ছোট পর্দার একসময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী তারিন জাহান রূপ-লাবণ্য দিয়ে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, এমপি, নেতা ও প্রভাবশালীদের কাছে হটকেক ছিলেন। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দোসর আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হওয়ার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন এই অভিনেত্রী-নায়িকা।
ঢাকা-১০ আসনের সাবেক এমপি ‘হঠাৎ বৃষ্টি’খ্যাত নায়ক ফেরদৌসের হাত ধরে অন্ধকার গলিতে যাতায়াত ছিল তারিনের। বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের নেত্রী তারিন ওবায়দুল কাদের থেকে শুরু করে বড় বড় নেতা, ব্যবসায়ী ও আমলাদের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে নানা সুবিধা আদায় করেছেন গত দেড় দশক।
বিতর্কিত ডামি প্রার্থীর ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে সংরক্ষিত মহিলা আসনে সংসদ সদস্য হতেও বেশ তোড়জোর ছিল তারিনের। নামও শোনা যাচ্ছিল বেশ জোরেশোরে।
রাত-বিরাতে এমপি হতে মন্ত্রী-এমপিদের দরজায় কড়া নাড়লেও লাভ হয়নি তারিনের। তবে শুধু আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গেই যে সখ্য ছিল তারিনের এমন কিন্তু না। বিএনপির আমলেও ছিলেন জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেত্রী।
নিজের রূপ-লাবণ্য ব্যবহার করে বিভিন্ন কায়দায় মন্ত্রী ও এমপিদের সন্তুষ্ট করতেন তিনি। ব্যক্তিগত ফায়দা লোটার জন্য এমন কোনো কাজ নেই যেটা তিনি করেননি। বিএনপি-আওয়ামী লীগ সব ফুলের মধু খেয়েছেন ছোট পর্দার নন্দিত অভিনেত্রী তারিন জাহান!
লাস্যময়ী এই অভিনেত্রী বিএনপির আমলে ছিলেন জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেত্রী, আর আওয়ামী লীগ আসার পর হয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের নেত্রী।
বিএনপির আমলে সুযোগসন্ধানী এই অভিনেত্রী শেখ হাসিনা সরকার পতনের আগ পর্যন্ত ছিলেন বড় মাপের আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী। মন্ত্রী ও এমপিদের সঙ্গে করতেন উঠাবসা। থাকতেন শেখ হাসিনার আশপাশে। যে কারণে ধরাকে সরা জ্ঞান করতেন না তিনি। সব জায়গায় প্রভাব বিস্তার করতেন।

সরকার পতনের পর থেকেই আড়ালে তারিন। কোথাও নেই তিনি। হঠাৎ করে অভিনেত্রীর উধাও হওয়ার রহস্যে খুঁজতে গেলে বেরিয়ে আসে চমকপ্রদ তথ্য। খবর রয়েছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে দেশ থেকে পালিয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন।
যদিও অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশেই আত্মগোপনে রয়েছেন। জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতা হত্যাযজ্ঞের উসকানিদাতা হিসেবে চিহ্নিত এই নায়িকা গ্রেপ্তার এড়াতে গাঢাকা দিয়েছেন।
এদিকে, সাবেক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কল লিস্টে পাওয়া গেছে তারিনের নম্বর। নিয়মিত এই নেতার সঙ্গে ছিল তারিনের যোগাযোগ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতেন তিনি।
অভিনেত্রীর অবস্থান নিশ্চিত না হওয়া গেলেও নিয়মিত ফেসবুকে সরব তিনি। প্রতিনিয়ত সরকারবিরোধী পোস্ট করেন নিজের ফেসবুকে। ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গণমাধ্যম ও রাজপথে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন তিনি।
এমনকি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসী বলেও আখ্যা দেন। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর আত্মগোপনে চলে যান তারিন। আত্মগোপনে থেকেই সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র করছেন স্বৈরাচারের দোসর তারিন।
করছেন দেশে-বিদেশে পলাতক আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা। সরকার ও প্রশাসনের আওয়ামী দোসরদের সঙ্গে মিলে ড. ইউনূস সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে কাজ করছেন বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে।
সাবেক এমপি চিত্রনায়ক ফেরদৌসের হয়ে মাঠে সরব ছিলেন তারিন। নির্বাচনে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে শেখ পরিবারের গুণগান গেয়েছেন অনবরত। গত দেড় দশকে রাতের ভোট ও ডামি প্রার্থীর ভোটসহ আওয়ামী লীগের আমলে সব ধরনের নির্বাচনে দলটির প্রার্থীদের হয়ে সারা দেশে ভোট চেয়ে চষে বেড়িয়েছেন।
এ সময় তারিনের সঙ্গে ছিলেন বিনোদন জগতের আওয়ামী দোসর তারকারা। সাবেক এমপি ফেরদৌস, রিয়াজ আহমেদ, জায়েদ খান, সাবেক এমপি সুবর্ণা মুস্তাফা, অরুণা বিশ্বাস, রোকেয়া প্রাচী, শমী কায়সার, ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর, নিপুণ আক্তার, বিজরী বরকতুল্লাহ, সোহানা সাবা, তানভীন সুইটি, জ্যোতিকা জ্যোতি, শামীমা তুষ্টি, রওনক হাসান, আহসান হাবিব নাসিম, সাজু খাদেম, ভাবনা, ফজলুর রহমান বাবু ও সাইমন সাদিকের মতো জনপ্রিয় তারকাদের নিয়ে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে আকণ্ঠ সমর্থন দেওয়ার পাশাপাশি ভোট চেয়েছেন।
