ঢাকা বুধবার, ১২ মার্চ, ২০২৫

কল্যাণ ও অবসর ভাতার ভোগান্তি শেষ কবে?

সেলিম আহমেদ
প্রকাশিত: মার্চ ১২, ২০২৫, ১০:১১ এএম

যশোরের মনিরামপুরের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. ওয়ালিউল্লাহ খান চাকরিজীবন শেষ করে অবসরে গেছেন ২০২২ সালে। পরের বছর ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে কল্যাণ ও অবসর ভাতার জন্য অনলাইনে আবেদন করেন। কিন্তু এখনো ভাতা পাননি তিনি। কবে ভাতা পাবেন সেই নিশ্চয়তাও দিতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।

ওয়ালিউল্লাহ খান বলেন, অবসরের পর নানা রোগবালাই শরীরে বাসা বেঁধেছে। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারছি না। অসুস্থতা বিবেচনা করে অন্তত কল্যাণের টাকাগুলো দেওয়ার জন্য আবেদন করেছিলাম। কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। 

একইভাবে মৃত বাবার অবসরের টাকার জন্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের দরজায় দরজায় ঘুরছেন নাহিদ আহমদ। গতকাল মঙ্গলবার রংপুরের পীরগঞ্জ থেকে আসা নাহিদ আহমদ বলেন, আমার বাবা ২০২১ সালে মারা যান। 

এরপরই আমরা তার কল্যাণ ও অবসর ভাতার জন্য আবেদন করি। এরইমধ্যে কল্যাণের টাকা পেলেও এখনো অবসরের ভাতা পাইনি। গত দুই দিন আগেও এসেছিলাম। অবসর সুবিধা বোর্ডের অফিস থেকে একটি কাগজ দিতে বলেছে। আর সেই কাগজ দিয়ে গেলাম। 

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে অবসরের টাকা দেওয়া হবে। শুধু ওয়ালিউল্লাহ কিংবা নাহিদ নয়, তাদের মতো আরও অন্তত ৪৪ হাজার মানুষ শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় চাকরি জীবন শেষ করে কল্যাণ কিংবা অবসরের টাকা কবে পাবেন সেই অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। অনেকে দিনের পর দিন রাজধানীর নীলক্ষেতের ব্যানবেইস ভবনে কল্যাণ ও অবসর ট্রাস্টের অফিসে ঘুরে ঘুরে কোনো সুরাহা পাচ্ছেন না। 

অনেকে টাকার জন্য ঘুরতে ঘুরতে মারাও যাচ্ছেন। তবে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট এবং অবসর সুবিধা বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেছেন, আমরা টাকা দেওয়ার জন্য আন্তরিক। কিন্তু তহবিল না থাকার কারণে তাদের ন্যায্য সুবিধাগুলো দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমরা সরকারকে একটি বড় অংকের ফান্ড দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছি। সেই টাকা পেলে আশা করছি বিষয়টি সমাধান হবে।

অবসর সুবিধা বোর্ড সূত্র জানায়, ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত জমাকৃত আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করে অবসর ভাতার টাকা সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মচারীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়েছে। এর বাইরে ওই বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ৬ হাজার ৩৭৪টি আবেদন যাচাই করা হয়েছে। এসব আবেদন নিস্পত্তি করার জন্য ৬শ কোটি টাকা প্রয়োজন। এ ছাড়াও বর্তমান সময় পর্যন্ত মোট ৪৪ হাজার ৫শটি আবেদন প্রক্রিয়াধীন। এসব আবেদন নিষ্পত্তি করার জন্য প্রায় ৫ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা প্রয়োজন। 

কল্যাণ ট্রাস্ট সূত্র জানায়, ২০২২ সালে এপ্রিল থেকে ওই বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪ হাজার ১৬৭টি আবেদনের যাচাই করে টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়াও ১ এপ্রিল থেকে গত পহেলা জুলাই পর্যন্ত ৩৯ হাজার ৯৬৫টি আবেদন অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে। এসব আবেদন নিষ্পন্ন করতে প্রায় ৩ হাজার ৭ কোটি টাকা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 

এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের ১৯৯০ সাল থেকে কল্যাণ ট্রাস্টের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ২০০৫ সাল থেকে শুরু হয়েছে অবসর সুবিধা দেওয়া। এই দুই সুবিধা বাবদ শিক্ষকেরা চাকরিকাল অনুযায়ী এককালীন অর্থ পান। 

