ভেজাল নিয়ন্ত্রণে প্রস্তুতি নেই

মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: মার্চ ১২, ২০২৫, ১২:১১ পিএম

ভেজাল নিয়ন্ত্রণে প্রস্তুতি নেই

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

পবিত্র রমজান মাস ও ঈদকে ঘিরে রাজধানীজুড়ে ভেজাল পণ্যে বাজার সয়লাব। কোনো রকম অনুমোদন ছাড়াই প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে রীতিমতো কারখানা তৈরি করে নকল ও ভেজাল খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন করছে একটি চক্র। যা বাজারজাতের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে রাজধানীসহ সারা দেশে। 

প্রতি বছরে এসব বিষয় সতর্ক থাকে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কিন্তু গত ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর প্রশাসন ভেঙে পড়ায় ভেজাল পণ্য প্রতিরোধে যথাযথ ভূমিকা নিতে পারেনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ফলে বাজারে ভেজাল খাদ্যসামগ্রী ও পণ্যে ছড়াছড়ি। যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। 

সাধারণ মানুষের দাবি, অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন সংস্কারের পাশাপাশি ভেজাল খাদ্যসামগ্রীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান। তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ভেজাল পণ্য প্রতিরোধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা জেলা প্রশাসক, র‌্যাব ও ডিএমপির সঙ্গে যৌথভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে।

জানা গেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নতুন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে প্রশাসনসহ বিভিন্ন জায়গায় আলোচনা-সমালোচনার জন্ম হয়। সাধারণ মানুষ প্রশাসনকে মানতে চায় না। যার কারণে রমজানে ভেজাল পণ্য রুখতে পুলিশ, র‌্যাব, জেলা প্রশাসক, সিটি করপোরেশন ও ভোক্তা অধিদপ্তরের তেমন কোনো প্রস্তুতি দেখা যায়নি। যেটা নিয়ে অসন্তোষ সচেতন মহল।

সচেতন মহলের দাবি, রমজান মাসে ও ঈদের এই সময়ে ভেজাল পণ্য রুখতে প্রশাসন ঢিলেঢালা কেন? একটি সঠিক জবাবদিহি থাকা দরকার। তা ছাড়া রাজধানীসহ সারা দেশে বাজারজাতকরণ হচ্ছে ভেজাল পণ্য, যেটা প্রতিরোধে নেই যথাযথ উদ্যোগ।

গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, অভিযান হলেও থামছে না ভেজাল পণ্য। এখন কেউ প্রশাসনকে দাম দিতে চায় না। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে কারখানা বানিয়ে ভেজাল খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন চলছেই। শুধু রাজধানীতেই ভেজাল পণ্য তৈরি হয় বিষয়টি এমন না, চলে সারা দেশে। 

ভেজাল প্রতিরোধে ঢিলেঢালাভাবে চলছে অভিযান, নেই কারো মাথাব্যথা 
সূত্র জানায়, ভেজাল পণ্যে প্রায় দুই শতাধিক কারখানা চিহ্নিত করেছেন সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। সেগুলো নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ করছে পুলিশ, র‌্যাব, জেলা প্রশাসক, সিটি করপোরেশন ও ভোক্তা অধিদপ্তর। তবে তারা ঢিলেঢালাভাবে তাদের কার্যক্রম করছে। এক কথায় বলা যায়, এটি প্রতিরোধে তেমন কোনো প্রস্তুতি নেই বললেই চলে।

সূত্র জানায়, শুধু রাজধানীতেই ভেজাল পণ্য তৈরি হয় বিষয়টি এমন না। তবে এরইমধ্যে এমন দুই শতাধিক কারখানা চিহ্নিত করেছে র‌্যাব-পুলিশ। এ বিষয়ে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের দায়িত্বশীল এক (র‌্যাব) কর্মকর্তা জানান, রমজান ও ঈদকে টার্গেট করে বরাবরই ভেজাল চক্রের সদস্যরা সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করে। তাই ভেজাল পণ্যের বিরুদ্ধে রমজানের শুরু থেকেই কঠোর অবস্থানে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। মাসজুড়েই আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।

ঢাকা মেট্রোপলিটনের পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী জানান, ভেজাল পণ্য প্রতিরোধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা জেলা প্রশাসক, র‌্যাব ও ডিএমপির সঙ্গে যৌথভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে। এসব কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে দেশব্যাপী অভিযান ও বাজার মনিটরিং কার্যক্রম আরও জোরদার করা হচ্ছে।

ভেজাল পণ্য প্রতিরোধে জনজীবনে স্বস্তি আনতে কাজ চলছে: জেলা প্রশাসক 
ঢাকা জেলা প্রশাসক তানভীর আহমেদ জানান, পর্যায়ক্রমে বাজারের সংখ্যা বাড়ছে। সেই সাথে ভেজাল পণ্যের ছড়াছড়িতে আমরা সতর্ক আছি। রমজান ও ঈদে এসব বাজারের মাধ্যমে ভোক্তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করছি। 

তিনি বলেন, কেউ যাতে ভেজাল পণ্যের শিকার না হয় এবং সরবরাহ না করে সেই বিষয়টিও ওপর আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের বাজারমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ এবং জনজীবনে স্বস্তি আনার লক্ষ্যে ঢাকা জেলা প্রশাসক এসব বিষয়ে সতর্ক আছে। 

