জাতীয় নির্বাচন এলে বাড়ে জোটের কদর। আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় মাঠ এখন বিএনপি ও জামায়াতের দখলে। এরই মধ্যে বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ায় আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইসলামপন্থি দলগুলোকে নিয়ে মৈত্রী গড়ার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। একইভাবে বিএনপিও তৎপর নির্বাচনি যাত্রায় ইসলামপন্থিদের পাশে পেতে।
আগামী নির্বাচনে ইসলামপন্থিদের ভোট ‘এক বাক্সে’ আনার চিন্তা নিয়ে এগুচ্ছে জামায়াত। তবে বিএনপিও চাইছে তাদের সঙ্গে থাকবে ইসলামি দলগুলো। বাক্সে ভোট বাড়াতে বিএনপি এবং জামায়াত দুই দলই কাছে টানতে চায় ইসলামি দলগুলোকে। সে লক্ষ্যে সর্বোচ্চ ছাড় দিতেও প্রস্তুত তারা। আদর্শিক অমিল থাকলেও জামায়াতের সঙ্গে জোট করার ইঙ্গিত ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিসের।
জামায়াতের সঙ্গে আদর্শিক অমিল থাকলেও ভোটের লড়াইয়ে এগিয়ে থাকতে চরমোনাই পীরের বরিশালের বাড়ি গেছেন জামায়াত আমির। বরিশালে পীর সাহেব চরমোনাইয়ের মাদ্রাসা সফর করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। ২১ জানুয়ারি বিভিন্ন ধরনের ফল আর মিষ্টি নিয়ে চরমোনাই পীরের বাড়িতে হাজির হন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান।
ফেরার সময় জামায়াতপ্রধানকে উপহার দেওয়া হয় কাশ্মীরি শাল, কোরআনসহ নানা সামগ্রী। রাজনীতির মাঠে পরস্পরবিরোধী অবস্থান দেখা গেলেও এভাবেই এক হয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
মানুষের কল্যাণে ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে সম্মত হন তারা। সে সময় দুজন দুজনের সঙ্গে করমর্দন করে কুশলাদি বিনিময় করেন। পরে দুপুরে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন তারা। জামায়াতের সঙ্গে আদর্শিক মিল না থাকায় দুই দলের মধ্যে দীর্ঘদিনের দূরত্বের বরফ গলেছে বলে মনে করেন অনেকেই।
সপ্তাহ না ঘুরতেই ২৭ জানুয়ারি পীর সাহেব চরমোনাই ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিমের দরবারে সমঝোতার চেষ্টা চালিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব। পুরানা পল্টনে ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে ইসলামী আন্দোলনের আমির ও চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
দীর্ঘ সময় আলোচনার পর তাঁরা ১০টি বিষয়ে একমত হওয়ার কথা সাংবাদিকদের জানান। মির্জা ফখরুল সেখানে জোহরের নামাজ পড়েন এবং চরমোনাইয়ের পীরের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন। এ সময় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু ছিলেন তাঁর সঙ্গে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির দিক থেকে এ বৈঠকের লক্ষ্য, দূরত্ব কমিয়ে এনে সম্পর্কোন্নয়ন। তবে এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে মাঠে-ময়দানে বিএনপির সমালোচনা করে দেওয়া দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের বক্তব্য থামানো।
বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীর প্রসঙ্গও এসেছে। নির্বাচনের সময় নিয়ে পুরোপুরি একমত না হলেও ইসলামি শরিয়াহবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়াসহ ১০টি বিষয়ে একমত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দল দুটি। বৈঠক শেষে বিএনপি ও ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের ঘোষণায় দুই দলের মধ্যে দূরত্ব কমানোর ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ‘সংস্কার ও নির্বাচন’সহ বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে যে কয়টি রাজনৈতিক দলের মতবিরোধ সামনে আসে, এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন অন্যতম।
এর মধ্যে আওয়ামী লীগের পতনের পর বিভিন্ন স্থানে ‘দখল, চাঁদাবাজি’ নিয়ে জামায়াতের পাশাপাশি বিএনপিকে লক্ষ্য করে বক্তব্য রেখে আসছিলেন ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম ও জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম।
স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক মাসের মাথায় ফয়জুল করিম শরীয়তপুরে এক সমাবেশে অভিযোগ করেন, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর চিহ্নিত একটি দল লুটপাট, খুনখারাবি ও চাঁদাবাজি শুরু করেছে। এ ছাড়া ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম মন্তব্য করেন, বাংলাদেশের মানুষ আর চাঁদাবাজ, দখলকারী, খুনিদের ক্ষমতায় দেখতে চায় না।
সর্বশেষ ২৪ জানুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে কর্মসূচিতে তিনি বলেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইসলামের পক্ষে একক বাক্স দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে।’ এ বক্তব্যগুলো বিএনপিকে নিশানা করেই বলা হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছিল। রাজনীতির মাঠে উত্তাপ থামাতে এমন বৈঠক বলে প্রচারিত আছে।
