নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র দেখছে বিএনপি

মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: মার্চ ১৫, ২০২৫, ১২:৪৪ এএম

নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র দেখছে বিএনপি

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

চলতি বছরের শেষের দিকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও বিএনপি নির্বাচন আয়োজনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র দেখছে। তাদের দাবি, নির্বাচন নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। 

দলটির নেতারা বলছেন, বিএনপি ও তাদের মিত্ররা নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি করলেও অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট কোনো বার্তা আসছে না। এতে নানা সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে।

প্রধান উপদেষ্টা, নির্বাচন কমিশন ও সেনাপ্রধানের বক্তব্যে তারা আশাবাদী হলেও সরকারের অন্যান্য অংশের বক্তব্য এবং দেশি-বিদেশি মহলের প্রতিক্রিয়ায় ষড়যন্ত্রের আভাস মিলছে। এই পরিস্থিতিতে আগামী এপ্রিল থেকে সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে ‘নির্বাচনি ষড়যন্ত্র’ প্রতিহত করার পরিকল্পনা নিয়েছে বিএনপি। 

সম্প্রতি দলটির একটি বৈঠকে এসব আলোচনা হয় এবং এটি নিয়ে বিএনপির নেতারা আলোচনা-সমালোচনা করতে থাকেন। ওই বৈঠকে থাকা দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির এক সদস্য এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্রের বিষয়টি আলোচনায় এলে এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। 

তিনি জানান, আপাতত এটা বলা যায়, সংসদ নির্বাচন নিয়ে অন্ধকার দেখছে বিএনপি। তিনি দাবি করেন, তাছাড়া নতুন পার্টি এনসিপিকে গোপনে সায় দিয়েছে জামায়াতে ইসলাম, যার কারণে বিষয়টি নিয়ে সাংগঠনিকভাবে এগোচ্ছে বিএনপি। 

সরকারকে চাপের বিকল্প ভাবছে না দলগুলো: ডিসেম্বরে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চাইলে চাপ সৃষ্টি করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। তা না হলে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন ২০২৭ সালে টেনে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনায় এগোচ্ছে বলে মনে করেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। 

তারা মনে করেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে চাপ দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে আদায় করে নিতে হবে। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা মির্জা আব্বাস বলেন, আন্দোলন করে চাপ দিয়ে নির্বাচন আদায় করা লাগলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে।  সেই দিকে যাওয়া আমাদের কারো জন্য মঙ্গল হবে না।  

নতুন পার্টি এনসিপিকে সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার : জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেরিতে করতে চাওয়ার মূল কারণ কী, সে সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) অবস্থান সুসংহত করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। 

এনসিপি মাঠের রাজনীতিতে শক্ত-পোক্ত হয়ে উঠতে চেষ্টা করছে। নতুন পার্টি এনসিপিকে সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের কাছে ছাত্রনেতৃত্বের বিশেষ অনুরোধ রয়েছে বলেও জানিয়েছে নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র। জাতীয় নির্বাচন একটু সময়সাপেক্ষ করে নিতে পারলে মাঠ গোছাতে সময় পাবে এনসিপি।  

নতুন পার্টি এনসিপিকে গোপনে সায় দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী: নতুন পার্টি এনসিপিকে গোপনে সহযোগিতা করছে জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতও মনে করে, নির্বাচন একটু পিছিয়ে নিতে পারলে দীর্ঘ সময় মাঠের রাজনীতির বাইরে থাকা দলটি আরও গুছিয়ে নিতে সক্ষম হবে। 

তাই প্রয়োজনীয় সংস্কারকে ইস্যু করে নির্বাচন দেরি করার ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রয়েছে বর্তমান পরিস্থিতিতে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকা জামায়াতে ইসলামী। তারা মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থাকলেও তাদের রাজনীতির তেমন অসুবিধা ঘটছে না। 

নানা কৌশলে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে তাদের অনুসারী রয়েছে। ফলে নির্বাচন দেরিতে হলেও বেকায়দায় পড়ার কোনো সুযোগ আপাতত জামায়াতের নেই।  

বিএনপির নির্বাচন পেছানোর ব্যাপারে কঠোর আপত্তি : এদিকে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলো জানা গেছে, কোনো দল বা সংগঠনকে রাজনৈতিক মাঠে শক্তিশালী করে তুলতে নির্বাচন দিতে দেরি করার কোনো মানে হয় না। সরকার এটি করলে তা পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ হবে। 

তাই দেশের অপর প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপির নির্বাচন পেছানোর ব্যাপারে কঠোর আপত্তি রয়েছে।  নির্বাচন ডিসেম্বরে আদায় করার ব্যাপারে প্রয়োজন হলে তারা আন্দোলন সংগঠিত করার কৌশলও গ্রহণ করেছে। কোনোভাবেই ডিসেম্বরের বাইরে নির্বাচন যাক, তা চায় না বিএনপি। 

পাশাপাশি চাপ দিয়ে নির্বাচন আদায় করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে দলটির ভেতরে বিস্তর গবেষণা চলছে। এজন্য বিএনপি অন্য রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গেও শলাপরামর্শ করতে শুরু করেছে।  

বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলের একাধিক নেতা বলেন, এনসিপি ও জামায়াতকে বাইরে রেখে অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা সফল হলে চলতি বছরের এপ্রিল মাসের শেষের দিকে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে আন্দোলনে নামার পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির। 

