ঢাকা মঙ্গলবার, ১১ মার্চ, ২০২৫

বেসামাল বিএনপির তৃণমূল

মেহেদী হাসান খাজা
প্রকাশিত: মার্চ ১১, ২০২৫, ১২:৫৮ এএম
ছবি: সংগৃহীত

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যে যার মতো দেশ ছাড়েন। অনেকে জীবন বাঁচাতে আত্মগোপনে চলে যান। আওয়ামী লীগবিহীন শূন্য মাঠ পেয়ে হালে পানি পায় বিএনপি-জামায়াত। 

একে একে বিএনপি তৃণমূল থেকে শীর্ষপর্যায়ের নেতাকর্মীরা ক্ষমতায় না এসেও সাদ পেতে শুরু করে। রাতারাতি নেতাকর্মীরা ক্ষমতাবান হয়ে উঠেন। অভিযোগ উঠে দখল-বাণিজ্য আর চাঁদাবাজি নিয়ে। শুরু হয় নিজেদের মধ্যে দলীয় কোন্দল।

বিএনপির এমন কার্যক্রমে ক্ষুব্ধ হচ্ছে দেশের সাধারণ জনতা। যদিও দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব বেশকিছু কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে বেপরোয়া তৃণমূল নেতাকর্মীদের সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা জানান, বিএনপি আওয়ামী সরকারের সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে, কিছু কিছু জায়গায় বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার সাথে তারা জড়িত। 

যার কারণে দলের বদনাম হচ্ছে। ঠিক এই সুযোগটা নিচ্ছেন নতুন নতুন দল। তাদের দাবি- বিএনপি তৃণমূলে বেসামাল হয়ে উঠেছে। এদের বিরুদ্ধে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে ও আইনগতভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছে। এরপরও তৃণমূলে কিছু বিশৃঙ্খলাকারীরা বেসামাল হয়ে উঠেছে।

এসব বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহযোগী অধ্যাপক রূপালী বাংলাদেশকে জানান, আমরা খবর পাচ্ছি তৃণমূলে বেসামাল হয়ে উঠেছে বিএনপি। তারা ওপরের নেতাদের মানতে নারাজ। 

ক্ষমতায় না এসেও সাদ পেতে শুরু করেছে। যেটা নিয়ে জামায়াত বিএনপির মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছে। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের শূন্য মাঠে সুযোগ নিচ্ছে দলটি। 

এক কথায় বলা যায়, বিএনপি এখন নিজেদের ত্যাগী নেতাকর্মীদেরও তেমন কোনো খোঁজখবর নিচ্ছেন না। তিনি আরও বলেন, ক্ষমতায় না এসেও হয়ে উঠেন তৃণমূলে বিএনপির নেতাকর্মীরা ক্ষমতাধর।

এমনকি জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের কঠোর বার্তার পরও থামছে না। বেসামাল অসাধু বিএনপিপন্থি সমর্থকেরা নিজেদের সুবিদা নিচ্ছে। তারা লোভে পড়ে নিজ নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজি-দখলবাজি, এমনকি মাদক কারবারির মতো জঘন্যতম অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। 

এতে বিএনপিতে বাড়ছে অভ্যন্তরীন কোন্দল-হানাহানি ও খুনোখুনি। যে কারণে তৃণমূলে বিএনপিকে এখন বেসামাল বলা হচ্ছে। তবে এর দায় সংগঠনের নীতিনির্ধারকরা এড়িয়ে যেতে পারে না। নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তারেক রহমান কঠোর হুঁশিয়ারি করে তারেক রহমান জানান, জনগণের বিপক্ষে কাজ করলে ৫ আগস্টের মতোই পরিণতি হবে। 

এদিকে তৃণমূল বিএনপি সূত্র জানাচ্ছে, নিজ নিজ এলাকায় আদিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজি-দখলবাজি, মাদক কারবারির মতো জঘন্যতম অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে তৃণমূল বিএনপি। যারা এসব অভিযোগ করছে তারা মিথ্যা বলছে। 

