না.গঞ্জে তিতাস গ্যাস লাইন যেন মৃত্যুকূপ

দিলীপ কুমার মণ্ডল, নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত: মার্চ ১৭, ২০২৫, ০১:০৮ এএম

না.গঞ্জে তিতাস গ্যাস লাইন যেন মৃত্যুকূপ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

নারায়ণগঞ্জে অহরহ ঘটছে গ্যাস বিস্ফোরণের মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনায় ঝরে পড়ছে অনেক অমূল্য প্রাণ। অনেকেই আবার বেঁচে গিয়ে দগ্ধের ক্ষত নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এমন দুর্ঘটনার জন্য নগরবাসী যেমন দায়ী করছেন, তিতাস কর্তৃপক্ষের অবহেলাকে, তেমনি অনেকেই আবার দুষছে নাগরিক অসচেতনতাকে। 

লিকেজ পাইপলাইন সংস্কার না করা, গ্যাসের চাপ নিয়ন্ত্রণে না রাখা, দরজা-জানালা না খুলেই চুলা জালানো, রান্নাঘরে ভেন্টিলেটর না থাকা, সারাক্ষণ চুলা জ্বালিয়ে রাখা, চুলার সুইচ সঠিকভাবে বন্ধ না রাখার কারণেই এমন দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন সচেতন নগরবাসী।

সর্বশেষ ৩ মার্চ ভোরে নারায়ণগঞ্জ মহানগরীর সিদ্ধিরগঞ্জের পশ্চিম ধনকুণ্ডা এলাকায় ইব্রাহিম খলিলের টিনশেড বাসায় গ্যাস বিস্ফোরণে দগ্ধ হয় আটজন। দগ্ধরা হলেনÑ রিকশাচালক হান্নান (৪০), তার স্ত্রী নুরজাহান লাকী (৩০), মেয়ে জান্নাত (৩), মেয়ে সামিয়া (৯) ও ছেলে সাব্বির (১৬) এবং আরেক পরিবারের পোশাকশ্রমিক সোহাগ (২৩), তার স্ত্রী রূপালী (২০) ও তাদের একমাত্র দেড় বছর বয়সি মেয়ে সুমাইয়া। তাদের মধ্যে সোহাগ, তার স্ত্রী রূপালী ও মেয়ে সুমাইয়া ঢাকা মেডিকেল কলেজের জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে।

নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, দুই কক্ষবিশিষ্ট সেমিপাকা টিনশেড ঘরের নিচ দিয়ে গ্যাসের পাইপলাইন গেছে। সেখান থেকে কোনোভাবে গ্যাস লিকেজ হয় এবং এর থেকে কক্ষের ভেতরে গ্যাস চেম্বারের সৃষ্টি হয়। যেকোনোভাবে আগুনের স্পার্ক পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটে এবং আগুন ধরে যায়।

ফায়ার সার্ভিসের বাৎসরিক প্রতিবেদন যাচাই করে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে নারায়ণগঞ্জে গ্যাস লিকেজ থেকে ১০৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজ থেকে ১৬টি অগ্নিকাণ্ড ও ৫টি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, গ্যাসলাইনের লিকেজ থেকে দুর্ঘটনার পরিমাণ বেশি। 

তবে নারায়ণগঞ্জে সবচেয়ে ভয়াবহ গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মহানগরীর পশ্চিম তল্লার বায়তুস সালাত জামে মসজিদে। সেদিনের সেই দুর্ঘটনায় ৩৪ জন মুসল্লির মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। দগ্ধের ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন ৬০ জন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রাচ্যের ডান্ডি খ্যাত নারায়ণগঞ্জ জেলায় প্রায় ১ কোটি লোকের বসবাস, যার বেশির ভাগই শ্রমিক শ্রেণির। বিভিন্ন জেলা থেকে আগত স্বল্প আয়ের এই জনগোষ্ঠী চাকরি করছেন বিভিন্ন মিল-কারখানায়। এই চাকরির সুবাদে ভাড়া নিয়ে তাদের বসবাস করতে হচ্ছে বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে। 

বিল্ডিং কোড না মেনে গড়ে ওঠা অধিকাংশ বাড়িতেই অসাবধানতার কারণে ঘটছে গ্যাস বিস্ফোরণের মতো দুর্ঘটনা, যার কারণে ঝরে পড়ছে অমূল্য প্রাণ। তবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স নারায়ণগঞ্জের কাছে গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনায় হতাহতের নির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও তারা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে গ্যাস বিস্ফোরণের পরে আমরা ঘটনা জানতে পারি। 