বিনিময়ে নিজেরা সুবিধাভোগী হয়েছেন। এরা সবাই ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে গড়ে তোলা বিতর্কিত ‘আলো আসবেই’ গ্রুপে বেশ সক্রিয় ছিলেন। ৫ আগস্টের পরও আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী তারকাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন তারিন।
একটি সূত্র মতে, তারিনসহ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত তারকারা গোপনে নিজেদের মধ্য যোগাযোগ রেখেছেন। তারা দেশে-বিদেশে পলাতক আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গেও নিয়মিত কথা বলেন এবং বিভিন্ন দিকনির্দেশনা নেন। নির্দেশনা মোতাবেক কাজও বাস্তবায়ন করছেন তারা। তারকাদের নানান ষড়যন্ত্র রুখতে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা সাইবার মনিটরিং করছে বলে জানা গেছে।
বিএনপির আমলে প্রায় সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ডাক পড়ত তারিনের। শুধু তাই নয়, সেই সময়কার প্রায় সব মন্ত্রী ও এমপির সঙ্গে ছিল তার বেশ সখ্য। এই অভিনেত্রী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাতারাতি খোলস পাল্টে হয়ে যান নব্য আওয়ামী লীগার।
যোগ দেন বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটে। আর এই সময়টাতে আওয়ামী লীগের যেকোনো অনুষ্ঠানেই ডাক পড়ত এই অভিনেত্রীর। খুব অল্প সময়ের মধ্যে মন্ত্রী ও এমপির হাতে ঘুরে পৌঁছে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে। তার পর থেকে সরকারি দলের হয়ে মাঠে-ময়দানে সক্রিয় হন তারিন। তার লক্ষ্য ছিল সংসদ সদস্যের আসন।
শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও বিভিন্ন মন্ত্রী ও এমপিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তদবির বাণিজ্যে বেশ সরব ছিলেন তারিন! তার একক আধিপত্যের কারণে ত্যাগী নেতারা থাকতেন দূরে। একাই সবাইকে কবজা করে রাখতেন তারিন।
রাজনীতিতে ডিগবাজির তকমা পাওয়া তারিন এমপি হওয়ার জোর চেষ্টা চালিয়েছেন। তবে সংসদ নির্বাচনে নমিনেশন চেয়েও পাননি তিনি। অবশ্য নির্বাচনে তারিন ছাড়াও ছিল আরও বেশ কিছু তারকা।
যার ফলে ঘোরেনি তার ভাগ্যের চাকা। যে কারণে মন খারাপ করে দল থেকে বেশ কিছুদিন নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই সরব থাকা তারিন অনেকটাই নীরব। এখন কোথাও নেই তিনি। তার ব্যবহৃত নম্বরটিও বন্ধ রয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠালে মেলেনি উত্তর।
কেউ কেউ বলছেন, মন্ত্রী ও এমপিদের হাত ধরে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন তারিন। আবার কেউ বলছেন, দেশেই গাঢাকা দিয়েছেন এই অভিনেত্রী। নিজেকে আড়ালে রাখলেও নিয়মিত শামীমা তুষ্টি, তানভীন সুইটি, নিপুণ আক্তারের সঙ্গে রয়েছে যোগাযোগ। করছেন সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র।
গত দেড় দশকে শেখ হাসিনার বাসভবন এবং মন্ত্রীপাড়ায় অবাধ যাতায়াতের সুযোগে তদবির বাণিজ্য থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ছোট-বড় প্রকল্পের কাজ হাতিয়ে নিতেন সিন্ডিকেট সদস্যদের সঙ্গে মিলেমিশে। আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানগুলোতে তারিনসহ বিনোদন জগতের তারকাদের মিলনমেলা বসত।
শেখ পরিবার ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীদের সঙ্গে ছিল তারকাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। আওয়ামী লীগ ও স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে দল ও সরকারের সঙ্গে মিলে নানান ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন।
প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করতে, সরকারের সমালোচকদের দমন করতে। আওয়ামী দোসর তারকাদের ভয়ে অধিকাংশ তারকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু লিখে প্রতিবাদ করতে পারতেন না। কেউ কিছু লিখলেই গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের দিয়ে ভয়-ভীতি দেখানো হতো, এমনকি মামলার ভয় দেখানো হতো।
লক্ষ্মীপুর জেলায় জন্ম ৪৮ বছর বয়সি ইয়াসমিন তাজরীন জাহান তারিন ১৯৮৫ সালে জাতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিভা অন্বেষণ নতুন কুঁড়িতে অভিনয়, নাচ এবং গল্প বলা প্রতিযোগিতায় প্রথম হন। এরপর বিএনপির প্রায় সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ডাক পড়ত তারিনের। এ ছাড়া জিয়া সাংস্কৃতিক সংগঠনের এক যুগ পূর্তিতে বিশিষ্ট সম্মাননা নেন তিনি। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর ভোল পাল্টে হয়ে যান আওয়ামী লীগের পদধারী নেত্রী।
আপনার মতামত লিখুন :