ঢাকা শনিবার, ১৫ মার্চ, ২০২৫

কাগজের ২৫ কোটি পাওনা নিয়ে বিপাকে আমদানিকারক

উৎপল দাশগুপ্ত
প্রকাশিত: মার্চ ১৫, ২০২৫, ১২:৩৭ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বিনা মূল্যের পাঠ্যবই ছাপার জন্য চীন থেকে আমদানি করা ১৭৫০ টন কাগজ ও আর্ট কার্ড বাবদ বকেয়া ২৫ কোটি টাকা পাওনা নিয়ে বিপাকে পড়েছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটস। 

এনসিটিবি কাগজ নেওয়ার জন্য বরাদ্দকৃত প্রেস ও ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটসের ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা অনুযায়ী কাগজ আনা হলেও বর্তমানে প্রেসগুলোর অনীহার কারণে উল্লিখিত পরিমাণ কাগজ এখনো চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে আছে। এতে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে প্রতিদিন প্রায় ৮ লাখ টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে। 

এদিকে বকেয়া পাওনার বিষয়ে তিন পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক হলেও স্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। আমদানিকারকের পাওনা মেটানোর জন্য নীতিগতভাবে এনসিটিবি একমত হলেও প্রেসগুলো দায় নিতে রাজি নয়। 

প্রেসগুলো এ পরিস্থিতির জন্য এনসিটিবিকেই দায়ী করছে। এ অবস্থায় কবে নাগাদ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বকেয়া পাওনা ফেরত পাবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। এ অনিশ্চয়তায় ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে আমদানিকারকের।

অন্যদিকে চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের বিনা মূল্যের পাঠ্যবই ছাপায় নানা অনিয়ম ও অসহযোগিতার কারণে এক ডজন প্রেসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চিন্তা করছে এনসিটিবি। বই উৎপাদন ও বিতরণের চলমান কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

অন্যদিকে কাল রোববারের মধ্যে এনসিটিবির শতভাগ বই বিতরণের ঘোষণার বাস্তবায়নও অনিশ্চিত। এ বিষয়ে সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রায় ৭০ লাখ বই ছাপাই হয়নি। আর উপজেলায় এখনো পৌঁছনি প্রায় ৩ কোটি বই। এনসিটিবি ও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। 

বকেয়া পাওনা নিয়ে অনিশ্চয়তা : চলতি শিক্ষাবর্ষের বই ছাপার কাজ শুরু হওয়ার পর মিলগুলো সিন্ডিকেট করে কাগজের দাম বাড়িয়ে দেয়। গত নভেম্বরে যে কাগজের দাম ছিল টনপ্রতি ১ লাখ ১০ হাজার টাকা, জানুয়ারি মাসে সে কাগজের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৪০ থেকে ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। 

হঠাৎ করে কাগজের এই উচ্চমূল্যের কারণে প্রেসগুলোর নাভিশ্বাস ওঠে। বই ছাপা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনসিটিবি প্রেসগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করে প্রতি টন ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা দরে চীন থেকে ৭ হাজার ৭৫০ টন কাগজ আমদানির জন্য ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটস নামে একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়। উল্লিখিত দরে ৩৫টি প্রেস বিভিন্ন পরিমাণে (টন হিসাবে) এই কাগজ গ্রহণ করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। 

এ জন্য চুক্তির সময় প্রতিটি বরাদ্দকৃত প্রেস তার কাগজের সমপরিমাণ মোট টাকা প্রথম কিস্তিতে ২০ শতাংশ, দ্বিতীয় কিস্তিতে ১০ শতাংশ এবং তৃতীয় ও শেষ কিস্তিতে ৭০ শতাংশ টাকা পরিশোধ করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। 

পরিকল্পনা অনুযায়ী আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সব কাগজ ফেব্রুয়ারির মধ্যে দেশে নিয়ে এসে প্রেসগুলোকে দেওয়ার বিষয়ে ঐকমত্য হয়। কিন্তু চীনে নববর্ষ উদযাপনের কারণে কিছুুটা সময় দেরিতে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের ৪ হাজার টন কাগজের প্রথম চালান আসে ২৭ মার্চ ও বাকি ৩৭৫০ টন কাগজ আসে ৩ মার্চ। 

উল্লিখিত কাগজের মধ্যে ৬ হাজার টন কাগজ ইতিমধ্যে প্রেসগুলোকে দেওয়া হয়েছে এবং পাওনা নিয়েও জটিলতা হয়নি। তবে ৯টি প্রেসের জন্য আনা অবশিষ্ট ১৭৫০ টন কাগজ ছাড় করা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। উল্লিখিত পরিমাণ কাগজের জন্য ৯টি প্রেসের কাছে আমদানিকারকের বকেয়া পাওনা প্রায় ২০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। 