আর ঘটনাস্থলে যেতে যেতে বিস্ফোরণের আগুনও নিভে যায়। এছাড়া ঘটনায় দগ্ধদের উদ্ধার করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার ফলে অনেক পরিসংখ্যান আমাদের নজরের বাইরে থেকে যায়। 

সংস্থাটি বলছে, নারায়ণগঞ্জ জেলা অনেক পুরোনো এবং বিপুলসংখ্যক মানুষের বসবাস। এই জেলায় গ্যাসলাইনগুলো পুরোনা, রয়েছে অবৈধ গ্যাসলাইন এবং গ্যাস ব্যবহারকারীদের অসচেতনতা। এ কারণে বারবার এই জেলায় গ্যাস বিস্ফোরণের মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ফতুল্লার এনায়েতনগরের বাসিন্দা অ্যাডভোকেট কাজী মামুন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, নারায়ণগঞ্জে অহরহই ঘটছে গ্যাস বিস্ফোরণের মতো দুর্ঘটনা। আমরা বর্ষাকালে হাঁটতে গিয়ে দেখি রাস্তা ফুঁড়ে গ্যাসের বুদবুদ বের হচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায়, প্রায় ৪০ বছরের পুরোনো গ্যাস পাইপলাইনগুলো লিকেজ হয়ে গেছে। এগুলো সংস্কার করছে না তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ।

শহরের আমলাপাড়ার বাসিন্দা সুশীল দাস রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনায় তিতাস কর্তৃপক্ষ যেমন দায়ী, তেমনি আমাদের অসাবধানতা আর অসচেতনাও অনেকটাই দায়ী। কেননা, আমরা দরজা-জানালা না খুলেই তড়িঘড়ি করে গ্যাসের চুলা ধরাতে যাই। এছাড়া অবৈধ গ্যাসলাইনের ছড়াছড়ি তো রয়েছেই নারায়ণগঞ্জে।

এ ব্যাপারে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি. আঞ্চলিক বিপণন বিভাগের  নারায়ণগঞ্জের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) প্রকৌশলী মো. মামুনার রশীদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, নারায়ণগঞ্জ একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। 

এখানে গ্যাসের চাহিদা বেশি থাকায় অনেক সময়ই গ্যাস সরবরাহ কমে যায়। সেই অবস্থায় গ্যাসের চুলার সুইচ বন্ধ না করার ফলে গ্যাস আসার পর গ্যাস জমে এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। এটা জনগণের অসচেতনতার কারণেই হচ্ছে। এর দায়ভার তিতাস নেবে না। 

তিনি বলেন, রান্নাঘরে ভ্যান্টিলেশনের ব্যবস্থা না থাকায় এই দুর্ঘটনা ঘটছে। অবৈধ গ্যাসলাইনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের অভিযান অব্যাহত রেখেছি। যেখানেই অবৈধ গ্যাসলাইন পাচ্ছি, সেগুলো বিচ্ছিন্ন করে আইনের আওতায় নিয়ে আসছি।’ পুরোনো ও লিকেজ পাইপলাইনের বিষয়ে বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের গ্যাসলাইনগুলো ৪০-৫০ বছরের পুরোনো। যেখানেই আমরা অভিযোগ পাচ্ছি, সেগুলো সারিয়ে নিচ্ছি।’

নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফিন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, নারায়ণগঞ্জ জেলা অনেক পুরোনো এবং বিপুলসংখ্যক নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস। এই জেলায় গ্যাসলাইনগুলো পুরোনা। এগুলো নিয়মিত মেনটেনেন্স করতে হয়, কিন্তু সেটি করা হয় না। 

এছাড়া রয়েছে অবৈধ গ্যাসলাইন এবং গ্যাস ব্যবহারকারীদের অসচেতনতা। এ কারণে বারবার এই জেলায় গ্যাস বিস্ফোরণের মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে। 

তিনি আরও বলেন, চুলার সুইচ বন্ধ না করা, দরজা-জানালা না খুলেই চুলা ধরানো, পাইপলাইনের লিকেজ না সারানো, গ্যাসের চাপ নিয়ন্ত্রণ না করা, রান্নাঘরে ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা না থাকা- এসব নানা কারণে নারায়ণগঞ্জে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। এটা সমাধানের জন্য পাইপলাইনের লিকেজ মেরামত করতে হবে। আর বাড়িঘরে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের সুবিধা রাখতে হবে। সঙ্গে জনগণকেও সচেতন হতে হবে।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!