জানা যায়, বৈঠকে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে আঘাত করে কথা বলব না’ বলে ঘোষণা দেয় দুটি দল। যদিও বৈঠকে ইসলামী আন্দোলনের নেতারা ‘দখল, চাঁদাবাজির’ কথাটি তুলেছেন এবং বলেছেন, তারেক রহমানসহ কেন্দ্রীয় নেতারা এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু তৃণমূলে এর কোনো প্রভাব পড়ছে না বলে অভিযোগ করেন তাঁরা।
জবাবে বিএনপির নেতারা স্বীকার করেন, কোথাও কোথাও হচ্ছে, তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে দল থেকে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এর জন্য দরকার রাজনৈতিক সরকার। নির্বাচনটা হয়ে গেলে দখল, চাঁদাবাজির মতো এ ধরনের অপরাধগুলো নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
বৈঠকে উপস্থিত একটি সূত্র জানিয়েছে, আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রশ্নে ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপি একমত হয়নি। এ ছাড়া নির্বাচনের সময় নিয়েও দল দুটিতে কিছুটা মতপার্থক্য হয়।
ইসলামী আন্দোলন আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের পক্ষে। বিএনপির নেতারা এর বিপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন, এতে আসনভিত্তিক প্রার্থী থাকবে না। ফলে মানুষ ভোটের প্রতি অনাগ্রহী হয়ে উঠবে। এ ছাড়া ভোটের সময় কেন্দ্রে ভোটার আনার একটা বিষয় থাকে। প্রার্থী না থাকলে কেউ গরজ দেখাবে না।
নির্বাচন ঘিরে এ দুটি দলের তৎপরতায় ইসলামি দলগুলোর মধ্যে দোটানা ভাব দেখা দিয়েছে।
জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন অতীতের তিক্ততা মিটিয়ে এখন ঘনিষ্ঠ। তারা ইসলামপন্থিদের ভোট ‘এক বাক্সে’ দেওয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে, এটার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।
ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ইসলামি শক্তির অভিন্ন বাক্স আমরা দিতে চাই। তবে আমাদের আদর্শিক মিল নেই সেটা আপনারা জানেন। আমার নীতিগতভাবে বা রাজনৈতিকভাবে এক হয়ে গেছি তা কিন্তু না। আমরা একটা রাজনৈতিক দল তারা আরেকটা রাজনৈতিক দল। আমাদের মাঝে কিছু মতপার্থক্য আছে বিধায় আমরা আলাদা রাজনীতি করি।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমেদ আবদুল কাদের রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, দুই দিকেই আমাদের আলোচনা আছে। আমার চাই ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো একত্রে নির্বাচন করুক।
বিএনপি যেহেতু জাতীয় সরকারের কথা বলছে তার মানে সবার এক সঙ্গে নির্বাচন করা উচিত। আমরা চাই আওয়ামী লীগ যে অপরাধ করেছে তারা যাতে নির্বাচনে আসতে না পারে। গণহত্যার দায়ে তাদের বিচার হোক। বিচার হওয়ার আগে যাতে নির্বাচন করতে না পারে। নির্বাচন করতে দিলে তারা আবার অরাজকতা সৃষ্টি করবে। কয়টি নির্বাচন থেকে তাদের নিষিদ্ধ করা হবে তা ঠিক করবে সরকার।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, জামায়াতের সঙ্গে যারা যাবে তারা কি পাবে জানি না। বিএনপির সঙ্গে থাকলে তাদের জন্য মঙ্গল হবে। জামায়াত কয়টা আসন পাবে, আর অন্যদের কয়টা দেবে? বিএনপির সঙ্গে জোট করে নির্বাচন করায় আসন ছেড়ে দিয়েছিল বিএনপি।
সে কারণে তারা ১৭টি আসন পেয়েছিল। এককভাবে করলে কয়টি আসন পাবে তারা? বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সব ইসলামি দলগুলোকে নিয়ে কাজ করছে তারা। তার আশা, ইসলামি রাজনৈতিক এলায়েন্স এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে আমাদের নির্বাচনি সমঝোতা বা ঐক্যের সম্ভাবনা বেড়েছে।
ছাড় না দিলে তো ঐক্য হবে না। আমরা সর্বোচ্চ ছাড় দিতে প্রস্তুত। তখন দেখা যাবে আমাদের যে চিন্তা আছে সেখান থেকে সরে আসতে হবে। ঐক্যের প্রয়োজনে আমরা যে ৩শ আসনের চিন্তা করছি সেখানে আর থাকতে পারব না। ১০, ২০ কিংবা ৫০টা যদি ছাড়তে হয়; তবে আমাদের ওই পরিমাণ আসন হয়তো কমে আসবে।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামের নেতা অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী যেকোনো দলের সঙ্গেই হতে পারে ঐক্য। আর ইসলামি দলগুলোর মূল্যায়নে যেকোনো ছাড় দিতেও প্রস্তুত থাকবে তার দল। তা ছাড়া বিএনপি মেজরিটি পেলে জাতীয় সরকার গঠনের জন্য আমাদের উদ্যোগ থাকবে।
আন্দোলন সংগ্রামে আমাদের জোটসঙ্গীদের নিয়ে আমাদের জোট করার সম্ভাবনা আছে। ইসলামি দল, ডানপন্থি, বামপন্থি- সবাইকে নিয়েই আমরা এগুতে চাই। জাতীয় সরকার করতে চাই আমরা। ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। আমরা ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে এগুচ্ছি। জোটের শক্তি বাড়াতে আমরা সব ধরনের সেক্রিফাইজ করতে প্রস্তুত আছি।
দল-জোট শক্তিশালী করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। নির্বাচন নিয়ে বিভক্তি বাড়ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপির সঙ্গে অনেকেই জাতীয় নির্বাচনমুখি হলেও নির্বাচন নিয়ে সময় বেঁধে দিতে নারাজ জামায়াতসহ বেশকিছু ছোট দল। তাদের চাওয়া আগে হোক স্থানীয় সরকার নির্বাচন। রাজনীতির সরল অংকের গরল ফল এখানেই মেলানো সম্ভব নয় বলে মনে করেন দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক দলের নেতারা।