দলটির দাবি, বিএনপিতে বাড়ছে অভ্যন্তরীন কোন্দল-হানাহানি ও খুনোখুনি এসবও মিথ্যা। একটি চক্র বিএনপির নামে বদনাম রটাচ্ছে। 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক অ্যাড. মো. তাইফুল ইসলাম টিপু রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমরা দলীয়ভাবে শক্ত আছি। আমাদের যারা অপরাধ করবে তাদের বিরুদ্ধে দল তদন্ত করছে এবং অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে অধিকাংশ নেতার নামে যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে এর মধ্যে অনেক তথ্য মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। 

দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, অতিউৎসাহী নেতাকর্মীদের গত কয়েক মাসের কর্মকাণ্ড ক্ষমতায় আসার আগে বিএনপির জন্য অনেক বড় অসুবিধা তৈরি করতে পারে। এসব কর্মকাণ্ড গত ১৬ বছরের জুলুম-নির্যাতন ও সরকারের মামলা এবং গ্রেপ্তারের শিকার দলটিকে কিছুটা সমালোচনার মুখে ফেলেছে। 

তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে বিএনপির হাইকমান্ড। অনেকের মতে, এসব ঘটনার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সর্বশেষ জামালপুর সদর উপজেলার মেষ্টা ইউনিয়ন বিএনপির দুই নেতাকে দলের প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। চাঁদাবাজির অভিযোগে যৌথ বাহিনীর হাতে আটক হওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে ওই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। 

সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি মো. সফিউর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক মো. রুহুল আমিনের স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। অব্যাহতি পাওয়া নেতারা হলেন মেষ্টা ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক মো. ফরমান ও সহসাংগঠনিক সম্পাদক হুমায়ুন কবীর ওরফে পলাশ। 

এই বিষয়ে জামালপুর সদর থানার ওসি আবু ফয়সাল মো. আতিক বলেন, চাঁদাবাজির অভিযোগে যৌথ বাহিনীর বিশেষ অভিযানে বিএনপির তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এখন তারা কারাগারে।

নোয়াখালীতে দখল-চাঁদাবাজিসহ দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে বিএনপির তিন নেতাকে দলের প্রাথমিক সদস্য পদসহ সব পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দিয়েছে জেলা বিএনপি। 

জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মো. হারুনুর রশিদ এসব তথ্য জানান। অব্যাহতি পাওয়া নেতারা হলেন- নোয়াখালী সদর উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি নুরুল আমিন, কবিরহাট উপজেলার বাটইয়া ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের জসিম ও হাতিয়া উপজেলার তমরদ্দি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি তানভির হায়দার তান্না।

এ বিষয়ে হারুনুর রশিদ আজাদ বলেন, ‘অব্যাহতি দেওয়া তিন নেতা গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বিভিন্ন সময় নিজ নিজ এলাকায় প্রভাব খাটিয়ে দখল, চাঁদাবাজিসহ দলীয় শৃঙ্খলাপরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। 

এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে তাদের বিরুদ্ধে দলের ঊর্ধ্বতন নেতাদের কাছে বিভিন্ন সময় অভিযোগ করা হয়। ‘প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় জেলা কমিটি ওই তিন নেতাকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।’

এদিকে, এর আগে কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে সেলিম ভূইয়া (৪৪) নামের স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতা নিহত হয়েছেন। সংঘর্ষে উভয় পক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হন। 

স্থানীয় লোকজন জানান, গেল শনিবার বিকেলে নাঙ্গলকোট উপজেলার বাঙ্গড্ডা বাজার বাদশা মিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মোবাশ্বের আলম ভূইয়ার বাঙ্গড্ডা ইউনিয়ন যুবদলের কর্মী সম্মেলন ছিল। এদিন বিএনপির দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। 

এ সময় সেলিম ভূইয়াকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে নাঙ্গলকোট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আহতদের উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। 

অন্যদিকে গত ২৯ জানুয়ারি দুপুরে সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলায় বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় বুধহাটা ইউনিয়নের বেউলা সাইক্লোন শেল্টার মাঠে এ সংঘর্ষে উভয় গ্রুপের কমপক্ষে ৬-৭ জন আহত হয়। 