অভিযান হলেও থামছে না ভেজাল পণ্য সরবরাহ, সতর্ক না হলেই বিপদ 
এদিকে ১১ মার্চ লক্ষ্মীপুরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ভেজাল খাদ্যদ্রব্য মজুদ-সরবরাহ ও বিক্রির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আকাশ চন্দ্র সাহা নামে এক ব্যবসায়ীকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেকারি পণ্য উৎপাদন করায় ব্যবসায়ী তৌহিদুল ইসলামকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জামশেদ আলম রানা জানান, ঘটনার দিন লক্ষ্মীপুর পৌরসভার বাস টার্মিনাল এলাকায় আকাশ তার মালিকানাধীন অক্ষয় স্টোরে নিম্নমানের ভেজাল শিশু খাদ্য, নকল চাষি ভাই চাল, বনফুল লাচ্ছি সেমাইসহ বিপুল ভেজাল খাদ্য মজুত-সরবরাহ ও বিক্রি করেছিল। 

সেখানে অভিযান চালিয়ে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়। এতে ব্যবসায়ী আকাশকে নিরাপদ খাদ্য আইনে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। একই এলাকায় তৌহিদুলের মালিকানাধীন বেকারিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অবহেলা ও অসতর্কতার সহিত পণ্য উৎপাদন করা হয়। এতে অভিযান চালিয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে তার ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

অন্যদিকে গেল কয়েকদিন আগে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকা থেকে ভেজাল ওষুধ (ইনজেকশন) জব্দসহ ভেজাল ওষুধ প্রস্তুত ও বিক্রি চক্রের চার সক্রিয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গ্রেপ্তাররা হলো- মো. মাঈন উদ্দীন ঘরামি, মো. সবুজ, মো. বাচ্চু ও মো. চান মিয়া। এ সময় তাদের কাছ থেকে ২৬৫ প্যাকেট ভেজাল ওষুধসহ (ইনজেকশন) পুরাতন ব্যবহৃত বিভিন্ন চিকিৎসা সামগ্রী জব্দ করা হয়।

ভেজাল প্রতিরোধে রমজানের মধ্যে ও ঈদের সময়টাতে বিশেষ মনিটরিং থাকবে: শিল্প মন্ত্রণালয়
এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ওবায়দুর রহমান বলেছেন, ভেজাল পণ্যের ছড়াছড়ির বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি। রমজানের মধ্যে ও ঈদের সময়টাতে আমরা বিশেষ মনিটরিং করে থাকি। তবে এসব বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে। 

ভেজাল প্রতিরোধে বিএসটিআইর সার্ভিল্যান্স কার্যক্রম জোরদার 
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) মহাপরিচালক এসএম ফেরদৌস আলম বলেছেন, পবিত্র মাহে রমজান শুরুর এক মাস পূর্ব থেকেই বিএসটিআইর সার্ভিল্যান্স কার্যক্রম জোরদার করা আছে। 

নতুন করে আবারও ভেজাল প্রতিরোধে জোরদার দেওয়া হচ্ছে। এ কার্যক্রমের আওতায় পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ, ভেজাল প্রতিরোধ এবং পণ্যের ওজন ও পরিমাপে কারচুপি রোধকল্পে চলমান মোবাইল কোর্ট ও সার্ভিল্যান্স কার্যক্রমের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। 

জানা যায়, ভেজাল পণ্য প্রতিরোধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা র‌্যাব ও ডিএমপির সঙ্গে যৌথভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হলেও এসব থাকছে না। এসব নিয়ন্ত্রণে না আশায় দেশব্যাপী অভিযান ও বাজার মনিটরিং কার্যক্রম আরও জোরদার করেছে প্রশাসন।

র‌্যাব জানায়, বিভিন্ন জেলা হতে অপরিপক্ব কাঁচা আম নিয়ে এসে আমের ঝুড়িতে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকারক ইথোফেন, কার্বাইড ও অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান দিয়ে পাকানো হচ্ছিল। এ ছাড়াও ক্ষতিকারক অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান দিয়ে দ্রবণ তৈরি করে আমের ঝুড়িতে স্প্রে করা হয় যাতে করে আম ২-১ দিনের মধ্যে পুরোপুরি হলুদ রং ধারণের আগেই পেকে যায় যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক। অথচ এসব রাসায়নিক বোতলের গায়েই লেখা রয়েছে ফল পাকানোর কাজে ব্যবহার নিষিদ্ধ।

ভেজাল প্রতিরোধে নতুন করে মাঠে নামছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর
এদিকে ভোক্তা অধিকার জানায়, রোজার মধ্যে ও ঈদকে সামনে রেখে ঢাকা মহানগরসহ সারা দেশে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর নকল ভেজাল প্রতিরোধের পাশাপাশি আলু, পেঁয়াজ, চাল, ডাল, চিনি ও ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে বাজার তদারকিতে বিভিন্ন অভিযান চলমান থাকবে।

এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের (ঢাকা বিভাগ) উপপরিচালক বিকাশ চন্দ্র দাস জানান, ভেজাল প্রতিরোধে আমরা নিয়তিন অভিযান পরিচালনা করছি। 

নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক দায়িত্বশীল কর্মকতা বলেন, রমজানকে সামনে রেখে রাজধানীতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য কারখানা। এসব কারখানায় তৈরি হচ্ছে নকল, মানহীন-অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাংলা সেমাই, লাচ্ছা সেমাই, নুডলস, ঘি, হলুদ, মরিচ, মসলা, বেসন, আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল, পাউরুটি, কেক ইত্যাদি। কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর নানা উপকরণ, রাসায়নিক দ্রব্য ও রাসায়নিক রং মেশানো হচ্ছে এসব পণ্যে।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!