দলটির মূল লক্ষ্য চলতি বছরের ডিসেম্বরেই যেকোনো মূল্যে নির্বাচন আদায় করে নিতে হবে। তবে জামায়াতের সঙ্গেও বিএনপির একটি অংশ বোঝাপড়া করতে আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে সবকিছুই পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে।  

চাপ সামলে নিতে পারলে নির্বাচন ২০২৭ সালে নিয়ে যাবে ইউনূস সরকার : অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক চাপে পড়তে হবে তা সরকারও মনে রেখেছে। তাই সরকার পরিকল্পনায় রেখেছে চাপ সামাল দেওয়ার নানাবিদ কৌশল। 

সেসব কৌশলে চাপ সামাল দিতে ব্যর্থ হলে ডিসেম্বরে নির্বাচন দিয়ে দেবে তারা। আর কোনোভাবে চাপ সামলে নিতে পারলে নির্বাচন ২০২৭ সালে টেনে নিয়ে যাবে ইউনূস সরকার।

নতুন রাজনৈতিক শক্তির যে উত্থান ঘটেছে, তারাই ক্ষমতায় এলে দেশ নিরাপদ থাকবে-এসব নানান হিসাব সামনে রেখে ইউনূস সরকারও চায় ২০২৭ সালে নির্বাচন টেনে নিতে, সমর্থ হলে তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সফল হবে। তা না হলে লেজে-গোবরে হবে সব পরিকল্পনা। 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা নিজেই বলেছেন ডিসেম্বরে নির্বাচনের কথা। সে অনুযায়ী নির্বাচন দেবেন এটাই আলোচনার মূল ভিত্তি। চাপ দিতে হবে, আন্দোলন করতে হবে কেন? অন্তর্বর্তী সরকার নিশ্চয়ই সে পথে যাবে না। তবে বিএনপির নেতারা মনে করেন, তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ। 

জানতে চাইলে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টাকে বলব, চলতি মার্চের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করুন। অন্যথায় রাজনৈতিক দলগুলো বসে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।’ 

এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, গণমাধ্যমে একটি বিশেষ দলকে নিয়ে কেউ নিউজ করে না। শুধু বিএনপিকে নিয়ে নিউজ করা হয়। ওই দলকে কারা টাকা দেয়, কারা হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করে দেয়, সেটিও জাতির সামনে প্রকাশের অনুরোধ করেন।

 গণমাধ্যমকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, একটি বিশেষ দল সম্পর্কে সাংবাদিকেরা কিছু লিখছেন না। যতটুকু পারেন ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে শুধু বিএনপির বিরুদ্ধে লিখছেন। পর্দার অন্তরালে অনেক কিছুই ঘটছে, সেগুলো কিন্তু আপনার লিখছেন না। 

কোন ব্যবসায়ী কোন দলকে কত টাকা দেন, কোন দল কোন ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে, কোন ব্যবসায়ীকে বাঁচাতে চেষ্টা চালাচ্ছেন, এগুলো কিন্তু লিখছেন না।

ডিসেম্বরে নির্বাচন নিয়ে এখনো সংশয়ে বিএনপি: আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে এখনো সংশয়ে আছে বিএনপি। দলটির নীতিনির্ধারণী নেতারা মনে করেন, চলতি বছরে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে এখনো ‘ষড়যন্ত্র’ চলছে।  খোদ সরকারের ভেতর থেকেই নির্বাচন বিলম্বিত করার প্রচেষ্টা রয়েছে।

যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও ব্যক্তিত্বকে বলেছেন, আগামী ডিসেম্বর নাগাদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা করছে তার সরকার।  

নির্বাচন কমিশনও (সিইসি) সেভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানিয়েছে। তবু ডিসেম্বরে নির্বাচন নিয়ে ‘ষড়যন্ত্র’ দেখছেন বিএনপির নেতারা। গত সোমবার গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দলের স্থায়ী কমিটির সভায় নেতাদের বক্তব্য পর্যালোচনায় নির্বাচন নিয়ে সংশয়ের কথা উঠে আসে।

অবশ্য এসব বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে কথা বলেছেন, আমরা প্রত্যাশা করি, সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে তিনি জাতির সামনে নির্বাচনের রোডম্যাপ উপস্থাপন করবেন। এতে নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা কেটে যাবে। নির্বাচনের রোডম্যাপ দিলে ব্যবসা-বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা কেটে যাবে, সব ক্ষেত্রে স্বস্তি আসবে।’

এ বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও পুলিশিং ব্যবস্থায় তিনি মনে করেন না, একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে। 

বিএনপির নেতারা এর মধ্যে ভিন্ন কিছুর আভাস দেখছেন। দলটির নেতারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। এর জন্য সরকারের প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা বা সরকারের নিয়ন্ত্রণহীনতা দায়ী। 

এ অবস্থা চলতে থাকলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো হওয়ার লক্ষণ নেই। তাহলে কি আইনশৃঙ্খলার উন্নতি না হলে নির্বাচন হবে না? 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য জানান, ‘শুধু ছকে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত জানাতে গেলে বিভ্রান্তি সৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। তাই আমরা ছকের পাশাপাশি বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করে মতামত জানাব।’ নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ তৈরি এবং সমালোচনা অব্যাহত রাখলেও সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে চায় না বিএনপি।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!