এর বাইরে প্রেসগুলোর জন্য ইতিপূর্বে একই আমদানিকারকের আনা আর্টকাডের প্রায় ৪ লাখ টাকাও এখনো বকেয়া রয়ে গেছে। সব মিলিয়ে প্রেসগুলোর কাছে আমদানিকারকের বকেয়া রয়েছে ২৫ কোটি টাকা। 

বকেয়ার তালিকা থেকে দেখা গেছে, ৯টি প্রেসের মধ্যে ১টি প্রেস তাদের মোট বকেয়ার ৭৫ শতাংশ, ১টি ৬৫ শতাংশ ও ১টি ৪৫ শতাংশ পরিশোধ করেছে। রেদওয়ানিয়া ও ঢাকা প্রিন্টার্স তাদের জন্য বরাদ্দকৃত ২০০ টন কাগজের ২ কোটি ৬০ লাখ টাকার মধ্যে একটি টাকাও পরিশোধ করেনি।

এ বিষয়ে রেদওয়ানিয়া প্রিন্টিং প্রেসের স্বত্বাধিকারী শরীফুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, প্রথমত কাগজ নেওয়ার জন্য লিখিত কোনো চুক্তি হয়নি। মৌখিক আলাপে এই বন্দোবস্ত হয়েছে। 

এ ছাড়া একদিকে চীনের কাগজ আসতে দেরি হচ্ছিল, অন্যদিকে বই দেওয়ার জন্য এনসিটিবি কর্তৃপক্ষের উপর্যুপরি তাগাদায় দেশের বাজার থেকে কাগজ কিনে বই ছাপতে বাধ্য হয়েছি। এখন টাকা দেওয়া সম্ভব নয়। এনসিটিবির কাছে কাজের ২০ শতাংশ বিল রয়েছে। এনসিটিবি ইচ্ছা করলে সেটা সমন্বয় করে বকেয়া পাওনা দিতে পারে। 

রূপালী বাংলাদেশের কাছে প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন ঢাকা প্রিন্টার্সের স্বত্বাধিকারী আমিন। তিনি বলেন, এ নিয়ে কোনো চুক্তি হয়নি। এনসিটিবি থেকে আমাদের তিন দিনের মধ্যে পে-অর্ডার কিনে চায়না কাগজ কেনার কথা বলা হয়। কিন্তু টাকা না থাকায় আমরা সেটা পারিনি। পরে এদিক-সেদিক থেকে ধার-দেনা করে দেশের বাজার থেকে কাগজ কিনে বই ছাপিয়েছি।

চুক্তি অনুযায়ী কাগজ আসতে তেমন দেরি হয়নি মন্তব্য করে আমদানিকারক ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটসের পরামর্শক মেজর এস এম রিয়াজ রশীদ, পিএসসি (অব.) হতাশা প্রকাশ করে বলেন, এ ঘটনায় এনসিটিবি ও প্রেসগুলো লাভবান হলেও ক্ষতি হয়েছে আমাদের। 

চট্টগ্রাম বন্দরে ৭০টি কনটেইনারে রক্ষিত ১৭৫০ টন কাগজ রাখার জন্য প্রতিদিন প্রতিটি কনটেইনারের জন্য আমাদের ১১ হাজার টাকার বেশি অতিরিক্ত টাকা দিতে হচ্ছে। 

তিনি আরো বলেন, ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী এই কাগজ কোনো কারণে অবিক্রীত, অব্যবহৃত ও প্রিন্টার্সদের নিতে অনীহা হলে এনসিটিবি তা নিজেদের কাছে গচ্ছিত রাখবে। তবে এ বিষয়ে এনসিটিবি কোনো সদুত্তর না দেওয়ায় কাগজ ছাড়ে জটিলতা ও বকেয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। 

সংশ্লিষ্ট প্রেসের বিল থেকে সমন্বয়, প্রেসগুলোর মধ্যে ‘পুশ সেল’ পদ্ধতিতে কাগজ বিক্রয়, অথবা প্রেসগুলোর বিল থেকে ২৫ শতাংশ অগ্রিম নেওয়ার মধ্যে এনসিটিবি আমদানিকারকের বকেয়া পরিশোধের ব্যবস্থা নিতে পারে বলে মন্তব্য করেন ইউনিয়ন অ্যাসোয়িটসের এই পরামর্শক।

চীন থেকে কাগজ আনার ব্যবস্থা করে আবার দ্রুত বই ছাপানোর জন্য প্রেসগুলোকে চাপাচাপি বকেয়া পাওনা নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে কি না প্রশ্নের উত্তরে এনসিটিবি চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, শিক্ষার্থীরা যাতে দ্রুত বই পায় সেই প্রায়োরিটিকে বিবেচনায় নিয়ে আমরা কাজ করেছি। 

