস পর এসে সারা দেশে ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসেই ২০৫ জনের বেশি নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপপরিষদে সংরক্ষিত ১৬টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করে। তবে বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ।
দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির চিত্র আরও ভয়াবহ, একই সঙ্গে পবিত্র রমজান শুরু হলেও মার্চে বেড়েছে ধর্ষণ, নির্যাতন, বুলিং এবং শ্লীলতাহানির ঘটনা। সব মিলিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার চরম অবনতি দেখছেন বিশিষ্ট জনেরা। এমন অবস্থা চলতে থাকলে দেশি এবং বিদেশি পর্যটকরা মুখ ফিরেয়ে নেবে, যাতে ধ্বংস হবে পর্যটন খাত ও তার সঙ্গে জড়িত হোটেল-মোটেলসহ সব ব্যবসা।
মাগুরায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া আট বছরের শিশুকে ধর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে চলছে সমালোচনার ঝড়। ধর্ষণের প্রতিবাদে সারা দেশ যখন বিক্ষোভে উত্তাল, ঠিক তখনই গত শনিবার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার গুলিয়াখালী সমুদ্রসৈকতে এক তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সমুদ্রসৈকতে ঘুরতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন এক কলেজছাত্রী।
চলমান এই উত্তাল পরিস্থিতির মধ্যে আগুনে ঘি ঢালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্তার ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ। অভিযুক্ত জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর মোস্তফা আসিফ অর্ণবকে সমর্থন করা একদল ব্যক্তি তাকে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হাতে দিয়ে এবং মাথায় পাগড়ি ও গলায় ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করে। এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন দেশের সচেতন মহল।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রব্বানী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পর এমন একটি নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতি দেশের মানুষ আশা করেনি। শুধু পর্যটন এলাকা নয়, সারা দেশে ধর্ষণসহ নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার যে ঘটনা ঘটছে, তা কোনো অবস্থায়ই মেনে নেওয়া যায় না।
আমাদের শিশুসন্তানরাও এই পৈশাচিকতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না! এই পরিস্থিতি একটি অশনিসংকেত প্রদান করছে! এই পরিস্থিতির কারণে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। ধর্ষণসহ নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধ না করতে পারার ব্যর্থতা সম্পূর্ণভাবে সরকারের। কারণ, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সম্ভাব্য যড়যন্ত্র এবং যেসব ঘটনা ঘটছে, তা মোকাবিলা করতে পারে এমন ব্যক্তিকেই সরকারের ওই সব দায়িত্ব দেওয়া উচিত ছিল।
পতিত ফ্যাসিবাদ বা তাওহিদি জনতা এ সব কিছু করছে এ কথা বলে সরকার দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারে না। ব্যর্থতার পুরো দায়ভার সরকারকে নিতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা, মব ভায়োল্যান্স, মব কিলিং বন্ধে প্রধান উপদেষ্টা বা স্বরাষ্ট্র ও আইন উপদেষ্টা আদৌ উদ্বিগ্ন কি না সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
এই অবস্থা চলতে থাকলে দেশে নিরাপত্তাহীনতা চরমে পৌঁছবে। ফলে শুধু পর্যটন খাত নয়, পুরো অর্থনীতির ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সর্বশেষ বলতে চাই, শিশু আছিয়াকে ধর্ষণ করে হত্যাচেষ্টাসহ সারা দেশে যে ঘটনা ঘটছে, তার দ্রুত বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সেটি না পারলে শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ করা উচিত।