২৮ জানুয়ারি গাজীপুরের শ্রীপুরে ঝুট ব্যবসা নিয়ে বিএনপির দুপক্ষের সংঘর্ষে দলে চরম বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় ইউনিয়ন বিএনপির দুই নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। শ্রীপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত নোটিশে তাদের বহিষ্কার করা হয়। 

২৩ জানুয়ারি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলা ও পৌরসভা বিএনপির কমিটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বিএনপির বিবদমান দুটি পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে উভয় পক্ষের ১০ থেকে ১২ জন আহত হন। 

এ ছাড়া বৃহস্পতিবার দুপুরে উপজেলা পরিষদের সামনে এবং চট্টগ্রাম রাঙামাটি সড়কের দুই দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষে জড়ানো বিএনপির নেতা-কর্মীরা দলটির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খোন্দকারের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

এসব বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বিএনপির ভাবমূর্তি যারা ক্ষুণ্ন করছে তাদের আমরা কিন্তু ছাড় দিচ্ছি না। কেউ খারাপ কাজ করলে তার দায়ভার তো দল নেবে না। 

যেসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে তারা ১৬ বছর আওয়ামী লীগের রোষানলের শিকার হয়েছেন। তারপরও আমরা সেসব নেতাকর্মীকে অব্যাহতি ও বহিষ্কার পর্যন্ত করছি। আমরা তো আর নেতাকর্মীদের আইনের হাতে তুলে দিতে পারি না।

দলীয় সূত্রমতে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় জিরো টলারেন্স অবস্থান স্পষ্ট করতে চাইছে বিএনপি। এরপরও প্রতিনিয়ত অতিউৎসাহী নেতাকর্মীদের দখল-চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ জমা পড়ছে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। 

দলীয় সূত্রমতে, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ দপ্তরে জমা পড়েছে। শ্যামপুরে একটি লোহার ফ্যাক্টরি এবং সিএনজি স্টেশনের হামলা এবং লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে শীর্ষ এক নেতার বিরুদ্ধে। 

এমনকি এই অভিযোগে সেনাবাহিনী বরাবর অভিযোগ দাখিল করেছে ছাত্ররা। এ ছাড়াও কাপ্তানবাজার, নবাবপুর, গুলিস্তান, কলাবাগান-কাঁঠালবাগান, শ্যামপুর, নিউমার্কেট এলাকাসহ দক্ষিণের অনেক জায়গায় চাঁদাবাজি ও মার্কেট দখলসহ অনেকে বিষয়ে লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। 

তবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনু বলেন, অভিযোগ পেলেই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে আমরা সুনির্দিষ্ট অভিযোগে ২০নং ওয়ার্ড কমিটি বাতিল করেছি। নিউমার্কেট থানা বিএনপির নেতা জাহাঙ্গীরকে বহিষ্কার করেছি। অনেককে শোকজ করা হয়েছে। 

মহানগর দক্ষিণ বিএনপির শৃঙ্খলা ব্যাপারে হার্ডলাইনে ছিল এবং থাকবে। তবে সব অভিযোগ সত্য নয়। মনোমালিন্য, দলীয় প্রতিযোগিতা, ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব নিয়েও অনেকে মিথ্যা অভিযোগ করেছে।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘অতীতে কোনো দল এত বড় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেয়নি। গত ১৬ বছরের জুলুম নির্যাতনের শিকার নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলে সাথে সাথে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে হাইকমান্ড। কোনো অন্যায়কারীকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে না।’ 

জেলা পর্যায়ের একাধিক নেতারা জানান, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর মূলত ২০১৮ সালের দলীয় এমপি প্রার্থীরাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের লোকজন এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ায় স্থানীয় বাজার, ব্রিজের টোলপ্লাজাসহ অনেক কিছুই বিএনপির নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তবে এখন বেশকিছু ঘটনায় শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ায় দলের সর্বস্তরে শৃঙ্খলা ফিরে আসছে।