এই জটিলতার পেছনে কাগজ মিলগুলোর সিন্ডিকেশনকে দায়ী করে চেয়ারম্যান বলেন, প্রথমে মিলগুলো সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দিল। আমরা এ জন্য চায়না থেকে কাগজ আনার সিদ্ধান্ত নিলাম। কাগজ যখন চলে আসছে, মিলগুলো তখন হঠাৎ করে তাদের কাগজের দাম কমিয়ে দিল। 

অন্যদিকে চায়নার কাগজও আসতে দেরি হচ্ছিল। প্রেসগুলো এই সুযোগে চায়না কাগজের চেয়ে কমে দেশের কাগজ দিয়ে বই ছাপানো শুরু করল। এখানে প্রেসগুলোর লাভের বিষয়ও ছিল।

সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে এখন এনসিটিবি কী করতে পারে প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিকল্প হিসেবে প্রেসগুলোর কাজের বিলের ২০ শতাংশ টাকা বকেয়া পাওনা মেটাতে সমন্বয় করা যেতে পারে। 

এক ডজন প্রেসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা: এদিকে চলতি শিক্ষাবর্ষে বই ছাপার কাজে নানা অনিয়ম-অসহযোগিতার কারণে ১০ থেকে ১২টি প্রেসের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার চিন্তা করছে এনসিটিবি। তবে বইয়ের কাজ শেষ না হওয়ায় এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।

সূত্র জানায়, অসহযোগিতা, আংশিক সহযোগিতা ও পূর্ণ সহযোগিতা- এই তিন ক্যাটাগরিতে প্রেসগুলোর কর্মকাণ্ড বিচার-বিশ্লেষণ করে শাস্তি বা পুরস্কারের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বই ছাপার কাজে এনসিটিবিকে সহযোগিতা, প্রতিশ্রুত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা, বইয়ের মান,  কাগজ আমদানিকারকের পাওনা অর্থ পরিশোধে সদিচ্ছা ইত্যাদি নানা বিষয় বিবেচনা করা হবে।

 শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে অভিযুক্ত প্রেসকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ ও জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডই দেওয়া হতে পারে। 
সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছর অসহযোগিতার অভিযোগে কিছু প্রেসের কাজে অসন্তুষ্ট ছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। 

বই ছাপার কাজ শেষ হওয়ার পর প্রেসগুলোর কর্মকাণ্ড বিবেচনায় নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এনসিটিবিকে তখন কঠোর নির্দেশনাও  দেওয়া হয়। এনসিটিবিরও বিষয়টি বাস্তবায়নের চিন্তা রয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে সে নিয়ে সন্দেহও রয়েছে সূত্রের মাঝে।

এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, আগামীতে বই ছাপার কাজ সুষ্ঠুভাবে করার জন্য এ বছর অনিয়ম-অসহযোগিতা করেছে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য আমরা অসহযোগিতার ক্যাটাগরিতেও পরিবর্তন আনছি। 

৩ কোটি বই পৌঁছানো বাকি : গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদে গত মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে এনসিটিবি। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, চলতি বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে মোট বইয়ের সংখ্যা ৩৯ কোটি ৬০ লাখের বেশি। এর মধ্যে গত ১০ মার্চ সোমবার পর্যন্ত ছাপা হয়েছে ৩৮ কোটি ৭০ লাখ ৪ হাজার। 

প্রাথমিকে ৯ কোটি ১৯ লাখ বইয়ের মধ্যে ছাপা হয়েছে ৯ কোটি ১৮ লাখের বেশি। সরবরাহ করা হয়েছে (পিডিআই) ৯ কোটি ১৬ লাখের বেশি। আর মাধ্যমিকের (ইবতেদায়ি মাদরাসাসহ) প্রায় ৩০ কোটি ৪১ লাখ বইয়ের মধ্যে ছাপা হয়েছে ২৯ কোটি ৫১ লাখের বেশি। সরবরাহ হয়েছে ২৭ কোটি ২০ লাখের মতো।

সংবাদ সম্মেলনে এনসিটিবির চেয়ারম্যান জানান, প্রাথমিকের ৯৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ, মাধ্যমিকের ৯১ দশমিক ৬৭ শতাংশ বই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এক কোটি বই ছাপা বাকি আছে এবং দুই থেকে আড়াই কোটি বই বাইন্ডিং বাকি। আগামী ১৬ মার্চের মধ্যে এসব বই সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই সংবাদ সম্মেলনের তিন দিন পর গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রায় ৭০ লাখ বই ছাপাই হয়নি। আর উপজেলায় বই পাঠানোর জন্য প্রি-ডেলিভারি ইন্সপেকশন (পিডিআই) করা হয়েছে ১ কোটি ৭১ লাখ বই। অর্থাৎ সব মিলিয়ে প্রায় ৩ কোটি বই এখনো শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছেনি। তাই এনসিটিবির ঘোষিত সময়ে শতভাগ বই দেওয়া সম্ভব হবে না বলেই সূত্রের মত।