ঢাকা সোমবার, ১৭ মার্চ, ২০২৫

সংস্কৃতির শহরে ভাঙা হচ্ছে সিনেমা হল

নিজস্ব প্রতিবেদক, ময়মনসিংহ
প্রকাশিত: মার্চ ১৭, ২০২৫, ০৮:৩৮ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির শহর ময়মনসিংহ। এই শহরে একসময় অজন্তা, ছায়াবাণী, অলকা, পূরবী ও সেনা অডিটরিয়াম নামে পাঁচটি সিনেমা হল ছিল। সিনেমা হলগুলোতে প্রচুর দর্শক হতো। দিনে দিনে মানহীন সিনেমা, দর্শকখরা এবং ২০০২ সালে সিনেমা হলে বোমা মারার পর হলগুলো ভাঙা শুরু হয়। অজন্তা, অলকা, সেনা অডিটরিয়াম বন্ধ হয়ে যায়। শহরে চালু ছিল শুধু পূরবী, ছায়াবাণী। সেই দুটি সিনেমা হল থেকে পূরবী সিনেমা হল ভেঙে নির্মাণ করা হচ্ছে বহুতল ভবন।

মানহীন সিনেমা ও দর্শকখরার কারণে ভাঙা হচ্ছে ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী পূরবী সিনেমা হল। হলটি নগরীর চমড়াগুদাম এলাকায় স্বাধীনতার আগে জমির উদ্দিন নামে একজন তৈরি করেন। কিন্তু ২০০২ সালে হলটিতে বোমা হামলার পর হলটি কিনে নেন আব্বাস উদ্দিন। তিনিই এত দিন চালিয়ে আসছিলেন। 

বিগত প্রায় এক মাস হলটিতে প্রদর্শিত হয়েছিল ‘একবুক জ্বালা’ চলচ্চিত্র। তবে একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হওয়া সংস্কৃতির জন্য বড় ধরনের হুমকি বলছেন সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষ। গতকাল রোববার দুপুরে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ৮-১০ জন শ্রমিক দেয়াল ভেঙে ইট, পাথর, লোহা সরানোর কাজ করছেন। 

গত ২৫ ডিসেম্বর থেকে ভাঙা শুরু হয়েছে নগরীর সবচেয়ে পুরোনো বড় সিনেমা হল পূরবী। ৩২ শতাংশ জায়গায় স্বাধীনতার আগে দোতলা সিনেমা হলটি নির্মাণ করা হয়েছিল। আসনসংখ্যা ছিল প্রায় ১ হাজার। ১৯৮০-১৯৯০ দশকে দর্শকপ্রিয় ছিল হলটি। 

২০০২ সালের ৭ ডিসেম্বর একই সময়ে অলকা, অজন্তা, ছায়াবাণী ও পূরবী সিনেমা হলে বোমা হামলার পর মূলত সিনেমা হলগুলোয় দর্শকসংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেতে থাকে। করোনার পর থেকে সেই সংখ্যা আরও বাড়ে। 

হল কর্তৃপক্ষ বলছে, বিগত কয়েক বছর ধরে প্রতি শোতে পাঁচ-সাতজন করে দর্শক হয়। অনেক সময় দর্শক না থাকার কারণে শো বন্ধ থাকে। দিনের পর দিন স্টাফ খরচও না ওঠায় হল ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাই সেখানে বহুতল ভবন করে দর্শকের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে প্রয়োজনে পূরবী সিনেপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। 

শ্রমিক মুকুল মিয়া বলেন, ‘গত ২৫ ডিসেম্বর থেকে হল ভাঙার কাজ শুরু করেছি। দৈনিক গড়ে ১২-১৪ জন শ্রমিক কাজ করছি। প্রথম ও দ্বিতীয় তলার ছাদ ও দেওয়াল ভাঙা হয়েছে। সম্পূর্ণ ভাঙতে আরও কমপক্ষে তিন মাস সময় লাগবে। শুনেছি সেখানে মালিকপক্ষ কমপ্লেক্স করবে।’ 
ঠিকাদার হারুন অর রশিদ বলেন, ১৫ লাখ টাকায় পূরবী সিনেমা হলের পুরোনো মালামাল ক্রয় করেছি। আমরা সেগুলো ভেঙে এখন জায়গা খালি করছি। সব মিলিয়ে আমাদের চার মাস সময় লাগবে। 

স্থানীয় বাসিন্দা মনু মিয়া বলেন, হলটি দেখতে দেখতে আমরা বড় হয়েছি। একসময় সিনেমার জোয়ার ছিল। তাই মানুষ হলের আশপাশে অনেক ভিড় জমাত। এখন ছবি না চলার কারণে মালিকপক্ষ হল ভাঙছে। এতে খারাপ লাগলেও মালিক তো আর বছরের পর বছর লোকসান গুনবে না।

পূরবী সিনেমা হলের ম্যানেজার মোখতার হোসেন বলেন, দেশের নামকরা কয়েকটি হলের একটি ছিল পূরবী। স্বাধীনতার বেশ কয়েক বছর আগে সেটি নির্মাণ করা হয়েছিল। তখন ভালো ভালো ছবি নির্মাণ হওয়ার কারণে হলভর্তি দর্শক হতো। 

বিশেষ করে করোনার পর হলের দর্শক একেবারে কমে যায়। সবশেষ এক মাস আগে আমরা একবুক জ্বালা ছবিটি চালিয়েছিলাম। হলের নিচতলায় ৭০০ আসন, দ্বিতীয় তলায় ডি চেয়ার ছিল ৩২০টি এবং বক্স ছিল ২০টি। 

তিনি আরও বলেন, হলের জায়গাটিতে একটি বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেখানে শপিং কমপ্লেক্স, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, আবাসিক বাসস্থানের ব্যবস্থা, দর্শকের চাহিদা বিবেচনায় পূরবী সিনেপ্লেক্স স্থাপনের চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। 

সমাজ রূপান্তর সাংস্কৃতিক সংঘের সভাপতি ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, একসময় একের পর এক করে তিনটি হলে ছবি দেখতাম। সে সময়টা আর কখনো আসবে না। হল বন্ধ হওয়া মানে সংস্কৃতির ওপর বড় ধরনের একটি হুমকি আসা। 

একের পর এক হল বন্ধ হওয়ায় আমাদের ছেলেমেয়েরা ভারতীয় সংস্কৃতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এর জন্য দায়ী মানহীন ছবি। একটি ছবির মাধ্যমে সমাজ ও দেশের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। তাই দেশীয় সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে সরকারকে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।