আইন অনুযায়ী, শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও (বেতনের সরকারি অংশ) থেকে চাঁদা হিসেবে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ কেটে রাখা হয়। এর মধ্যে অবসর সুবিধা বোর্ড ৬ শতাংশ এবং কল্যাণ ট্রাস্ট ৪ শতাংশ পায়। এর বাইরে বিশেষ বা থোক বরাদ্দ এবং বিভিন্ন সময়ে সরকারের দেওয়া সিড মানি বা গচ্ছিত অর্থের লভ্যাংশ পায় সংস্থা দুটি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে শিক্ষকরা কল্যাণের টাকা পাচ্ছেন না। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা সরকারি ব্যাংক থেকে সরিয়ে শিক্ষক নেতারা ব্যক্তিগত লাভের আশায় বেসরকারি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও সিটিজেনস ব্যাংকে রাখেন। 

লুটপাটের কারণে দুটি ব্যাংকই তারল্য সংকটে ভুগছে। বেশির ভাগ গ্রাহক তাদের আমানত তুলে নিয়েছেন। ব্যাংক দুটি চাহিদামতো অর্থ দিতে না পারায় শিক্ষক-কর্মচারীর টাকা পরিশোধ করতে পারছে না কমিটি। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ব্যাংক দুটির পরিবর্তে সরকারি ব্যাংকে তহবিল রেখে লেনদেনের নির্দেশনা দিয়েছে। 

এ প্রসঙ্গে শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব (রুটিন দায়িত্ব) ড. শরিফা নাছরীন বলেন, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কল্যাণের টাকা আগামী সপ্তাহেই ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ট্রান্সফার করা হবে। আমরা তাদের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের টাকা দেওয়ার জন্য বলব। এ ছাড়া আইবাসের মাধ্যমেও শিগগির শিক্ষকদের কল্যাণের ভাতার টাকা দেওয়া শুরু হবে। 

আইবাসের মাধ্যমে টাকা দিলে ভোগান্তি কমে আসবে। এ ছাড়া কল্যাণের সব ভাতা পরিশোধ করার জন্য আমরা ৩ হাজার ৭ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ দেওয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ করেছি। এই টাকা পরিশোধ করলে জট কমে আসবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অবসর বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, অবসর ভাতার জন্য শিক্ষকরা আমাদের কাছে নিয়মিত এসে তাগাদা দেন। অনেকের টাকার জরুরি প্রয়োজন, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারি না। এতে আমাদের কষ্ট হয়। সরকারের উচিত এই শিক্ষকদের অবসর ও কল্যাণ ভাতার জন্য একটি বিশেষ বরাদ্দ রাখা। অথবা বিকল্প উপায় খুঁজে বের করা। 

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত ৫ লাখের বেশি শিক্ষক ও কর্মচারীকে অবসরের ৬ মাসের মধ্যে অবসরকালীন সুবিধা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্টও। 

গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজি জিনাত হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। রায়ের সময় হাইকোর্ট বলেছেন, এটা চিরন্তন সত্য যে, শিক্ষকদের রিটায়ারমেন্ট (অবসরকালীন) বেনিফিট (সুবিধা) পেতে বছরের পর বছর ঘুরতে হয়। 

একজন প্রাথমিকের শিক্ষক কত টাকা বেতন পান, সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে। এ জন্য তাদের অবসরভাতা ৬ মাসের মধ্যে দিতে হবে। এই অবসরভাতা পাওয়ার জন্য শিক্ষকরা বছরের পর বছর দ্বারে দ্বারে ঘুরতে পারে না বলেও মন্তব্য করেছেন আদালত।

অবসর নেওয়ার পর ভাতার জন্য শিক্ষকদের এই হয়রানির শিকার হওয়াকে দুঃখজনক বলছেন শিক্ষকনেতা ও শিক্ষাবিদরা। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি শেখ কাওছার আহমদ বলেন, বেসরকারি মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষক-কর্মচারীরা এমনিতেই বঞ্চিত। 

অবসরে যাওয়ার পর অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা পেতে শিক্ষকদের বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। ফলে অনেক শিক্ষক-কর্মচারী টাকা পাওয়ার পূর্বেই অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করছেন। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য দীর্ঘদিন থেকে আন্দোলন করছি। পরিতাপের বিষয়, এখনো কোনো প্রতিকার পাইনি। আমরা দ্রুত এর কার্যকর সমাধান প্রত্যাশা করছি।