তিনি মানুষকে নিরাপত্তা দিতে না পারলে ক্ষমতা ছেড়ে দিন। পতিত ফ্যাসিবাদের মতো চেয়ার ধরে রাখার প্রবণতা ছাড়তে হবে। যিনি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ, তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন। সেখানে যে বা যারা পারবেন তারা বসবেন। তিনি বলেন, দেখলাম উচ্চ আদালত ধর্ষণের মামলার বিচার কার্যক্রম ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ করার নির্দেশনা দিয়েছেন। আমার দাবি থাকবে, এই সময়সীমা কমিয়ে যেন ৯০ দিন করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানজিরা তামবাছুম হাফসা বলেন, ধর্ষণের জন্য শুধু পোশাক দায়ী হতে পারে না। যদি তা-ই হতো, তবে নাবালক শিশু থেকে বৃদ্ধারা ধর্ষণের শিকার হতো না। ধর্ষণের জন্য বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি, সেটা দায়ী পুরোপুরিভাবে। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে নানা নিষিদ্ধ সংগঠন হেনস্তাকারীদের সমর্থন দিচ্ছে, প্রকাশ্যে আসছে- এতে বর্তমান সরকারের দুর্বলতাও প্রকাশ পায়।

এটি যদি চলতে থাকে, দেশের পর্যটন খাতের যে সুনাম বহির্বিশ্বে রয়েছে, তা নষ্ট হবে। দেশে চলমান ঘটনা মানুষের ভেতর আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। কোনো পর্যটক যখন ভ্রমণের বিষয়ে চিন্তা করেন, প্রথমেই নিরাপত্তার বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। সেখানে দেশে বর্তমান যে পরিস্থিতি, তাতে চরম ধাক্কা আসবে পর্যটন খাতে। আমরা চাই দেশে ধর্ষণ বন্ধে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন হবে।
ঢাকা রিজিয়ন ট্যুরিস্ট পুলিশ সুপার মো. নাইমুল হক বলেন, দেশে চলমান অস্থির অবস্থার নিয়ন্ত্রণ এবং পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ৫ আগস্টের পর সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা কিছুটা দুর্বল হলেও বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট পুলিশ তাদের দায়িত্ব সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে পালন করেছে।
সারা দেশের তুলনায় ট্যুরিস্ট এলাকায় নারী হেনস্তার ঘটনা খুব একটা ঘটেনি। তবে কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে সে ক্ষেত্রে দ্রুত আইনি সহায়তা নিশ্চিতে তৎপর রয়েছি। বাংলাদেশের পর্যটন খাতের উন্নয়নে হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট এবং রেস্টুরেন্টসমূহে নিরাপত্তা এবং পর্যটকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় কাজ করছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। সব পর্যটকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে গুরুত্ব দিচ্ছে। পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় কাজ করছি আমরা। যাতে করে দেশের ভাবমূর্তি কোনোভাবেই ক্ষুণ্ন না হয়।
উল্লেখ্য, দেশের পর্যটন খাতের অগ্রগতি খুব একটা দেখার মতো নয়। সামান্য যে সংখ্যক মানুষ দেশের ভেতরে ভ্রমণ করে, তার অধিকাংশই দেশীয়। বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা নগণ্য। তবে নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিলে তা-ও পড়বে হুমকির মুখে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ভ্রমণ ও পর্যটন উন্নয়নসূচক-২০২২-এর মতে, ১১৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১১০তম (২০১৯ সালে ছিল ১১৩তম)। ওই তালিকায় ভারত ৩৪তম, শ্রীলঙ্কা ৭৭তম ও নেপাল ১০২তম। ২০২৪ সালের তথ্য মতে, বাংলাদেশের জিডিপিতে পর্যটনশিল্পের অবদান প্রায় ৪ শতাংশ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রায় ১ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
বাংলাদেশের চেয়ে দুর্বল অবকাঠামো নিয়েও নেপালের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ৯%। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও পর্যটনশিল্প নবজাতক পর্যায়েই রয়ে গেছে। ২০২০ সালে জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ছিল সিঙ্গাপুরে ৭০%, তাইওয়ানে ৬৫%, হংকংয়ে ৫৫%, ফিলিপাইনে ৫০% ও থাইল্যান্ডে ৩০%। এমনকি অস্ট্রিয়ার ছোট্ট শহর হলস্ট্যাট, যার জনসংখ্যা মাত্র ৮০০; কিন্তু সেখানে ভরা মৌসুমে দৈনিক পর্যটকের সংখ্যা দাঁড়ায় গড়ে ১০ হাজার।
আপনার মতামত লিখুন :